লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের স্যাটানট্যাংগো: পতনের চক্রে লেখা এক চিরন্তন নৃত্য
সাহিত্য, দর্শন ও লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের জটিল মহাবিশ্বে যাত্রা
স্যাটানট্যাংগো শুরু হয় এক বিষণ্ণ দিনে। চারদিকে বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি যা থামে না, যেন আকাশ নিজেই ধৈর্য হারিয়ে অবিরত আঘাত করছে মাটির ওপরে। এই বৃষ্টি এক ধরনের চিরস্থায়ী অস্তিত্বের রূপ, যা লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কল্পিত জগতে একই সাথে হাস্যকর এবং ভয়ানক।
“অক্টোবরের শেষের এক সকালে, যখন পশ্চিম প্রান্তের শুষ্ক ও লবণাক্ত মাটিতে নির্মম দীর্ঘ শরৎকালের বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো পড়তে শুরু করেছে; ফুতাকি ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেল; খুব শিগগিরই সেই মাটি এক দুর্গন্ধময় হলুদ কাদার সাগরে পরিণত হবে, যেখানে হাঁটা অসম্ভব হয়ে পড়বে, এমনকি কাছের শহরও হবে নাগালের বাইরে।”
এই সূচনাটি এক অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী। যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বৃষ্টি, প্রতিটি ঘণ্টাধ্বনি এক অনিবার্য পতনের পূর্বাভাস।
উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট এক যৌথ খামার। যা সরকারি কাগজে-কলমে বহু আগে বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ তার বাসিন্দারা এখনো সেখানে গুমরে বেঁচে আছে, নিজেদের সামান্য সঞ্চয় খরচ করে দিন গুনছে। সময়টা সম্ভবত আশির দশকের শুরুর; যখন হাঙ্গেরীয় সমাজতন্ত্রের গায়ে পচনের গন্ধ লেগে গেছে, পতন আসন্ন। এককালে এই খামার ছিল এক জমজমাট শিল্পকেন্দ্র, অথচ এখন তা কেবল কিছু ভাঙাচোরা ভবন আর পরিত্যক্ত গুদামের সমষ্টি একটি নিঃশেষিত জীবনের কঙ্কালমাত্র।
কিন্তু এই ধ্বংস আসলে লাসলোর জগতে পতনই স্বাভাবিক অবস্থা, যেমন বৃষ্টি অনন্ত, তেমনি পচনও অনিবার্য। তাই তিনি বর্ণনায় ব্যবহার করেন পুরোনো আমলের ভাষা, সেই সেকেলে শব্দভাণ্ডার, যেন অতীতের ছায়ায় বর্তমানের অচলাবস্থা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আশপাশে ছড়িয়ে আছে প্রাসাদ, জমিদারবাড়ি আর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের ফেলে যাওয়া জঞ্জাল, এক হারানো গৌরবের অবশেষ যা এখন কেবল স্মৃতির ধুলোয় ঢাকা।
লাসলোর লেখায় ইতিহাসের সীমারেখা ইচ্ছে করেই ঝাপসা করা হয়, এটাই যেন তাঁর রচনার মৌলিক নীতি। তিনি বাস্তবতার ভিতর ছোট ছোট অসংগতি বসিয়ে দেন, পাঠক যেন বুঝতেও না পারে কখন দৃশ্যের বাস্তবতা থেকে স্বপ্নের মায়া শুরু হলো। যেমন; ফুতাকিকে জাগিয়ে তোলা সেই ঘণ্টাধ্বনি। প্রথমে শুনে একেবারে স্বাভাবিক মনে হয়, যদিও তখন সে শুয়ে আছে মিসেস শমিডের পাশে, যিনি তার স্ত্রী নন। মিসেস শমিডের স্বামী, খামারের এক শ্রমিক, গরু বেনাবেচার কাজে বাইরে গেছেন।
ঘণ্টাধ্বনি শুনে ফুতাকি যুক্তি খোঁজে; কোথা থেকে আসতে পারে এই শব্দ? সবচেয়ে কাছের সম্ভাব্য জায়গা হলো পুরোনো হখমেইস এস্টেট, প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু ওখানে তো কোনো ঘণ্টাই নেই; টাওয়ারটি যুদ্ধের সময়েই ভেঙে পড়েছিল। এত দূর থেকে এমন শব্দ আসাও অসম্ভব। আর ঠিক তখনই ঘণ্টাধ্বনি থেমে যায়।
ফুতাকি আবার বিছানায় ফিরে আসে, কিন্তু চোখ বন্ধ করার সাহস পায় না। ভয় পায় সেই “ভূতের ঘণ্টাধ্বনি”র, আবার ভয় পায় তার পরের নীরবতারও। পাঠক তখন এক অদ্ভুত দ্বিধায় দাঁড়িয়ে পড়ে। এ কি অতিপ্রাকৃত কোনো ইঙ্গিত, নাকি এমন কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যার নাগাল এখনো পাওয়া যায়নি? এই অনিশ্চয়তার ভিতরেই লাসলো তাঁর জগৎ গড়ে তোলেন, যেখানে বাস্তব আর বিভ্রম একে অপরের আয়না।
লাসলো পাঠককে তাঁর চরিত্রগুলির ফাটলধরা চিন্তার ভিতর বন্দি করে রাখতে ভালোবাসেন। সেই মানসিক বন্দিদশারই মুদ্রণরূপ দেখা যায় স্যাটানট্যাংগো-তে। যেখানে তিনি অনুচ্ছেদবিরতির ধারণাটিকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ই যেন একটানা, অদম্য শ্বাসের মতো এক বিশাল প্যারাগ্রাফ, যার ভিতর সময় ও চিন্তা অবিরাম গড়িয়ে চলে।
পরবর্তীকালের লেখাগুলিতেও তিনি এই কৌশল আরও বিস্তৃত করেছেন। অনুচ্ছেদ, অধ্যায়, এমনকি বাক্যের দৈর্ঘ্য নিয়েও খেলেছেন একপ্রকার শল্যচিকিৎসার সূক্ষ্মতায়। ২০০৯ সালে প্রকাশিত El último Lobo নামের গল্পটি পুরোপুরি একটিমাত্র বাক্যে লেখা, এবং সেই বাক্যটি টানা আটাশ পৃষ্ঠা জুড়ে। যেন ভাষা নিজেই তার সীমা পরীক্ষা দিচ্ছে।
এই অনবরত বিস্তারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত আকর্ষণ: পাঠকের সামনে কোনো বিশ্রাম নেই, কোনো বিরতি নেই। অনুচ্ছেদ না থাকায় চোখ ও মনকে এগিয়ে যেতে হয়, যেন স্রোতের টানে ভেসে চলা এক জাহাজ। যেখানে শব্দের তরঙ্গেই দিকনির্দেশ। ঘণ্টাধ্বনির রহস্য যেমন অসমাপ্ত থাকে, তেমনি পাঠকেরও মুক্তি নেই; সে ক্রমাগত টেনে নেওয়া হয় সেই অজানা প্রবাহে, যেখানে গল্পের ভিতর সময়, ভাষা, আর চিন্তা মিলেমিশে একাকার।
শমিডের ঘরে না থাকার কারণ সরল মনে হলেও, তার ভিতর লুকিয়ে আছে এক নোংরা ষড়যন্ত্র। সেদিন সকালে সে আর ক্রানের গিয়েছিল “গরু একত্র করতে, সেগুলোকে পশ্চিম দিকে সিজকেস অঞ্চল পেরিয়ে খামারের আস্তাবলে নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেখানে তারা অবশেষে আট মাসের কষ্টার্জিত মজুরি পাবে।” (অবশ্য, এই “মজুরি” কাদের কাছ থেকে বা কোন ব্যবস্থায় দেওয়া হবে, সে বিষয়ে লাসলো ইচ্ছে করেই কোনো ব্যাখ্যা দেন না। অর্থনীতি এখানে যেন ভূতের মতো উপস্থিত; দৃশ্যমান নয়, কিন্তু সর্বত্র অনুভবযোগ্য।)
চুক্তি অনুযায়ী, এই অর্থ খামারের বাকি বাসিন্দাদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হওয়ার কথা। কিন্তু শমিড ও ক্রানের গোপনে এক দুষ্ট চুক্তি করে ফেলেছে, সব টাকা নিজেরা নিয়ে পালাবে, বাকিদের রেখে যাবে চরম দারিদ্র্যে। তাই শমিডের আগেভাগে ফিরে আসা প্রায় ফুতাকির পরকীয়া ধরে ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। কিন্তু ফুতাকি কোনোমতে জানালা দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়।
তারপরও সে ঘটনাটা বুঝে ফেলে। শমিড নিশ্চয়ই কোনো গোপন স্বার্থে আগেই ফিরে এসেছে। এই বুদ্ধি মাথায় নিয়ে সে ইচ্ছে করে আবার সামনের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে, যেন হঠাৎ চলে এসেছে। মুখোমুখি হয় শমিডের সঙ্গে, এবং তাকে হুমকি দেয়, গ্রামের সবাইকে ফাঁস করে দেবে যদি টাকা আত্মসাৎ করার পরিকল্পনা না বদলায়। ফলত এক নতুন চুক্তি তৈরি হয়। অর্থ ভাগ হবে তিন ভাগে: শমিড, ক্রানের, আর ফুতাকির মধ্যে।
অর্থাৎ, লাসলোর এই ক্ষুদ্র পরিসরের ঘটনায় ধরা পড়ে পুরো সমাজের এক বৃহৎ সত্য। পচনের যুগে নৈতিকতা কেবলই দরকষাকষির মুদ্রা, আর মানুষের সম্পর্ক, ভালোবাসা ও বিশ্বাস, সবকিছুই এক গোপন হিসাবের অংশ।
প্রথমে মনে হয়, এই কাহিনি যাবে একদম বাস্তবতার অলানিতে। ঘৃণায়, লোভে, এবং ক্লান্ত মানবিক দীনতায় ভরা এক বাস্তববাদী গহ্বরে। ফুতাকি, শমিড ও তার স্ত্রী অন্ধকার নামার অপেক্ষায় থাকে, যেন সুযোগ পেলে পালাতে পারে, সব ফেলে। কিন্তু ঠিক তখনই গল্পটি ভেঙে পড়ে, গলে যায়। যেন বাস্তবতার শেল খুলে তার ভিতর থেকে কোনো পুরোনো বিশ্বাসের ধোঁয়া বেরিয়ে আসে।
ক্রানের স্ত্রী হঠাৎ ছুটে আসে শমিডদের দরজায়, মুখে উত্তেজনা। সে খবর আনে, দু’জন মানুষ, ইরিমিয়াস আর পেত্রিনা, যাদের দুই বছর আগে মৃত বলে ধরা হয়েছিল, তারা নাকি জীবিত, আর এখন ফিরছে খামারের পথে। এই কয়েকটি বাক্যই যেন গল্পের আবহ পুরো উল্টে দেয়। যারা কিছুক্ষণ আগেও পালানোর ছক কষছিল, তারাই হঠাৎ আশাবাদী হয়ে ওঠে, প্রায় অলৌকিক উল্লাসে ভরে যায়।
ফুতাকি বলে, “ইরিমিয়াস এক মহা জাদুকর, চাইলেই গরুর বিষ্ঠার ঢিপি থেকে প্রাসাদ বানিয়ে ফেলতে পারে।” অতীতে ইরিমিয়াসই বারবার খামারটিকে আর্থিক ধ্বংস থেকে উদ্ধার করেছিল, তাই হয়তো আবারও পারবে, আবার গড়ে তুলবে সেই হারানো সমৃদ্ধি। এই অলৌকিক আশাবাদের ঝলকে, আত্মসাতের টাকার কথাও যেন ভুলে যায় সবাই। তারা জড়ো হয় গ্রামের মদের দোকানে। চোখে অনিশ্চিত বিশ্বাসের আলো, মনে এক অবাস্তব উচ্ছ্বাস, অপেক্ষা ইরিমিয়াসের।
যে গল্পটি শুরু হয়েছিল কাদার বাস্তবতায়, তা ধীরে ধীরে রূপ নিতে থাকে এক ধর্মীয় রূপকে। এক মেসিয়ানিক কল্পকথা, যেখানে পতিত পৃথিবীর মানুষরা হঠাৎ করে আবার মুক্তির আশা দেখতে পায়। লাসলো যেন বলতে চান, সভ্যতার ভাঙা ঘরেও মানুষ শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের পুনরাগমন অপেক্ষায় থাকে, যদিও সেই ঈশ্বর আসলে হয়তো মানুষই।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে লাসলো নিজেকে তুলে ধরেন এক রকম কঠোর নান্দনিক যোগীর মতো। যিনি বিশ্বাস করেন সংযমই শিল্পের শ্রেষ্ঠ রূপ। তিনি বলেন, “পাঠককে সন্তুষ্ট থাকতে হবে কিছু নির্দিষ্ট অথচ অস্পষ্ট ইঙ্গিত নিয়ে—কারণ আমি যা বর্ণনা করি, তা আসলে যেকোনো জায়গাতেই ঘটতে পারে।” আরেক জায়গায় আরও স্পষ্ট করে বলেন, “সময় ও স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, কেবল পরিস্থিতিই আসল।”
এই সংযমী নান্দনিকতা অবশ্য আধুনিকতাবাদের দীর্ঘ ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে; কাফকা বা স্যামুয়েল বেকেটের উপন্যাসগুলোতেও আমরা দেখি, কীভাবে বিমূর্ততার ভিতরেই ধরা পড়ে অস্তিত্বের চূড়ান্ত বাস্তবতা। কিন্তু আমার মনে হয়, লাসলো আসলে আরও চতুর, আরও দুষ্টুমি-ভরা এক নির্মাতা। তাঁর বক্তব্য যতটা কঠোর শোনায়, তাঁর রচনাশৈলী ততটাই কৌতুকপূর্ণ ও প্রলুব্ধকর। তিনি শুধু তথ্য বাদ দেন না, যে তথ্য দেন, সেটাও এমনভাবে দেন যেন তা ঘুরপাক খায়, এদিক-ওদিক ঝাপসা হয়, যেন পাঠককেও সেই গোলকধাঁধায় টেনে নিয়ে যায়।
অর্থাৎ, তাঁর রচনায় অনুপস্থিতি যেমন অর্থ তৈরি করে, তেমনি উপস্থিতিও করে বিভ্রম। এই দোলাচলই লাসলোর কৌশল—যেখানে প্রতিটি বাক্য simultaneously (একযোগে) প্রকাশ আর গোপন দুই-ই।
স্যাটানট্যাংগো গঠিত হয়েছে এক অদ্ভুত স্থাপত্যে; দুটি ভাগে, প্রতিটি ভাগে ছয়টি করে অধ্যায়, যেন সময় আর দৃষ্টিকোণের রঙিন টুকরো দিয়ে গাঁথা এক বিশাল কাঁথা। গল্প এগোয় চরিত্র থেকে চরিত্রে, দৃশ্য থেকে দৃশ্যে, কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু সেই এক সন্ধ্যা। গ্রামের বারে জমায়েতের রাত, এবং তার পরের দু’একটি দিন, যেখানে বাস্তবতা ও ভবিষ্যদ্বাণী একে অপরের গায়ে মিশে যায়।
দ্বিতীয় অধ্যায়টি শুরু হয় আসলে সময়ের কিছু আগের এক মুহূর্ত থেকে, যদিও সেটা পাঠক বুঝতে পারে অধ্যায়ের শেষের দিকে এসে। দৃষ্টিকোণও বদলে যায়। এবার দেখা যায় দুটি নতুন চরিত্রকে, যারা বসে আছে এক সরকারি দপ্তরের করিডরে, নীরবে অপেক্ষা করছে কারও জন্য। চার পৃষ্ঠা পরে জানা যায়, তাদের একজন পেত্রিনা। আরও পাঁচ পৃষ্ঠা পর ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয় সত্য, অন্যজন হল ইরিমিয়াস।
যে দুই জনের পুনরাগমনের খবর শুনে ফুতাকি ও শমিড দম্পতি আশায় বুকবেধে ছিল, সেই রহস্যময় ইরিমিয়াস ও পেত্রিনা আসলে তখনই দৃশ্যপটে প্রবেশ করেছে। এভাবেই লাসলো সময়কে ভেঙে ফেলেন এক অদ্ভুত কৌশলে—ঘটনার আগে-পরের রেখাগুলো মিলিয়ে দেন এমনভাবে যে পাঠক কখনই নিশ্চিত হতে পারে না সে অতীতে আছে, না ভবিষ্যতে। তাঁর বর্ণনার ছন্দে সময়ের ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ে, আর সেই ভাঙনের ভিতরই উন্মোচিত হয় উপন্যাসের ভৌতিক ও দার্শনিক স্পন্দন।
এই জটিল, প্রায় ঘূর্ণাবর্তের মতো গঠন যে স্যাটানট্যাংগো-কে আচ্ছন্ন রাখে, তার ভিতর রয়েছে এক দার্শনিক যুক্তি। যেমন লাসলোর চিত্রনাট্যে নির্মিত বেলা তারের Damnation চলচ্চিত্রে করের নামে এক চরিত্র বলে, “প্রত্যেক গল্পই আসলে এক ভাঙনের গল্প।” এই বাক্যই যেন লাসলোর সাহিত্যের মূল সূত্র।
তাঁর জগতে মানুষ সর্বদাই খোঁজে স্থায়ী অর্থ; রাজনীতিতে, ধর্মে, যৌনতা বা সম্পর্কের জালে—কিন্তু সেই অর্থ চিরকালই অধরা, যেন প্রতিটি বিশ্বাসই একটু পরেই ভেঙে পড়বে। তাই লাসলোর আড়াআড়ি, বক্র বর্ণনার কৌশল পাঠককেও বাধ্য করে এক ধরণের দীক্ষা নিতে।“অনুকূল ও প্রতিকূল সংকেতের পার্থক্য করার অবিচ্ছেদ্য দক্ষতা” অর্জন করতে। পাঠককে গল্পের ওপরের স্তর খুঁটিয়ে দেখতে হয়, যেন প্রতিটি বাক্যের ভিতর লুকিয়ে আছে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী, কোনো গুপ্ত অর্থ।
এ কারণে হয়তো লাসলো থমাস পিঞ্চনের লেখাকে খুব শ্রদ্ধা করেন—যাঁর কাছ থেকে তিনি তাঁর সাম্প্রতিক বই Seiobo-এর জন্য মুখবন্ধও নিয়েছেন। পিঞ্চন যেমন অস্পষ্ট অথচ অর্থপূর্ণ জগত নির্মাণ করেন, তেমনি লাসলোও তাঁর কাদামাখা বৃষ্টিভেজা বারের মধ্যে খোঁজেন সেই অনির্দিষ্ট অর্থের সম্ভাবনা।
তবে এই “বাঁকারচনা-পদ্ধতি”র ভিতরে দর্শনের যুক্তি ছাড়াও, একরকম খেলাও আছে—একটি কৌতুকপূর্ণ মুক্তি। এই কাঠামো তাঁকে দেয় স্বাধীনতা; রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা মনস্তাত্ত্বিক, যেকোনো স্তরে অর্থের ব্যাখ্যা তৈরি করার, আবার কোনো একক ব্যাখ্যায় আটকে না থাকার। তাই তাঁর সংযমে আছে এক নান্দনিক মুক্তি, যেন প্রতিটি অনুপস্থিতির ভিতরই জন্ম নেয় এক নতুন সম্ভাবনার আলো।
শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, স্যাটানট্যাংগো-এর ঘটনাপ্রবাহেরও নির্দিষ্ট সময় ও স্থান আছে। যদিও লাসলো সেটিকে অস্পষ্টতার ধোঁয়ায় ঢেকে রাখেন। গল্পের কঙ্কাল গঠিত হয়েছে এক যৌথ খামারের ওপর, যা একটি সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রের অংশ। এক শ্বাসরুদ্ধ সমাজ, যেখানে নজরদারি, অবিশ্বাস ও পতনের গন্ধ সর্বত্র।
ইরিমিয়াস ও পেত্রিনার গ্রামে ফিরে আসা ঘিরে গোটা কাহিনি মোচড় খায়। একসময় এই খামারেই তারা বাস করত এবং শাসক কমিউনিস্ট সরকারের তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করত। কিন্তু পরে তারা আদর্শচ্যুত হয়ে পড়ে; এখানে লেখক কেবল ইঙ্গিত দেন, ব্যাখ্যা দেন না—আর সেই কারণেই তাদের পাঠানো হয় জেলে।
দুই বছর পর, সেই একই দিনে, যেদিন ফুতাকির ঘুম ভাঙে মিসেস শমিডের পাশে, তাদের মুক্তি দেওয়া হয়, “শ্রমে পুনর্বাসন” নামের এক রাজনৈতিক ভণ্ডামির মাধ্যমে। মুক্তির পর ইরিমিয়াস সিদ্ধান্ত নেয় তারা ফিরে যাবে সেই খামারে। উদ্দেশ্য সোজা: “ওদের টাকা নেব, তারপর এখান থেকে সরে পড়ব।”
এই এক বাক্যেই যেন প্রকাশ পায় উপন্যাসের নৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। এমন এক পৃথিবী, যেখানে বিশ্বাস ও প্রতারণা, মুক্তি ও শাস্তি, সবই পরস্পরবিনিমেয় মুদ্রা; আর মানুষ, রাষ্ট্রের মতোই, বাঁচে ঠকিয়ে ও ঠকে।
ভোর হওয়ার আগে, ইরিমিয়াস আর পেত্রিনা এখনো পৌঁছায়নি; এর মধ্যেই লাসলো আমাদের নিয়ে যান গ্রামের সেই বারে, যেখানে রাতের আঁধারে জমে উঠেছে এক অবসন্ন, প্রলয়ঘন, তবু অদ্ভুতভাবে হাস্যকর পানভোজনের আসর। এই দৃশ্য দুইটি অধ্যায় জুড়ে চলে—মদ, ক্লান্তি আর পচনের এক দীর্ঘ ব্যালে; যেখানে পৃথিবী ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে নিজের ভিতর, যেন জগৎ নিজেই নিজেকে শেষ করার প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত।
বারটি মাকড়সার জালে ঢাকা, যেন পুরোনো পাপের ফাঁদে আটকে থাকা এক সভ্যতা। মালিকের চোখ লেগে আছে মিসেস শমিডের গায়ে; সে হিটার বাড়িয়ে দেয়, যেন গরমে বিরক্ত হয়ে মিসেস শমিড তার পোশাক খুলে ফেলে। মিসেস হ্যালিকস তার স্বামীকে বাধ্য করছে Book of Revelation পড়তে—প্রলয়ের সেই পুস্তক, যেন নিজের পতনকে ধর্মের ভাষায় বুঝে নিতে চায়। এদিকে মিসেস হর্গোস হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে তার মেয়ে এসতিকে। যে হারিয়ে গেছে, আর আশ্চর্যভাবে কেউ তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছে না। উদাসীনতা যেন এক প্রকার মহামারী।
মদ্যপ অবস্থায় মিসেস হ্যালিকস এবার প্রলুব্ধ করতে চায় মিসেস ক্রানারকে—সব সীমা ভেঙে যাচ্ছে, নৈতিকতা আর ইচ্ছা একাকার। সারা রাত ধরে তারা পান করতে থাকে, যতক্ষণ না শেষমেশ মত্ত হয়ে সবাই নেমে পড়ে এক ধীর, টলোমলো নৃত্যে। উপন্যাসের নামের সেই স্যাটানট্যাংগো—যা নীরবে পর্যবেক্ষণ করছে মিসেস হ্যালিকস, নিজের মনে শুধু একটাই প্রশ্ন: “বিচার আসতে এত দেরি কেন?”
শেষে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ে বারেই, নিস্তব্ধ মৃতের মতো আর ঠিক তখনই ফিরে আসে ইরিমিয়াস ও পেত্রিনা, যেন ভোরবেলার পুনরুত্থানদৃশ্য।
এই মুহূর্তেই উপন্যাসটি প্রবেশ করে তার কেন্দ্রবিন্দুতে—যেখানে লাসলো একসঙ্গে টান দেন দুই বিপরীত স্রোত: সর্বব্যাপী পচনের এক চিত্র, আর সেই পচনের ভিতরেই এক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার আভাস। এই দুই স্রোতের সংযোগস্থল এক হারিয়ে যাওয়া মেয়ে; এসতি হর্গোস—যে অনুপস্থিত থেকেও হয়ে ওঠে সমগ্র কাহিনির হৃদয়, এক অদৃশ্য উপকথার কেন্দ্র, যেখানে পতনের মাঝেও লুকিয়ে থাকে পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি।
যে দুটি অধ্যায়ে রাতভর পানীয় আর পাপের নৃত্য চলে, তাদের মাঝখানে লাসলো রাখেন এক শোকাহত অধ্যায়। এসতির দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত। এই ছোট্ট মেয়েটি, যে নিজের বাড়িতেই অবাঞ্ছিত, অবহেলিত মায়ের ও বোনদের দ্বারা, আর ভাই শানিই তার প্রতি খুবই নিষ্ঠুর । গ্রামের লোকেরা তাকে বলে “পাগল মেয়ে”—যেন তার ভিতরের অতিরিক্ত অনুভব, অতিরিক্ত দুঃখ, সমাজের বোধের বাইরে।
সেই দিন বিকেলে, উন্মত্ত দুঃখ ও রাগে এসতি হঠাৎ নিজের বিড়ালটিকে আঘাত করে মেরে ফেলে। কাজটা শেষ হওয়ার পরই তার মধ্যে জন্ম নেয় এক বন্য অনুশোচনা। মুহূর্তেই ভেঙে যায় তার পৃথিবীর শেষ আশ্রয়। তখন সে মৃত বিড়ালটিকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত সেই ওয়েইনখাইম প্রাসাদের দিকে, যেখানে সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
“হ্যাঁ,” সে আস্তে আস্তে নিজের মনে বলে, “স্বর্গদূতেরা এটা দেখছে, আর বুঝছে।”
প্রাসাদের ভগ্নচূড়ায় পৌঁছে এসতি বিড়ালটিকে পাশে শুইয়ে দেয়, নিজেও শুয়ে পড়ে মাটিতে, তারপর পান করে বিষ। সে জানত, তার অভিভাবক দেবদূতেরা ইতিমধ্যেই পথে রওনা হয়েছে। এই দৃশ্য, করুণ অথচ অলৌকিক, যেন উপন্যাসের হৃদস্পন্দন—এক হারিয়ে যাওয়া শিশুর আত্মহননের ভিতর দিয়ে লাসলো দেখান সমগ্র সমাজের মৃত্যু। এসতির মৃত্যু মানে সেই যৌথ খামারেরও মৃত্যু, যেখানে সহানুভূতির কোনো স্থান নেই, কেবল অবক্ষয়, লজ্জা ও অনন্ত নীরবতা।
স্যাটানট্যাংগো-এর প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের মাঝখানে রয়েছে এক অদ্ভুত ফাঁক—এক রাত ও এক দিনের অনুল্লিখিত ব্যবধান, যা পাঠকের কাছে অনুপস্থিত থাকলেও বর্ণনার মধ্যে যেন ঘন অন্ধকারের মতো ঝুলে থাকে। এই সময়েই গ্রামজুড়ে শুরু হয় এসতির খোঁজ, আর সেই অনুসন্ধানের পরিণতি—তার মৃতদেহের আবিষ্কার।
দ্বিতীয় অংশের সূচনা হয় ইরিমিয়াসের বক্তৃতা দিয়ে—গ্রামের বিপর্যস্ত, ভগ্নচিত্ত বাসিন্দাদের উদ্দেশে এক মহাকাব্যিক ভাষণ। তা শুনতে ধর্মভীরু, মানবতাবাদী, আবার কোথাও যেন সমাজতান্ত্রিক প্রচারপত্রের মতো—এক অদ্ভুত মিশ্রণ, যেখানে নিষ্ঠা, প্রতারণা ও মিথ্যার সুর একাকার হয়ে যায়। এসতির মৃত্যুর আবেগকে ব্যবহার করে ইরিমিয়াস ঘোষণা দেয় যে সে আবার একটি যৌথ খামার গড়ে তুলতে চায়—“একটি মডেল অর্থনীতি, যা নিরাপদ জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতি দেবে এবং বঞ্চিতদের একত্রিত করবে”—সম্ভবত পাশের অ্যালমাসি ম্যানরে, যে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের ভূত হয়ে।
অবশ্যই, সে যোগ করে, এই মহান উদ্যোগের জন্য অর্থের প্রয়োজন হবে।
এইভাবেই লাসলো পুনরায় শুরু করেন পতনের চক্র—যেখানে প্রতারণা নেয় মুক্তির রূপ, আর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভাষা মিশে যায় এক নেশাসৃষ্টিকারী ভ্রান্ত আশাবাদে। ইরিমিয়াস যেন এক আধুনিক ছদ্মমেসিয়াহ, যে মৃত শিশুর দেহের ওপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি, অথচ তার মুখে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই আসলে এক নতুন শোষণের সূচনা।
এভাবেই, এসতির মৃত্যুর অপরাধবোধে জর্জরিত ও ইরিমিয়াসের অলৌকিক বাগ্মিতায় মোহিত গ্রামবাসীরা নিজেদের শেষ সঞ্চয়—এমনকি আত্মসাৎ করা টাকাটিও—তার হাতে তুলে দেয়। তাদের বিশ্বাস, এই মানুষই তাদের মুক্তি দেবে, নতুন করে জীবন গড়বে। এরপর তারা সবাই যাত্রা শুরু করে অ্যালমাসি ম্যানরের দিকে, যেন নতুন যুগের তীর্থযাত্রী, আর ইরিমিয়াস, পেত্রিনা ও শানি রওনা হয় শহরের পথে—“পরিকল্পনা সংগঠিত করতে,” এমনই বলা হয়।
কিন্তু পাঠক জানে—সবটাই এক চক্রান্ত। ইরিমিয়াস আসলে একজন নিখুঁত সুযোগসন্ধানী, যে কেবল টাকার লোভে ফিরেছিল, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে আরও বড় শিকার। তার চোখে ঝলমল করছে এক নতুন স্বপ্ন—“এক বিশাল জাল, এক মহামাকড়সার জাল, যা বুনেছি এবং পেটেন্ট করেছি আমি, ইরিমিয়াস।”
সে টাকা ছাড়াও, মানুষের আত্মাও কব্জা করতে চায়। গ্রামবাসীদের অর্থ আত্মসাৎ করার পর, সে এখন ভাবছে তাদেরকেই পরিণত করবে নিজের গুপ্তচর বাহিনীতে। এক ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক, এক মিথ্যা মুক্তির নামে নির্মিত বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রে।
এইভাবেই লাসলো তুলে ধরেন ক্ষমতার বিকৃত ধর্মতত্ত্ব। যেখানে মসীহাও আসলে ঠগ, আর বিশ্বাসের সবচেয়ে নির্মল রূপটিও শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় এক রাজনৈতিক প্রতারণায়।
কিন্তু ঠিক এখানেই এই মলিন, দৈনন্দিন দুর্নীতির গভীরে বাস্তবতা হঠাৎ ভেঙে যায়, যেন পৃথিবীর তলদেশে এক চিরচেনা ফাটল খুলে পড়েছে। ইরিমিয়াস, পেত্রিনা ও শানি যখন শহরের পথে হাঁটছে, সেই পথই তাদের নিয়ে যায় ওয়েইনখাইম দুর্গের ধ্বংসস্তূপের দিকে, যেখানে এসতি আত্মহত্যা করেছিল।
হঠাৎ তারা শুনতে পায় এক অদ্ভুত গুনগুন শব্দ, যেন বাতাসের ভিতর দিয়ে কেউ নীরবে শ্বাস নিচ্ছে। তারপর দেখে একটি সাদা, স্বচ্ছ পর্দা বাতাসে উড়ছে, নরম ঢেউ খেলছে আকাশে, এবং মাটিতে ছোঁয়া মাত্রই মিলিয়ে যায় শূন্যে। তারা এগিয়ে যায়, আর গুনগুন শব্দটি ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক অশুভ হাসিতে—“যেন কেউ ঠোঁটের কোণে টেনে হাসছে।” অথচ আশেপাশের গাছপালায় সামান্য নড়াচড়াও নেই।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা পৌঁছায় দুর্গের মাঠে সেখানে তারা দেখে এসতির মৃতদেহ, অনেকগুলো স্বচ্ছ কাপড়ে জড়ানো। কিন্তু সেটি তো তারা আগেই মাটিচাপা দিয়েছিল, কাঠের কফিনে। এখন, সেই দেহ যেন মাটির বুক থেকে উঠে এসেছে, আর তারপর ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে আকাশের দিকে হাওয়ায় দুলতে দুলতে।
“তারপর এক ঝনঝন শব্দ, ঘণ্টার মতো, তাদের মাথার ওপর ক্রমে তীব্র হয়ে উঠল—এক বিজয়ী উল্লাসের সুরে—তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।”
এই মুহূর্তে স্যাটানট্যাংগো আর বাস্তবতার কোনো কাহিনি নয়, হয়ে ওঠে এক পরাবাস্তব দর্শন। যেন লাসলো বলতে চান, পতন আর অলৌকিকতা একই মুদ্রার দুই দিক—যখন সভ্যতা পচে যায়, তখন মৃত শিশুরাও পাখা মেলে স্বর্গে উড়ে যায়।
দৃশ্যটি ব্যাখ্যাতীত, অথচ মন্ত্রমুগ্ধকর। কোনো পরাবাস্তব চিত্রকর স্বপ্নের ভিতর আলো ফেলেছেন। ইরিমিয়াস ও পেত্রিনা, শানির আতঙ্ক প্রশমিত করতে, ঘটনাটিকে হ্যালুসিনেশন বলে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু তারা ততটা নিশ্চিত নয়। তারা কী সত্যিই কোনো অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিল? নাকি বাস্তবই তাদের নিয়ে খেলছে?
তবে ইরিমিয়াস রেগে গিয়ে সেই ধারণা কঠোরভাবে নাকচ করে দেয়। “আমরা যা দেখেছি, তাতে কিছুই যায় আসে না,” সে বলে। “স্বর্গ? নরক? পরকাল? সব বাজে কথা।”
তার যুক্তি নির্মম; মানুষ চিরকাল বন্দি, এই বৃষ্টির ভিতর, এই কাদার পৃথিবীতে। “আমরা ভাবি আমরা মুক্ত হচ্ছি, কিন্তু আসলে কেবল তালাগুলোর অবস্থান বদলাচ্ছি। আমরা বন্দি—এটাই শেষ কথা।”
তারপর তারা আবার হাঁটতে থাকে শহরের পথে, মুশল বৃষ্টির মধ্যে, এমন এক পৃথিবী যেখানে মুক্তি নেই, ঈশ্বর নেই, কেবল অন্তহীন কাদা ও ক্লান্ত পদক্ষেপের শব্দ।
এই মুহূর্তে লাসলো তাঁর দর্শনের কেন্দ্রে পৌঁছান। অস্তিত্ববাদী হতাশা আর আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা একই ছায়ায় মিশে যায়, যেখানে মানুষ জানে, সে মুক্ত নয়, তবু হাঁটতে থাকে—যেন হাঁটাই তার শেষ বেঁচে থাকার উপায়।
তবু পাঠকের মনে থেকে যায় এক জাদুবিদ্ধ অস্বস্তি—যে মায়া সহজে কাটে না। ঘটনাটিকে হয়তো হ্যালুসিনেশন বলা যায়, কিন্তু যারা সবচেয়ে বেশি যুক্তিবাদী, তারাও সেটি বিশ্বাস করতে পারছে না। ফলে বাতাসে ভেসে থাকে এক অদৃশ্য গুঞ্জন—প্রলয়ের সম্ভাবনা, এই উপন্যাসের কাদা, পাপ ও কামনার ওপর ঝুলে থাকে এক টেলিফোন তারের মতো; নিরব, কিন্তু ক্রমাগত কাঁপতে থাকে।
জর্জ সির্তেসের অনুবাদে লাসলোর ভাষা এই অনিশ্চয়তাকে ধরে রাখে; একদিকে চরিত্রের সাধারণ কথ্যভাষা, অন্যদিকে গভীর বিষণ্ণ সৌন্দর্য। যেমন ফুতাকি জানালার কাঁচে নিজের “ক্লান্ত মুখাবয়ব” দেখতে পায়, আর ঠিক পরের লাইনেই লেখক বলেন—“তার মনে হলো, বৃষ্টি যা করছে তার মুখের ওপর, সময়ও তাই করবে; ধুয়ে মুছে দেবে তাকে।”
এইরকম বাক্যে লাসলো যেন বাস্তবতাকেও এক বিষণ্ণ রসায়নে পরিণত করেন যেখানে বৃষ্টি কেবল প্রকৃতির থাকে না, সময়েরও প্রতীক; আর মানুষের মুখ, স্মৃতি, অস্তিত্ব সব ধীরে ধীরে মুছে যায় এক অনন্ত দ্রবণে।
এই উপন্যাস পড়ে এক প্রকার অতিলৌকিক তত্ত্ব গঠন করা যায়। এক এমন ব্যাখ্যা, যা এসতির মৃতদেহের ভেসে ওঠাকে, ফুতাকির শোনা ঘণ্টাধ্বনিকে, আর ইরিমিয়াসের কানে ধরা পড়া গুনগুন শব্দটিকে একসূত্রে বাঁধে। তখন স্যাটানট্যাংগো-এর “স্যাটান” শব্দটি যেন ইরিমিয়াসের প্রতিই ইঙ্গিত করে—যে চরিত্রটিকে বারের বেয়ারা ঠাট্টা করে ডাকে “Lord of Misrule,” এক মিথ্যা মসীহা, যে মুক্তির নামে বিক্রি করে প্রতারণার বার্তা।
তবে এই ব্যাখ্যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস হ্যালিকস—যিনি Book of Revelation নিয়ে পাগলের মতো বুঁদ, অথচ হাস্যকর। তাঁর ধর্মান্ধতা এক কার্টুন। যা বিদ্রুপের প্রতীক, মুক্তির নয়। আর যদি ইরিমিয়াস সত্যিই “স্যাটান” হন, তবু তিনি কোনো মহাশক্তিধর দানব নন—এক ক্ষুদ্র, দৈনন্দিন, রাজনৈতিক যুগের স্যাটান; এক সাধারণ কমিউনিস্ট নাস্তিক, যে ঈশ্বরকে অস্বীকার করে, কিন্তু ভয় পায় নিজের দেখা অলৌকিকতাকে।
অর্থাৎ, লাসলো এখানে শয়তানকেও মানবিক করে ফেলেন। তার পাপ আসে মতাদর্শ থেকে, অলৌকিক থেকে নয়। তাঁর “স্যাটান” মাটির কাদা থেকে তৈরি, আকাশের আগুন থেকে নয়।
অন্যভাবে বললে, লাসলো যেন আবিষ্কার করেছেন ধর্মীয় উপকথা লেখার এক সম্পূর্ণ নতুন রীতি—যেখানে আখ্যানের জাদু টিকে থাকে, কিন্তু তার ভিতর থেকে ঈশ্বরকে মুছে ফেলা হয়েছে।
এরপর কাহিনি ফিরে আসে বাস্তবতার ছন্দে। ইরিমিয়াস তার পরিকল্পনা সফলভাবে সম্পন্ন করে। সে ঘোষণা দেয়, কর্তৃপক্ষ আপাতত তাদের প্রকল্পটি অনুমোদন করছে না; তাই সবাইকে আপাতত ছড়িয়ে যেতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে “আরও অনুকূল সময়ের” জন্য। কিন্তু ততদিন তারা যেন থাকে সজাগ ক্রমাগত যোগাযোগের মধ্যে, আর নিজেদের চারপাশের ওপর রাখে সতর্ক পর্যবেক্ষণ।
তারপর ইরিমিয়াস যায় শহরে, এবং সরকারি কার্যালয়ে জমা দেয় এক বিস্তারিত রিপোর্ট—যেখানে গ্রামের প্রতিটি বাসিন্দার চরিত্র, অভ্যাস ও দুর্বলতা নিয়ে সে লিখে ফেলে নির্ভুল বিবরণ। এইভাবেই এক গুপ্তচরবৃত্তির নেটওয়ার্ক তৈরি হয়, যেন বিশ্বাস আর সন্দেহের মাঝখানে ফাঁদ পেতে দেয় রাষ্ট্র।
এখানে এসে গল্পটি প্রায় শেষ হয়ে যায়। এক চূড়ান্ত বিচ্ছেদের অবস্থায়, যেখানে সমস্ত আশা ও সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। এই ভাঙন আসলে গঠিত ছিল গাণিতিক নিপুণতায়: উপন্যাসের প্রথম অংশে অধ্যায়গুলোর নম্বর I থেকে VI পর্যন্ত, আর দ্বিতীয় অংশে সেই ক্রম উল্টো—VI থেকে I। অর্থাৎ, স্যাটানট্যাংগো নিজেই তার গতি-ছন্দের মধ্যে হারিয়ে যায়—ট্যাংগো, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই পূর্ববর্তীটিকে বাতিল করে। এটি আত্মবিনাশের এক শৈল্পিক কোরিওগ্রাফি, যেখানে কাহিনি যেমন এগোয়, তেমনি ধীরে ধীরে নিজেকেই মুছে ফেলে।
কিন্তু যদি পৃথিবীই সম্পূর্ণ শূন্য হয়, এক নিঃশেষিত অস্তিত্ব যেখানে অর্থের অবশিষ্ট নেই—তাহলে লেখালেখি সেখানে কী প্রভাব ফেলতে পারে? লাসলো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেন উপন্যাসের এক গৌণ চরিত্রে—খামারের ডাক্তার।
এই মানুষটি এক নিঃসঙ্গ নিরীক্ষক, যিনি খামারের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও সেখানে থেকে গেছেন। দিন কাটান পর্যবেক্ষণে, গ্রামের বাকি বাসিন্দাদের জীবন, পতন ও পচনের ক্ষুদ্রতম লক্ষণগুলোর নোট নিচ্ছেন যেন কোনো নিষ্ঠাবান ভূতাত্ত্বিক ধ্বংসের মানচিত্র আঁকছেন। তিনি আতঙ্কিত “ধ্বংসের জয়যাত্রা” দেখে—যা ধীরে ধীরে বাড়িঘর, প্রাচীর, গাছ, মাঠ সবকিছুকেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এই অবশ্যম্ভাবী পচনের মুখে তাঁর একমাত্র প্রতিরোধ হলো স্মৃতি। “নিজের স্মৃতিশক্তি ব্যবহার করে ধ্বংসের এই গোপন প্রক্রিয়াকে রুখে দাঁড়ানো,” এই তাঁর প্রতিজ্ঞা। তাই তিনি নোটবুকে লিখে রাখেন সবকিছু, প্রতিটি ক্ষুদ্রতম পরিবর্তন, যেন কোন কিছুই না হারায়।
ইরিমিয়াস ও পেত্রিনার আগমনের সেই রাতে, সে আরও প্যালিঙ্কা (মদ) কেনার জন্য বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু দিক হারিয়ে ফেলে, অন্ধকার মাঠে ঘুরে বেড়ায়, শেষে শহরের রাস্তা পৌঁছে যায়—পরের দিন বিকেলে তাকে পাওয়া যায়, জীবিত কিন্তু উন্মাদপ্রায় অবস্থায়।
উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে দেখা যায়, তিন সপ্তাহের হাসপাতালবাসের পর ডাক্তার আবার ফিরে এসেছে নিজের ঘরে। সে স্বাভাবিক অভ্যাসমতো পর্যবেক্ষণ শুরু করতে চায়, কিন্তু গ্রাম তো শূন্য—ইরিমিয়াসের আদেশ মেনে সবাই চলে গেছে। পর্যবেক্ষণের জন্য আর কেউ নেই।
এই শূন্যতার মধ্যেই হঠাৎ সে শুনতে পায় ঘণ্টাধ্বনি—ঠিক সেই ঘণ্টার শব্দ, যা ফুতাকি শুনেছিল উপন্যাসের শুরুতে। ডাক্তারও বুঝতে পারে না এর উৎস; হতাশ হয়ে ফাঁকা খামারের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর তখনই তার মধ্যে এক বোধের উদয় হয়—সে বুঝে ফেলে, পর্যবেক্ষণের জন্য মানুষের উপস্থিতি প্রয়োজন নেই। সে নিজেই সৃষ্টি করতে পারে তাদের। সে এক দূরদর্শী হয়ে ওঠে, বা বলা যায়—একজন লেখক।
উত্তেজিত হাতে লিখতে শুরু করে সে, কিন্তু ঘণ্টাধ্বনি আবার ভেসে আসে। এবার সে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে, চলে যায় হখমেইস এস্টেটের পুরোনো চ্যাপেলে—যে জায়গাটিকে ফুতাকি একসময় বলেছিল এত দূর যে ঘণ্টা শোনা অসম্ভব। সেখানে পৌঁছে ডাক্তার আবিষ্কার করে এক পাগলকে, যে নাড়ছে “একটি ছোট্ট ঘণ্টা…খোলা, অস্থায়ী কাঠামোর মাঝখানে ঝোলানো।”
অতিলৌকিকতারও আসলে বাস্তব ব্যাখ্যা থাকে। প্রলয়ের প্রতিধ্বনিও হয়তো কেবল এক পাগলের হাতের ঝনঝনানি। এই রহস্য মিটে গেলে ডাক্তার ফিরে আসে নিজের ঘরে, দরজা বন্ধ করে দেয় পেরেক দিয়ে, আবার বসে লেখার টেবিলে।
“একটি কাগজও নষ্ট না করে, সে লেখা শুরু করল—
‘অক্টোবরের শেষের এক সকালে, যখন দীর্ঘ, নির্মম শরৎকালের বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো পড়তে শুরু করেছে…।’”
হ্যাঁ—সে শুরু করছে স্যাটানট্যাংগো।
উপন্যাসটি এখানেই বৃত্তে পরিণত হয়। এক অনন্ত চক্র, যেখানে ধ্বংসই লেখার উৎস, আর লেখাই সেই ধ্বংসের পুনর্জন্ম।
উপন্যাসের এই সমাপ্তিটিকে দার্শনিকভাবে নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। সবচেয়ে সহজ উপায় হলো একে নিটশের Eternal Return—চির-প্রত্যাবর্তনের ধারণার এক অন্ধকার প্রতিধ্বনি হিসেবে দেখা। অর্থাৎ, স্যাটানট্যাংগো-এর নৃত্য কেবল গ্রামবাসীদের মদের নেশায় মাতাল ছন্দ ভাবলে ভুল হবে—এটি আসলে অস্তিত্বেরই প্রতীক, এক শয়তানি চক্র যেখানে জীবন ক্রমাগত নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে, অর্থহীন অথচ অনিবার্য।
স্যামুয়েল বেকেট যেমন জয়েসের Finnegans Wake-কে বলেছিলেন এক “দান্তীয় প্রায়শ্চিত্তের প্রক্রিয়া,” তেমনই লাসলোর এই উপন্যাসও হয়ে ওঠে এক নরকীয় পুনর্জন্মচক্র, যেখানে ধ্বংস ও পুনরারম্ভ একে অপরের প্রতিফলন।
কিন্তু এই ব্যাখ্যা যতই দার্শনিক হোক, তার নিচে রয়েছে আরও গভীর অস্থিরতা। পাঠক চাইলে এর ভিতর একটি যুক্তিবাদী কাঠামো খুঁজে নিতে পারেন—ধরা যেতে পারে, উপন্যাসের সমস্ত ঘটনাই সত্য, সেই মুহূর্ত পর্যন্ত যখন ডাক্তারকে রাস্তায় বিভ্রান্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর যা ঘটে, তা তার মনের তৈরি এক স্বপ্ন বা বিভ্রম—যেন হাসপাতালে থেকে ফিরে এসে গ্রামের শূন্যতা বোঝার জন্য সে নিজের কল্পনায় নির্মাণ করেছে এই বাকি কাহিনি।
তাহলে স্যাটানট্যাংগো মস্তিষ্কের ভিতর জন্ম নেওয়া নরক, যেখানে স্মৃতি, অনুতাপ আর একাকীত্ব মিলে তৈরি করে এক বদ্ধ চক্র। এবং সেই চক্রের নামই জীবন।
কিন্তু সমস্যা হলো—উপন্যাসের ভিতরে কোথাও এমন কোনো স্পষ্ট চিহ্ন নেই যা এই বিভাজনটিকে সমর্থন করতে পারে। যেমন কামুর The Plague-এ আমরা শেষে জানতে পারি, কাহিনি আসলে চরিত্রদেরই এক জনের লেখা, তেমন কোনো স্বীকৃতি এখানে নেই। স্যাটানট্যাংগো-এর ভিতর কল্পনা ও বাস্তবের সীমারেখা আলাদা হয়ে ওঠে কেবল এক মুহূর্তে, যখন ডাক্তার লেখার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে এই মুহূর্তও মুক্তির নয়; কারণ, ডাক্তার যে লেখা শুরু করে পৃথিবীর ধ্বংসের বিরুদ্ধে এক প্রতিরক্ষা হিসেবে, তা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে সেই ধ্বংসেরই অংশ—এক সাহিত্যিক মরীচিকা। তার নোটবুক আসলে কবরেরই সম্প্রসারণ। উপন্যাস নিজেকে খেয়ে ফেলে নিজের ভিতর—লেখাই হয়ে ওঠে আত্মবিনাশের যন্ত্র।
পরিহাসের বিষয় এই যে, সেই ধ্বংসের মধ্যেও উপন্যাস রয়ে যায়, বাস্তবের মতোই অনিবার্য, নিজের অলৌকিক আভায় দীপ্ত। যেমন এসতির মৃতদেহের ভেসে ওঠা দৃশ্যটি কখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা হয় না, তেমনি এই সমাপ্তিটিও রয়ে যায় বহুস্তরীয়, ইঙ্গিতপূর্ণ, অথচ অনিশ্চিত। স্যাটানট্যাংগো তাই এক উপকথা। যার কোনো স্থির তত্ত্ব নেই, কেবল রয়েছে অসীম ব্যাখ্যার সম্ভাবনা।
স্যাটানট্যাংগো-এর উপক্রমণিকাটি একটিমাত্র বাক্য: “In that case, I’ll miss the thing by waiting for it.”—বাংলায় বললে, “সেই ক্ষেত্রে, আমি অপেক্ষা করেই হারাবো জিনিসটিকে।” লেখক কেবল সংক্ষিপ্ত সূত্র দেন—“F.K.”—কাফকার ইঙ্গিত, তবে নাম উচ্চারণ করেন না। উৎসটি আসলে কাফকার The Castle উপন্যাসের অষ্টম অধ্যায়, “Waiting for Klamm।” সেখানে এক “ভদ্রলোক” K-কে চলে যেতে বলেন। K উত্তর দেয়, “কিন্তু তাহলে তো আমি যাঁর জন্য অপেক্ষা করছি, তাঁকে হারাবো।” ভদ্রলোক বলেন, “তুমি তাঁকে হারাবে, অপেক্ষা করো বা না করো।” K তখন সেই পরাজয়ের মধ্যেই বিজয় ঘোষণা করে—“তাহলে আমি অপেক্ষা করেই হারাতে চাই।”
কাফকার উপন্যাসে এই বাক্যটি আত্মসমর্পণের ভিতরে প্রতিরোধের সাহসের প্রতীক। নিজের পরাজয়কেও এক নৈতিক অবস্থানে রূপ দেওয়া। কিন্তু লাসলো যখন এটিকে অস্পষ্ট সূত্রে উপক্রমণিকায় লেখেন, তখন সেটি হয়ে ওঠে প্রায় এক বিপরীতধর্মী—একসঙ্গে হতাশার ও উচ্ছ্বাসের, এক অক্সিমোরনিক বাক্য, যা জীবনের মর্মকথা বলেও কিছু গোপন রাখে।
“In that case, I’ll miss the thing by waiting for it.”—এই বাক্যই লাসলোর শৈলীর ক্ষুদ্র প্রতিমূর্তি: যেখানে দৈনন্দিনতার ভিতরই লুকিয়ে থাকে মহাজাগতিক ট্র্যাজেডি ও ব্যঙ্গের মিশ্র রহস্য। হ্যাঁ, এর শিকড় কাফকার মাটিতে গভীরভাবে প্রোথিত। লাসলো নিজেও বলেছেন, “কাফকা না থাকলে আমি কখনও লিখতে পারতাম না।”
তবু তাঁর মহিমা এখানেই যে, তিনি সেই উত্তরাধিকারের ভিতর থেকে নিজের অনন্য রূপ নির্মাণ করেছেন—এমন ভাষা, যেখানে হতাশাও গায় সঙ্গীত, আর ধ্বংসও হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের রূপক। স্যাটানট্যাংগো, তাঁর প্রথম উপন্যাস, সেই অশরীরীয় মৌলিকতার শিখর, যা আমাদের সমকালীন সাহিত্যে বিরল।




