জমির আলি অথবা - দুর্মুখ
সত্যি বলতে কী, সারা দিন উনি মুখিয়ে থাকেন কখন জমির আলি হবেন সেই আশায়। ক'দিন আগেই সিক্রেট সার্ভিসের লোকরা বলে গেছে—মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও পোষ্ট দিতে। না হলে লোকজন সন্দেহ করতে পারে।
গল্পটি ২০১৭ সালে আমার এক বন্ধু আমাকে পাঠায়, অনুরোধ করে প্রকাশ করার জন্য, আবার একই সাথে প্রকাশ না করার অনুরোধও করে। অনেক বছর পরে আমি আমার ব্লগে গল্পটি প্রকাশ করলাম, এবং কেন তাঁর সেই স্ববিরোধিতা ছিল সেটা জানার জন্য গল্পটি পড়ে দেখুন।
ঘুমের আগে একটু ফেসবুকিং করা তার ইদানিংকার অভ্যাস। আগে ঘুমুনোর আগে একটু হালকা কিছু পড়তেন। বার কয়েক আমরিকা থাকাকালীন সময়ে নেটফ্লিক্সের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ছাতার মাথা ঐসব মিটিং-ফিটিং না থাকলে উনি পারলে সারা দিনই OITNB ( Orange Is the New Black ) দেখতেন। দেশে ফিরে টেলি-যোগাযোগ মন্ত্রীর সাথে আলাপ করে একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। এখন দিব্যি আনন্দে দেশে বসেই নেটফ্লিক্স দেখতে পারেন। তার কানেকশন নাকি একদম 'সিকিওর'! রাষ্ট্রের দন্ডমুণ্ডের কর্তা হবার সুবিধা অনেক। তারপ্রিয় শো বর্তমানে হাউস অব কার্ডস। ফ্র্যাঙ্ক আন্ডারউডের প্রায় প্রেমেই পড়েছেন তিনি বলা যায়।
তবে ইদানিং নেটফ্লিক্স দেখায় একটু ভাটা পড়েছে। সেই বোগদাদী আমলে খলিফা হারুনুর রশিদ রাতে বেরিয়ে পড়তেন প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবেন বলে। এই আমলে তো সেইটি হবার জো নেই। তবে ফেসবুকটা এসে তার বিরাট উপকার করেছে। কয়েকবছর আগে ছেলে সুজয়ের ওখানে বেড়াতে গেলে আমেরিকান বৌমা তাকে এইটার খবর দেয়। সাথে এই বুদ্ধিটাও দিয়েছিল হাসতে হাসতে।
তিনি তখন হাসেন নি। চোখ তার জ্বলজ্বল করে উঠেছিল! আগ্রহে, উদ্দীপনায়।
সে দেশে ফিরেই লোক লাগিয়ে দিয়েছিলেন—এইরকম কিছু করা সম্ভব কি না তা যাচাই-বাছাই করতে। পাঁচদিনের মধ্যে তিনি ইতিবাচক সংবাদ পেলেন। বেশ পাঁচ-ছ'টা একাউন্ট বানিয়ে দিয়েছে তার সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন। একদিন এসে একেবারে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছে কিভাবে কী করতে হবে। সেই পাঁচ-ছ টা একাউন্ট এখন বেড়ে প্রায় ২০টার মত হয়েছে। এদের কিছু অবশ্য এখন সুজয় চালায়। কিছু চালায় বৌমা। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একাউন্ট এখনো তার হাতে। তার সবচেয়ে পছন্দের একাউন্টের নাম জমির আলি। রোজ রাতে এগারোটার পর তিনি জমির আলি হয়ে যান। সিক্রেট সার্ভিসের লোকরা দারুণ ভালো কাজ করেছে। জমির আলি নামের কাল্পনিক চরিত্রটার বেশ একটা ডিটেইল প্রোফাইল তৈরী করেছে। জমির আলি একটা বেসরকারী ফার্মে কাজ করে। বৌ আর ১ সন্তান সহ তাদের ছোট ছিমছাম সংসার। জমির আলি শ্যামলীতে থাকে। প্রোফাইলে তার বেশ কিছু পারিবারিক ছবি দেওয়া আছে—মধ্যবয়স্ক, গাল-ভাঙ্গা, টাকমাথার বিষন্ন চোখের জমির আলির সাথে তার অতীতের একমানুষের কোথায় যেন মিল আছে। ঐ প্রোফাইলে বন্ধু ও আত্মীয় স্বজন হিসেবে বেশকিছু সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন আছে। তাদের নিত্য দিনের কাজ হচ্ছে এই প্রোফাইলটি কে যতদূর সম্ভব সাধারণ আট-পৌড়ে মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা। একদিন তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন—ছবিতে দেখা এই জমির আলি আসলে কে। জানলেন যে এক গ্রামের কৃষককে নিয়ে আসা হয়েছে এই কাজের জন্য। ঠিক তেমনি ভাবে আলাদা আলাদা করে 'জোগাড়' করা হয়েছে জমিরের বউ আর সন্তান। দু'তিন পর পর তিনি পাঁচ-ছ'টা ছবি পান সিক্রেট সার্ভিসের লোকগুলো থেকে—সাথে ছোট্ট বর্ণনা। উনি ছবি বাছাই করে নিয়ে তখন পাঠানো বর্ণনার সাথে মিল রেখে ফেবুতে পোষ্ট দেন। পোষ্ট হবার ঠিক ৪ বা ৫ ঘন্টার পর থেকে সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা বিভিন্ন আত্মীয় বা বন্ধু বেশে পোষ্টে লাইক বা কমেন্ট দিতে থাকে।
সত্যি বলতে কী, সারা দিন উনি মুখিয়ে থাকেন কখন জমির আলি হবেন সেই আশায়। ক'দিন আগেই সিক্রেট সার্ভিসের লোকরা বলে গেছে—মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও পোষ্ট দিতে। না হলে লোকজন সন্দেহ করতে পারে।
জমির আলি হয়ে তার কাজ কেবল পোষ্ট দেওয়া নয়—তার মূল কাজ বিভিন্ন গ্রুপে যোগ দেওয়া এবং সেখানে ঢুকে গ্রুপের কার্যকলাপ মনিটর করা। ২০১৩ সালে তার এই জমির আলি চরিত্রটা অনেক কাজে এসেছিল। একেবারে সাধারণ মানুষজন কী ভাবছে কী করছে—সব জানতে পারছিলেন একেবারে সরাসরি। তারপর নাস্তিক মারার যে ধুম পড়ল তখনও তিনি বিভিন্ন গ্রুপে-ফোরামে ঘুরে ঘুরে—দেশের পালস বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—যা আসলে তার জন্যে উপকারীই হয়েছে।
তবে সব দিন সবকিছু যে ভাল যায়—এমন না। মাঝে মাঝে তাকে কিছু ডিসিশান নিতে হয়—যেটা তার নিজের বিবেকের কাছে বড় পীড়াদায়ক ঠেকে। সে সমস্যারও সমাধান রয়েছে—তার আছে একটা ভীষন কার্যকর ঘুমের ঔষধ আছে। আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছেন। যতই টেনশন নিয়ে ঘুমুতে যান না কেন—এই ঔষুধ খেলে, সকালে উঠে দিব্যি ঝরঝরে লাগে। সব ঔষুধের মত এইটারও অবশ্য কিছু সাইড ইফেক্ট আছে—অনেকের নাকি হ্যালুসিনেশন হয়। তার তেমন কিছু কখনো হয় নি।
আজ ফেবুতে ঢুকেই মনে হল—কাজটা ঠিক হয় নি। নানান গ্রুপে লোকজন খুব চেঁচামেচি করছে বিশ্বজিতের খুনের রায় নিয়ে। উনার কিছু সময় লাগল বিশ্বজিত কে সেটা জানতে। প্রথমে চমকে উঠেছিলেন গায়ক কুমার বিশ্বজিত ভেবে—এই লোকটার গান উনার খুব ভালো লাগে। ঐ যে কী একটা আছে না? ঐ যে, “যারে ঘর দিলা সংসার দিলা রে—তারে বৈরাগী মন কেন দিলা রে”। এক সময় খুব শুনতেন। আহ্ একটা বৈরাগী মন থাকলে বেশ হত—লোকজন বলে, তার আছে কেবল রাগী একটা মন।
এই বিশ্বজিতের কথাও উনি জানতেন। সেই ঘটনা ঘটার সময়েই কানে এসেছিল। তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন আরো নানান ঘটনা সামাল দেওয়া নিয়ে। সবকিছুকে তো আর সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা যায় না। প্লাস নিজের দলের পুলাপানকে খুব বেশি শাসন করা ঠিক না—এদের সামান্য ছাড় দিয়ে রাখতে হয়—এইটা অতীত থেকে নেওয়া তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার মাঝে একটা।
আজ কী যে হল—সারা ফেবুর পেইজ জুড়ে ছেলেটাকে কোপানোর ছবিতে ভরে আছে। এ লোক সে লোকের ওয়ালে প্রজাপতির মত হালকা পায়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তার ডানা ভার হয়ে আসে—ক্লান্তিতে না—মনঃকষ্টে।
তিনি বোকা নন—ফেবুর বদৌলতে তিনি ভালই জানেন তার সরকারের, তার নিজের ভাবমূর্তি কোন জায়গায় আছে। বিরূপ আলোচনা শোনা, সহ্য করা, উপেক্ষা করা—এইগুলো রাজনীতিবিদদের অবশ্যম্ভাবী আয়ুধ। তবুও কিছু কিছু মানুষের ঘৃণা ভরা উচ্চারণ আজ তাকে অন্যদিনের মত উত্তপ্ত করল না কেন জানি। কেন জানি বরং মন খারাপ হয়ে এল—এত কিছু তিনি করার চেষ্টা করছেন এই দেশটার উন্নতির জন্য—আর সামান্য একটা খুনের জন্য তাকে এমন সব গালি শুনতে হচ্ছে। গালি তিনি অনেক শুনেছেন—এইসব গা সওয়া হয়ে গেছে তার। সব কিছু গায়ে মাখলে পলিটিক্স করা যায় না। কিন্তু এত বছর পরেও কেউ বাপ তুলে গালি দিলে এখনো প্রচন্ড কষ্ট হয়।
নাহ, আজকে একটু বেশিই অস্থির লাগছে তার।
হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে ঘুমের ঔষুধটা নিলেন তিনি। ঝকঝকে এক গ্লাস সুশীতল জল গায়ে বড় বড় জলের ফোঁটা মেখে তার অপেক্ষায় ছিল। ঔষধ খেয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ করে তার মনে হল—গ্লাসটা যেন কাঁদছে—তার সারাটা গা জুড়ে কান্নার জল ঘিরে আছে।
ঘরের আলো মৃদু করে দিয়ে পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করেন তিনি।
হঠাৎ করেই তার মনে হল কেমন যেন তামাকের একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগল। চমকে উঠলেন তিনি। এ গন্ধ তো ভীষন পরিচিত! এই গন্ধ তার ছেলেবেলা, বড়বেলা সববেলার সাথে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে। এই গন্ধ, একটা ভারী মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচ, ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল—এসবই তার ভীষন পরিচিত, ভীষন আপনদৃশ্য প্রপঞ্চ!
হঠাৎ করেই তার শরীর ভীষন খারাপ করে উঠতে লাগল। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ স্থবির জড়তাময় হয়ে উঠল। কপালে জেগে উঠল কাঁচের গেলাসের মতন জমে থাকা ফোঁটা ফোটা স্বেদবিন্দু । যন্ত্রণাময় শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মাথাটাও ভার হয়ে আসতে লাগল। চমকে উঠলেন তিনি! পানিতে কেউ কিছু মিশিয়ে দেয় নি তো! তা কী করে হবে? চারিদিকে তার এত বিশ্বস্তলোক—কে করবে এমন কিছু!
“তোর বাপেরও চারপাশে অনেক বিশ্বস্ত লোক ছিল রে”—বলে হা হা হা করে হেসে ওঠে একটা কন্ঠস্বর ঘরের কোনে। কোন মতে শ্বাস নিতে নিতে অনেক কষ্টে একপাশে কাত হয়ে তিনি দেখতে পান—তার ঘরের দক্ষিন কোনার চেয়ারটাতে কে যেন বসে আছে। আবছা আলোয় তার মুখটা পরিস্কার না বোঝা গেলেও—হাতে ধরা পাইপ আর সেখানে জ্বলজ্বল করে থাকা আগুন চিন্তে তার ভুল হলনা! শ্বাস প্রশ্বাস তার আরো স্থবির আর মন্থর হয়ে এল—ইমার্জেন্সি সুইচটা বালিশের কাছেই থাকে। আজ ছাই সেটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে চেয়ারে বসে থাকা ছায়ামূর্তি আর তার হাতে ধরা পাইপ। মরিয়া হয়ে তিনি হাতড়ে বেড়ান চারপাশে—সুইচের মত কী একটা যেন তার হাতেও এসে লাগে। প্রানপণে সে সুইচ টেপার চেষ্টা করেন তিনি—কিন্তু তার আঙুল অসাড় হয়ে আছে। কিছুতেই নড়াতে পারছেন না তিনি—
জ্ঞান হারাতে হারাতে তিনি শুনলেন ছায়ামূর্তির কন্ঠে একটা পরিচিত স্বর দাঁতে দাঁত পিষে বলছে— “হারামজাদী”!
-------------------------------------------------------------------------
[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই গল্পের সমস্ত চরিত্র, কাহিনী ইত্যাদি সম্পূর্ণ কাল্পনিক! এর সাথে বর্তমানের বা অতীতের কোন কিছুর মিল পেলে তা নিতান্তই পাঠকের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বলে বিবেচিত হবে]