আলো ধরে রাখা এক নারী: সাইদা খানমের ক্যামেরায় ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি
ইতিহাসে এক একটি মুহূর্ত থাকে যা বদলে দেয় দৃষ্টিভঙ্গি—সাইদা খানম ছিলেন তেমন এক মুহূর্ত, যিনি ক্যামেরার লেন্সে শুধু ছবি ধরেননি, ধরেছেন একটি দেশের চোখ মেলে ওঠার সময়টুকু।
আলোকচিত্রের ইতিহাসে তাঁর নামটা যেন আলোর আঁচড়ে খোদাই হয়ে আছে—একজন নারী, যিনি ক্যামেরার চোখে দেখেছেন দেশ, মানুষ, আন্দোলন আর সময়ের ছায়াপাত। সাইদা খানম—বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী, যাঁর জীবন ছিল একাধারে এক বিপ্লব, এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ, এবং এক অবিচল শিল্পভ্রমণ। ১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনার মাটি ছুঁয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হলেও, এই যাত্রাপথে শেকড় ছিল ফরিদপুরের ভাঙ্গায়—পিতার কর্মসূত্রে জন্মস্থান আর বাস্তবিক আত্মপরিচয়ের মাঝখানে বাঁধা পড়েছিল তাঁর শৈশব, ইছামতির তীরে গড়া এক মনোরম পৃথিবীতে। বাবার নাম আবদুস সামাদ খান, মায়ের নাম নাছিমা খাতুন—নামের ভিতরেও যেন ছড়িয়ে আছে এক অন্তরঙ্গতা, এক পারিবারিক শৃঙ্খলা যা পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের দৃঢ়তার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে (১৯৬৮) ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে (১৯৭২) স্নাতকোত্তর অর্জন, এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত থাকা—এটা যেন তাঁর জীবনচর্যার এক অবলম্বন, কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় গড়ে উঠেছিল ক্যামেরার পেছনের জীবন দিয়ে। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে হাতে ক্যামেরা—একটা যুগে, যখন নারীরা ছবি তুলবে তো দূরের কথা, ছবি উঠবেই কিনা তাও ছিল বিতর্কিত। ১৯৫৬ সালে ‘বেগম’ পত্রিকায় আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। ‘দ্য অবজারভার’, ‘মর্নিং নিউজ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’ থেকে শুরু করে জাপানি পত্রিকাতেও তাঁর আলোকচিত্র ছাপা হয়—এ যেন একজন নারীর নয়, বরং এক ইতিহাস-দ্রষ্টা মানবীর কাজ, যিনি জানতেন আলোর মধ্যে কিভাবে গল্পের ছায়া ধরা যায়। তবে পথ ছিল বন্ধুর। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ক্যামেরা হাতে নারীকে সহজে নেয়নি কেউ। তাঁকে সাহস জুগিয়েছিলেন তাঁর খালা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, বড়বোন হামিদা খানম, মহসিনা আলী এবং যাঁরা নারী জাগরণের আদি সেনানী—নূরজাহান বেগম ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন।
তাঁর আলোকচিত্র সংগ্রহে আছে তিন হাজারেরও বেশি ছবি—প্রকৃতি থেকে রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে প্রতীক। নজরুল, জয়নুল, বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, ইন্দিরা, উত্তম-সুচিত্রা, হেমন্ত, অড্রে হেপবার্ন থেকে শুরু করে নীল আর্মস্ট্রং, মার্শাল টিটো—তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েছে কেবল মুখ নয়, সময়ের একেকটা নিঃশ্বাস। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’-এর সেটে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করা এক বিস্ময়কর অধ্যায়, যেখানে তিনি পেশাদার সিনেমাটোগ্রাফার না হয়েও শিল্পের গভীরে ঢুকে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে আজিমপুরে অস্ত্র হাতে নারীর প্রশিক্ষণের দৃশ্য—সাইদা খানমের ক্যামেরায় তা পরিণত হয় প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবিতে। ইতিহাস তখন শুধু বইয়ের পাতায় নয়, তার ফ্রেম ছিল তাঁর চোখে, তাঁর কাঁপা আঙুলে।
দেশি-বিদেশি অসংখ্য প্রদর্শনী, আন্তর্জাতিক সম্মাননা, জার্মানির কোলন পুরস্কার (১৯৫৬), জাপানের ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড, অনন্যা শীর্ষ দশ, একুশে পদক (২০১৯)—এসব তাঁর অর্জনের বাহ্যিক চিহ্ন। কিন্তু সাইদা খানম কেবল একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক আন্দোলন, এক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন। পাশাপাশি লিখেছেনও আজীবন। ‘ধূলোমাটি’ (১৯৬৪), ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’, ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’ (২০০৪), এবং তাঁর উপন্যাসত্রয়ী—এসব বইয়ের পৃষ্ঠায় ধরা পড়ে তাঁর অভিজ্ঞতা, আবেগ ও অন্তর্দৃষ্টি। আলোকচিত্র যেমন আলো ও ছায়ার খেলা, তেমনি তাঁর লেখা ছিল স্মৃতি ও মননের সংলাপ। তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সক্রিয় সদস্য। তাঁর দেশপ্রেম শুধু ছবিতে নয়, কাজেও প্রমাণিত—মুক্তিযুদ্ধের পর নার্স সংকটে স্বেচ্ছাসেবী নার্সিং, গণআন্দোলনে নীরব সহায়তা—এসব ছিল তাঁর নীরব বিপ্লবের উপাখ্যান।
সাইদা খানম চলে গেলেন ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট—৮৩ বছর বয়সে, ঢাকায়। কিন্তু তিনি আসলে কোথাও যাননি—থেকে গেছেন তাঁর ছবি, লেখা, কাজ আর যেসব নারী তাঁর আলোকচিহ্ন অনুসরণ করে হাঁটতে শিখেছে তাঁদের ভেতরে। ইতিহাসে এক একটি মুহূর্ত থাকে যা বদলে দেয় দৃষ্টিভঙ্গি—সাইদা খানম ছিলেন তেমন এক মুহূর্ত, যিনি ক্যামেরার লেন্সে শুধু ছবি ধরেননি, ধরেছেন একটি দেশের চোখ মেলে ওঠার সময়টুকু।
১৮ই আগস্ট
২০২৫