গল্পকার
একটি ভালো জীবনী মৃত মানুষকে সংরক্ষণ করে না, জীবন্ত করে তোলে। অন্য জীবনের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার যে অনুশীলন, তাতেই পাঠকের নিঃসঙ্গতা সাময়িকভাবে মুছে যায়।
কেউ কেউ স্মৃতির ভিতর থেকে বিশ্ব নির্মাণ করে, আর কেউ কেউ সেই বিশ্বে হাঁটে যতক্ষণ না হাঁটাটাই তাদের গল্পে পরিণত হয়। রবার্ট লুই স্টিভেনসন ছিলেন দ্বিতীয় দলের মানুষ; যিনি কোথাও পৌঁছানোর জন্য নয়, বরং চলার মধ্যেই জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন।
লিও ড্যামরশের “Storyteller” পড়তে পড়তে মনে হলো, অস্থিরতার মধ্যে থেকেও শব্দে আস্থা রাখার যে সাহস, সেটিই তো লেখকের সত্যিকারের পরিচয়। লিও ড্যামরশের আলোচনা করেছেন—ভক্তির দৃষ্টিতে নয়, এক অনুরাগী পাঠকের মতো। তাঁর চোখে স্টিভেনসন কোনো সাহিত্যিক দেবতা নন, বরং এক কৌতূহলপ্রবণ সহযাত্রী, যিনি জীবনের চলমানতাকেই নৈতিকতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
অসুস্থ শরীর, অনিশ্চিত স্বাস্থ্য, এক মহিলার ভালোবাসায় প্রাণ খোঁজা—স্টিভেনসনের জীবনে স্বস্তি ছিল বিরল, কিন্তু গল্প ছিল চিরস্থায়ী। সামোয়ানরা তাঁকে ডেকেছিল “তুসিতালা”—অর্থাৎ গল্পবলা মানুষ। যুদ্ধরত উপজাতিদের মধ্যেও তাঁর ঘরটিকে অক্ষত রাখার আদেশ ছিল—এইটুকু শান্তির পরিধি, যা ভাষা ও শ্রুতির জগতে গড়ে ওঠে। আমার কাছে এই তথ্যটি এক নীরব শ্রদ্ধার মতো জেগে থাকে, মানুষ ও কাহিনির মাঝে।
একটি ভালো জীবনী মৃত মানুষকে সংরক্ষণ করে না, জীবন্ত করে তোলে। অন্য জীবনের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার যে অনুশীলন, তাতেই পাঠকের নিঃসঙ্গতা সাময়িকভাবে মুছে যায়। স্টিভেনসনের গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়, ভ্রমণ কখনো পলায়ন নয়; বরং জীবনকে মনোযোগ দিয়ে দেখা।
ড্যামরশের বইটির মজাটাই এখানে, তিনি দেখিয়েছেন—স্টিভেনসনের জীবনকে তাঁর বাক্য থেকে আলাদা করা যায় না। Travels with a Donkey in the Cévennes কেবল ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, এটি এক গতিশীল দর্শন; Treasure Island কেবল রোমাঞ্চ নয়, এটি স্বাধীনতা ও আনুগত্যের নৈতিক পরীক্ষা; আর Dr. Jekyll and Mr. Hyde আজ পড়লে মনে হয়, এটি যেন অনলাইন যুগের দ্বিখণ্ডিত সত্তার ভবিষ্যদ্বাণী। সম্মানজনক প্রোফাইলের নিচে চাপা পড়া অন্ধ ক্রোধের উপাখ্যান।



এই বইয়ের কেন্দ্রে আছেন ফ্যানি অসবর্ন—দশ বছরের বড়, আমেরিকান, ডিভোর্সি, অদম্য এক নারী । তিনি ছিলেন স্টিভেনসনের ঝড়ে নোঙর, তাঁর বোহেমিয়ান জীবনকে মাধুর্যে রূপান্তরিত করা সহযাত্রী। ড্যামরশ তাঁকে পুনরুদ্ধার করেছেন কোনো পরিচর্যাকারী হিসেবে নয়, বরং সহযাত্রী হিসেবে; যিনি গল্পের পাশাপাশি স্টিভেনসনের খসড়া সম্পাদনা করতেন। ফ্যানি ছাড়া তিনি তুসিতালা হতেন না।
ড্যামরশের জীবনীটির প্রতি শ্রদ্ধা মন ভরে গেলো। তিনি কোনো মহামানব তৈরি করেননি। তিনি স্টিভেনসনকে দেখিয়েছেন কর্মরত লেখক হিসেবে—যিনি বিশ্বাস করতেন আনন্দও একপ্রকার প্রতিরোধ। স্টিভেনসনের অন্ত্যেষ্টিতে সামোয়ান প্রধানের উক্তি—“The day was no longer than his kindness”।
ড্যামরশের লেখায় যে গভীর মানবিকতা, তা জীবনীকে গসিপ নয়, পুনর্জীবন হিসেবে দেখে। রিচার্ড হোমসের এক উক্তি—“a handshake across time”—যথার্থ কিছু হতে পারে না। এক ভালো জীবনী লেখক প্রকাশ করেন না, তিনি শোনেন।
আমরা এখন এমন এক সংস্কৃতিতে বাস করি, যেখানে অস্থিরতা যেন অপরাধ। আমরা ধীর স্থির লেখকদের পুরস্কৃত করি, ভবঘুরে শিক্ষানবিশকে নয়। অথচ স্টিভেনসন স্মরণ করিয়ে দেন; সাহিত্যের জন্ম হয় চলার মধ্যে, স্থিরতা অস্বীকারে। তিনি নিজেকে বলেছিলেন traveler, কখনো tourist নন; বলেছিলেন আমি storyteller। আর এই ছোট পার্থক্যটাই আসলে সমস্ত পার্থক্যের উৎস।
স্টিভেনসন নিজেই লিখেছিলেন, “For my part, I travel not to go anywhere, but to go।” এই এক বাক্যে লেখার সম্পূর্ণ দর্শন লুকিয়ে আছে—গন্তব্য নয়, পথই আসল। তাই তাঁর Treasure Island আজও পড়লে মনে হয়, এটি বাস্তব ও কল্পনার মাঝখানের চিত্র; যেখানে প্রতিটি দ্বীপই আকাঙ্ক্ষার নাগালে।
রিচার্ড হোমস একবার বলেছিলেন; “He was the man who opened the magic door।” সেই দরজা খোলা থাকে যতক্ষণ পাঠক পড়ে, ভাবতে থাকে, ঘুরে বেড়ায়, এবং বিশ্বাস করে। শব্দ এখনও পৃথিবীকে বিস্ময়ে বড় করে দেখাতে পারে।
স্টিভেনসনের শেষ কবিতা Requiem, পড়লে মনে হবে জীবনের পরম সত্য সমাপ্তি নয়, এক যাত্রার প্রস্তুতি—
Under the wide and starry sky,
Dig the grave and let me lie.
এক শিল্পীর স্বীকারোক্তি যে মৃত্যুও এক নতুন ভ্রমণ। এই দৃষ্টিতে স্টিভেনসন আজও আধুনিক—চিরপ্রস্থানরত, চিরঅসমাপ্ত। তাই বলি এই চলার মধ্যেই তো গল্প। আজ এইটুকুই, প্রণাম।
Storyteller: The Life of Robert Louis Stevenson — লিও ড্যামরশ (ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২৫)




