মঈনুল আহসান সাবের: নগরচেতনার সাহিত্যরূপ ও ছোটগল্পের অন্তর্গত ব্যাকরণ
মঈনুল আহসান সাবের কেবল একজন কথাকার নন, তিনি নাগরিক চেতনার এক অনিবার্য ভাষ্যকার।
বাংলা ছোটগল্পের সমকালীন ভূচিত্রে মঈনুল আহসান সাবের যেন এক নগরের ভূস্বামী, যিনি তাঁর নিজস্ব ভাষা, অনুভব ও অভিজ্ঞতায় নগরকে পাঠ করেছেন, আবার নগরের মধ্যবিত্ত মানসকে শোনার ভাষা দিয়েছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই পর্যালোচনা কেবল একজন কথাসাহিত্যিকের সৃজনীভূমি চেনা নয়, বরং সমগ্র নাগরিক মনস্তত্ত্ব ও আমাদের সাহিত্যে নগরবোধের স্বরূপ উদ্ঘাটনের একটি প্রচেষ্টা।
তাঁর সাহিত্য-অভিষেক এমন এক যুগে যখন বাংলা ছোটগল্পে শহরের অস্তিত্ব থাকলেও নগরচেতনার ধ্বনি দুর্বল, গ্রামফেরত মানুষের স্মৃতির ছায়া তখনও ঘিরে আছে নাগরিক বসতি। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে সদ্য পলায়িত এই নগর এখনও পুরনো মূল্যের বিষণ্ন পাঠশালা। অগ্রজ লেখকদের মধ্যেও যারা শহর নিয়ে লিখেছেন, তাঁরাও অনেকাংশে লিখেছেন গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের চোখ দিয়ে—নগর ছিল এক মানসিক নস্টালজিয়া, বাস্তব নয়। সেই দোদুল্যমান প্রেক্ষিতে তিনি এলেন শহরের ভিতর থেকেই, শহরের ঘাম আর ধুলো, বিভ্রান্তি আর বেদনা নিয়ে। ফলে তাঁর বয়ান, তাঁর গল্প একেবারে অন্য রকম।
তাঁর গল্প জড়ো করে এক নগরমননের প্রতিসংস্কৃতি, যেখানে মধ্যবিত্ত জীবনের অনিবার্য ক্লান্তি, জীবনের ফাঁপা অভ্যেস আর অভিপ্রায়হীন গতি নিয়ে গভীর অনুশোচনায় পাঠককে স্থির করে দেন। তিনি এসব জানান উচ্চকণ্ঠে নয়, বরং এক নির্মোহ স্বরে—যেন কাঠফাটা রোদে কেউ হেঁটে যায় ছায়াহীন পথে। সরল বাক্যে তিনি যে জটিল অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে যান, তা আমাদের সমাজ-মানসের ভেতর গহীন শূন্যতার দিকে চোখ ফেরায়। তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে নগরমনন মানে কেবল উচ্চবিত্ত নাগরিকতা নয়, বরং শহরের মধ্যে গড়ে-ওঠা মানুষের এক অন্তর্মুখিনতা, আত্মপরীক্ষা ও মরচে-ধরা স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর লেখায় গ্রামের প্রতি কোনো আবেগময় টান নেই; গ্রাম নেই বলে তাঁর গল্প ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বরং, এই বিচ্ছিন্নতাই তাঁর চিন্তায় একটি নির্লিপ্ত সমকাল এনে দেয়। তিনি মনে করেন—আগামীকাল যে নগর আমাদের গ্রাস করবে, সেখানে মধ্যবিত্ত মানুষের দোলাচলই হবে সবচেয়ে প্রকাশ্য নাটক। তিনি মধ্যবিত্তকে কেবল একটি শ্রেণি হিসেবে দেখেন না, বরং এক অস্তিত্বগত বিপন্নতায় থাকা মানুষের মুখচ্ছবি হিসেবে স্থাপন করেন। ফলে তাঁর গল্প হয়ে ওঠে এক সামাজিক প্রতিবিম্ব, যেখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র—এই ত্রিভুজে আমরা নিজের ছায়া দেখতে পাই।
তাঁর গল্পের গহীনে জায়গা করে নেয় মুক্তিযুদ্ধ—কখনো সরাসরি, কখনো প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। তবে যুদ্ধ তাঁর গল্পে কেবল অতীত স্মৃতি নয়, বরং একটি মূল্যবোধের বিচ্ছুরণ। যুদ্ধোত্তর সমাজে যে দুর্নীতি, হতাশা, বিশ্বাসঘাতকতা দেখা যায়—সাবের তা নির্ভুলভাবে ধরেন। এই প্রসঙ্গে তিনি কখনো চরিত্রকে কেন্দ্র করেন, কখনো ঘটনাকে, আবার কখনো সময়কেই প্রধান চরিত্র করে তোলেন। তাঁর গল্পে স্বাধীনতা যেন হারিয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতির মতো ফিরে ফিরে আসে—হৃদয়ের গভীর ক্ষতচিহ্নে।
প্রকৃতি সাবেরের গল্পে অনুষঙ্গমাত্র নয়, এটি চরিত্রের রূপও ধারণ করে। তাঁর প্রকৃতি রোমান্টিক নয়, বরং আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এক কার্যকর বাস্তবতা—যেখানে প্রকৃতি কখনো গল্প চালায়, কখনো পটভূমি নয়, বরং অন্তর্লীন উপলব্ধির স্থান। তাঁর গল্পে দোয়েল বা ফড়িং কেবল প্রাণী নয়, তারা প্রতীক, তারা আবহ, তারা পরিবেশ এবং শেষমেশ তারা পাঠকের একার বোধ।
তাঁর গল্পকে বিশিষ্ট করে তোলে তাঁর নির্মাণ-কৌশল—যেখানে ভাষা হয়ে ওঠে ভাবনার বাহন, আর দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠে জীবনের ব্যাখ্যান। তিনি জীবনকে কেবল বর্ণনাই করেন না, তিনি তাকে বিশ্লেষণ করেন, আর সেই বিশ্লেষণেও থাকে এক গভীর মানবিকতা, এক সংবেদনশীল আত্মবীক্ষা। তাঁর গল্পের পরতে পরতে এই জীবনদর্শন ফুটে ওঠে। মৃত্যুকে নিয়ে তিনি যতটা বলছেন, তার চেয়ে বেশি বলছেন জীবনের নিরর্থকতা ও সম্ভাবনাহীনতার কথা। জন্ম-মৃত্যুর বাইরের এক অস্তিত্ব-বোধ তৈরি করেন তিনি—যা গল্পকে পরিণত করে জীবন-উপপনিষদে।
শেষ পর্যন্ত মঈনুল আহসান সাবের কেবল একজন কথাকার নন, তিনি নাগরিক চেতনার এক অনিবার্য ভাষ্যকার। আমাদের সাহিত্যে যেখানে নগর মানেই স্মৃতির গহ্বর, সেখানে সাবের নগরকে বর্তমানের তীব্র অভিজ্ঞতা হিসেবে স্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন—নগরমনন মানে ভবিষ্যতের অপেক্ষা নয়, বরং বর্তমানের গভীর পরিসমাপ্তি। তাঁর গল্পগুলো যেন নগরের আয়নার মতো, যেখানে পাঠক দেখেন নিজেরই দোদুল্যমানতা, ক্লান্তি আর ক্ষয়। তাই একদিন না একদিন আমাদের ফিরে যেতে হবে সাবেরের গল্পে, কারণ সেইখানেই আছে জীবনের উন্মুক্ত প্রান্তর, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি: নাগরিক হওয়া মানে কেবল ঠিকানা পাওয়া নয়, বরং নিজের ভেতরের আলস্য, অসহায়তা ও প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া।
পড়ে দেখার জন্য ধন্যবাদ । আপনার ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলবেন না—মন্তব্য করুন। আমার লেখালেখিকে সহায়তা করতে চাইলে আপনি একজন ফ্রি কিংবা পেইড সাবস্ক্রাইবার হিসেবে যুক্ত হতে পারেন।