বইপাঠের অদৃশ্য সুপারপাওয়ার - রিটন খান
বইয়ের পাতায় আমরা যা পাই, তা ছবির মতো তৎক্ষণাৎ নয়, কিন্তু তা বহুদিন ধরে আমাদের মধ্যে থেকে যায়। এই ক্ষমতা হলো আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সুপারপাওয়ার।
আমরা এক অভূতপূর্ব ডিজিটাল যুগে বাস করছি, যেখানে চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে নতুন নতুন ভিডিও, এবং ছবি। কিন্তু এই চিত্র-নির্ভর সংস্কৃতির মাঝেও, কিছু শক্তি রয়েছে যা সময়ের সাথে সাথে আমাদের সঙ্গে থেকে যায়—তা হলো বই ও পাঠের ক্ষমতা। বই পড়ার অভিজ্ঞতাটি এক ধরণের সুপারপাওয়ার, যা আমরা ছোটবেলা থেকে অর্জন করি এবং জীবনভর বহন করে চলি।
আমি নিজেই সময়ের চাকা ঘুরিয়ে আমার শৈশবে ফিরে গিয়েছি। তখন আমার নিজের জীবনে বইয়ের গুরুত্ব কতটা ছিল, তা আবারও মনে পড়ে। আমি ছোটবেলায় বইয়ের ভেতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। বই পড়া এক ধরণের টেলিপোর্টেশনের মতো, যেখানে আমরা এক মুহূর্তে হাজার মাইল দূরে চলে যেতে পারি—তা আমার জীবনেও সত্যি ছিল। প্রতিটি বই যেন আমাকে নিয়ে যেত এক নতুন দুনিয়ায়, যেখানে আমি নতুন মানুষের জীবন, ভাবনা আর সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারতাম।
কিন্তু পাঠ শুধু মাত্র দূরবর্তী স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার নয়। এটি আমাদের সামনে এক বিশাল বিশ্ব উন্মোচন করে দেয়—বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনিষীদের চিন্তা, তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাদের মস্তিষ্কে সরাসরি চলে আসে। বই হলো সেই জাদুকরী মাধ্যম, যার মাধ্যমে আমরা অন্যের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে পারি, নিজেদের অজ্ঞতা থেকে রক্ষা পেতে পারি। জ্ঞান অর্জনে এবং ধারণ করতে, বইয়ের বিকল্প কোনো মাধ্যম নেই। ছবির দুনিয়ায় আমরা কতটুকু দেখতে পারি? কিছু বিষয় আছে যেগুলো কোনো ছবির মাধ্যমে ধরা যায় না—বুদ্ধি, যুক্তি, ধারণা, গণিত, এবং যুক্তির সেই সূক্ষ্ম কাঠামো। এগুলো আমরা শুধু ভাষার মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারি, আর সেই ভাষার শক্তি আসে পাঠ থেকে।
এই যে বইয়ের শক্তি, এটি শুধু জ্ঞানার্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের আবেগ, কল্পনা, এবং সম্পর্কের জগতে নিয়ে যায়। আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে যখন প্রথমবার “কাবুলিওয়ালা” গল্পটি পড়েছিলাম, রবি ঠাকুরের সেই অমর সৃষ্টি। সেই গল্পের মাধ্যমে আমি ছোট্ট মিনির সঙ্গে আফগানি কাবুলিওয়ালার সম্পর্কের গভীরতা অনুভব করতে পেরেছিলাম। আজও সেই গল্প আমার মনের কোণে জ্বলজ্বল করে, যেন বাস্তব জীবনেও এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, যা ভাষা, সংস্কৃতি, এবং সময়ের সীমানা অতিক্রম করে।
আমাদের এই চিত্র-নির্ভর দুনিয়ায়, যেখানে ভিডিও এবং ছবি প্রতিনিয়ত আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, বই পড়ার অভ্যাসটা যেন আরও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছে। বইয়ের পাতায় আমরা যা পাই, তা ছবির মতো তৎক্ষণাৎ নয়, কিন্তু তা বহুদিন ধরে আমাদের মধ্যে থেকে যায়। এই ক্ষমতা হলো আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সুপারপাওয়ার। বই পড়া শুধু আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ায় না, বরং এটি আমাদের মানবিক করে তোলে, অন্যের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হতে শেখায়, আমাদের নিজের ভুল থেকে রক্ষা করে, আর অজানাকে আলোকিত করে।
তাই, আমি যখন বই হাতে তুলে নেই, তখন মনে হয় যেন আমি এক সুপারপাওয়ার অনুভব করছি—এই ক্ষমতা, যা আমার জীবনকে নতুনভাবে রচনা করতে সাহায্য করবে।