আফগানিস্তান: গুলি আর বোরকার প্রেমকাহিনি
এক নারী অধিকারকর্মী, এক আইনশিক্ষার্থী ও এক তালিবান কমান্ডারের জীবনের ভেতর দিয়ে আসনে সিয়েরস্তাদের দ্য আফগানস বইটি দেখায়—স্বপ্ন, যুদ্ধ আর লোককথার মিশ্রণ।
আসনে সিয়েরস্তাদের The Afghans পড়া যেন পুরনো কাবুলের সরু গলির ভেতর দিয়ে হাঁটা—যেখানে একদিকে জারদোজি কাজ করা চাদর উড়ছে, আর অন্যদিকে ট্যাংকের মরচে ধরা দাগ। আফগানিস্তানকে আজকাল খবরের শিরোনামে খুঁজলে যা পাওয়া যায় তা মূলত অনুপস্থিতি। ২০২১ সালের আগস্টে তালিবান যখন আবারও রাজধানী দখল করল, তখন বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরাগুলো যেন একসঙ্গে হাই তুলে সরিয়ে নেওয়া হল। পশ্চিমা দুনিয়া আফগানিস্তানের ওপর থেকে হাত ধুয়ে নিল, সঙ্গে আফগান মহিলাদের সেই ক্ষণিকের স্বপ্নও ভেঙে পড়ল—যে স্বপ্নে তারা নিজেরা পছন্দমতো পড়তে, কাজ করতে, এমনকি কফিশপে বসে ক্যাপুচিনো খেতে পারত।
এই বিস্মৃতির প্রেক্ষিতেই সিয়েরস্তাদের প্রায় ৪৩০ পাতার বইটি গুরুত্বপূর্ণ। লেখিকা আগেও যুদ্ধক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বেস্টসেলার লিখেছেন (The Bookseller of Kabul মনে আছে তো?), আর এখানে তিনি এক অদ্ভুত মিশ্রণ এনেছেন—ঐতিহাসিক আখ্যান, অন্তরঙ্গ চরিত্রচিত্রণ আর সাংবাদিকতার গোপন কৌশল। আফগান ঘরে ঢোকা সহজ নয়; এখানে পুরুষেরা স্ত্রীর নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতেও কুণ্ঠিত। তবু সিয়েরস্তাদ এমন অন্তরঙ্গতা পেয়েছেন, যা এক ধরনের সাংবাদিক সৌভাগ্য।
বইয়ের নাটকীয়তা তিনটি চরিত্রের জীবনের চারপাশে ঘোরে। জামিলা—এক সময়ের প্রাণবন্ত নারী অধিকারকর্মী, জন্মেছিলেন সোভিয়েত আগ্রাসনের আগেই; শরীরে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তিনি শিক্ষিত হয়েছেন, এনজিও বানিয়েছেন, নারীদের ক্ষমতায়ন করেছেন। আরেক প্রান্তে আছেন আরিয়ানা—২০০০ সালের দোরগোড়ায় জন্ম নেওয়া তরুণী, আইন পড়ছেন, বিচারকের স্বপ্ন দেখছেন; তালিবান ফেরার পর তাকেও সেই চিরন্তন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে—থাকব, না পালাব? তৃতীয় চরিত্রটি সম্পূর্ণ অন্য মেরুর—বশির, তালিবান কমান্ডার, যিনি প্রথমে জিহাদের রোমাঞ্চে মত্ত, পরে স্ত্রী, সন্তান আর শান্তি-পরবর্তী নতুন ভূমিকা নিয়ে হাল ধরতে হয়।
এই তিনজনের গল্পে জুড়ে আছে চার দশকের আফগান উথালপাথাল: সোভিয়েত আক্রমণ, আমেরিকা-সমর্থিত প্রতিরোধ, গৃহযুদ্ধ, তালিবানের প্রথম উত্থান, ৯/১১-পরবর্তী মার্কিন প্রত্যাবর্তন এবং অবশেষে ২০২১-এর পতন। সিয়েরস্তাদ চমৎকার দেখিয়েছেন, ২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত কাবুল ছিল এক অদ্ভুত পরীক্ষাগার। ছেলেরা বলিউড নাচে, মেয়েরা বোরখা ছাড়ে, আর পশ্চিমা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো শহরটাকে এক রকমের চকচকে স্বপ্নে মুড়িয়ে রাখে। কিন্তু সেই স্বপ্নের মেয়াদ ফুরিয়েছে।
সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অংশ শুরু হয় ২০২১-এর পর, যখন বিদেশি সাংবাদিকরা প্রায় গায়েব, আর সিয়েরস্তাদ দেশে ঢুকে সরাসরি জীবনযুদ্ধের পরিবর্তিত রূপ দেখেন। বইয়ের চল্লিশ শতাংশই এই অধ্যায়, যেখানে ইতিহাসের গরম ভাতের ধোঁয়া এখনও বাতাসে। কিন্তু পড়তে পড়তে একধরনের সংশয়ও আসে। এই বর্ণনা যে মূলত মানুষের মুখে শোনা গল্পের ওপর দাঁড়ানো, তা লেখিকা নিজেই শেষ অধ্যায়ে স্বীকার করেছেন। বশিরের বীরত্বগাথা, বা জামিলার জন্মের আগের প্রেমকাহিনি—সবই শোনা কথা। আফগানিস্তানের লোককথার ধারা এমনই যে, বাড়তি রঙ চড়ানো প্রায় নাগরিক কর্তব্য। একজন তালিবান কমান্ডার নিজের গল্পে হিরো না হলে আর কে হবে?
সিয়েরস্তাদের আগের বইও মনে করিয়ে দেয়—The Bookseller of Kabul—যা যেমন প্রশংসিত হয়েছিল, তেমনি বিতর্কে জড়িয়েছিল লেখিকাকে। চরিত্রের গোপনীয়তা ভঙ্গ, জীবনের রসালো দিক প্রকাশ—এগুলো তাঁর লেখনির ট্রেডমার্ক, যা বইকে পাঠযোগ্য করে, আবার খানিকটা অস্বস্তিকরও।
The Afghans—এখানে যুদ্ধ, প্রেম, স্বপ্ন, আর লাশের গন্ধ মিশে আছে। পড়তে ভালো লাগবে, কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, গল্পের অর্ধেকই শোনাশোনা। আফগানিস্তান নামের এই অন্তহীন উপত্যকায়, বাস্তব আর কল্পনার সীমানা অনেক আগেই তালিবানের বুলেটের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে।
THE AFGHANS: Three Lives Through War, Love, and Revolt | By Asne Seierstad | Bloomsbury | 428 pp. | $35