অদৃশ্যের দিনলিপি - ইবতিসাম আজেম
শুধু ফিলিস্তিনিরা নেই। এই উপন্যাসের মূল প্রশ্নটাই যেন এক দুঃস্বপ্নের চিত্রনাট্য—যদি হঠাৎ করেই সব ফিলিস্তিনি হারিয়ে যায়, তাহলে কী হবে?
বইচর্চা
রিটন খান
"মানুষগুলো সব হাওয়া হয়ে যায় এক অদৃশ্য জাদুর ফাঁদে,
মানচিত্রের রেখায় নয়—অদৃশ্য কালিতে লেখা তাদের গল্প।"
নীল রঙের আকাশ, ক্লান্ত মানুষের মুখ, রাস্তার ধারে জমে থাকা বৃষ্টির জল, দোকানের ঝুলন্ত নীল ব্যানার—সবকিছুই যেমন থাকার কথা, তেমনই আছে। শুধু ফিলিস্তিনিরা নেই। এই উপন্যাসের মূল প্রশ্নটাই যেন এক দুঃস্বপ্নের চিত্রনাট্য—যদি হঠাৎ করেই সব ফিলিস্তিনি হারিয়ে যায়, তাহলে কী হবে?
প্রথমেই বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শূন্যতা টের পেলাম। মনে হলো, এ তো নিছক কল্পনা নয়, বরং এমন এক বাস্তবতার ছায়া, যা অস্বাভাবিক হলেও অসম্ভব নয়। যুদ্ধের বাজারে দখলদারিত্বের যে নির্মম মুনাফা চলে, তাতে এই প্রশ্নটা অবান্তর নয়। জাতিরাষ্ট্র, সামরিক শক্তি আর উপনিবেশবাদ যখন হাতে হাত মিলিয়ে নতুন বিশ্বের নকশা আঁকে, তখন সেখানে গোটা একটা জনগোষ্ঠীর মুছে যাওয়াটা নিছক ভুলে যাওয়া কোনো নামের মতোই স্বাভাবিক মনে হতে পারে।
আর আমরা? আমরা সেই স্বাভাবিকতার নিচে চাপা পড়তে পড়তে ভাবব—এতো অদ্ভুত! নীল আকাশের নিচে সব ঠিকঠাকই তো আছে, শুধু একটা জনগোষ্ঠী নেই। প্রশ্ন হলো, ওরা গেল কোথায়? আর এই প্রশ্নটাই হয়তো একদিন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
একটা উপন্যাস, যা সায়োনিস্ট প্রকল্পের গোপন আকাঙ্ক্ষাকেই বাস্তবের রূপ দিতে চায়! কী অদ্ভুত, কী ভয়ঙ্করভাবে সুপরিকল্পিত! আমি খুব ভালো করেই জানি, আমেরিকায় কেমন গল্প বিক্রি হয়, কীভাবে বলতে হয় ফিলিস্তিনিদের কথা—ঠিক কতটা সংযত, কতটা পালিশ করা, যেন তাদের সত্যটা খুব বেশি কর্কশ শোনায় না। যেন তারা নিছক এক ব্যাকগ্রাউন্ড ন্যারেটিভ হয়ে থাকে, মূল চরিত্র নয়। এখানে গল্প বলতে গেলে শব্দগুলোকে এমনভাবে সাজাতে হয় যেন তারা কাঁচের গ্লাসের মতো টলে না পড়ে, টুকরো টুকরো হয়ে না যায়, কারও আরামের গালিচায় পা কেটে না ফেলে।
একটা সময় ছিল, যখন আমরা ভাবতাম, আমাদের অস্তিত্বের শেষ আশ্রয় হয়তো আমাদের গল্পই। যতক্ষণ আমরা নিজেদের কাহিনি বলতে পারছি, ততক্ষণ আমরা আছি। কিন্তু যদি আমাদের গল্পই মুছে দেওয়া হয়? যদি একদিন নতুন ইতিহাস লেখা হয়, যেখানে আমাদের নামটাই অনুপস্থিত? যদি একদিন দেখানো হয় যে আমরা আদৌ কখনও ছিলাম না?
নীল আকাশের নিচে তখন সব ঠিকঠাকই থাকবে। শুধু আমরা থাকব না।
প্রথম যখন বইটা হাতে নিলাম, বুকের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি চেপে বসল। এমন একটা গল্প কি সত্যিই বলা দরকার? ফিলিস্তিনহীন এক ফিলিস্তিনের কথা ভাবতে হবে কেন? যেন কল্পনার নামে কোনো পৈশাচিক খেলা চলছে!
প্রথমে মনে হলো, এই বই পড়ার চেয়ে বরং দাঁতের ডাক্তার দেখানো ভালো, অন্তত ব্যথাটা বাস্তব হবে। কিন্তু যত এগোতে লাগলাম, ততই বুঝলাম, আমি আসলে ভুল পথে হাঁটছিলাম। ইবতিসাম আজেম একের পর এক বেলুন ফাটাচ্ছেন—তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টা? তথাকথিত ‘উদার সায়োনিজম’। এতদিন ধরে আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, হয়তো কোনো ভারসাম্য আছে, হয়তো সহাবস্থান সম্ভব, হয়তো ‘শান্তিপূর্ণ সমাধান’ বলে একটা জিনিস থাকতে পারে।
আসলে আমরা শিশুদের জন্য লেখা নীতিকথার গল্প পড়ছিলাম, আর সেই গল্পের পাতা উল্টে দেখলেই বোঝা যায়, নিচে ছোট্ট অক্ষরে লেখা—"Terms and conditions apply"।
কিন্তু ইবতিসাম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, এই গোটা সহাবস্থান তত্ত্বই আসলে সাদা পোশাকে উপনিবেশবাদ। নরম গালভরা শব্দের আড়ালে সেই একই নিষ্ঠুর মতাদর্শ, যা একদিন ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উপড়ে ফেলেছিল, আজও টেনে নিয়ে যাচ্ছে—নতুন চেহারায়, নতুন মোড়কে, কিন্তু পুরোনো নিষ্ঠুরতায়। ঠিক যেন ঔপনিবেশিক হিংসার একটা limited edition সংস্করণ, যেখানে বন্দুকের জায়গায় কূটনীতি, ট্যাংকের বদলে শান্তিচুক্তি, কিন্তু ফলাফল একটাই—ফিলিস্তিনি নেই, অথচ ফিলিস্তিনের নাম রয়ে গেছে।
The Book of Disappearance যেন এক ছড়িয়ে থাকা আর্তনাদ, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর একসঙ্গে বুনে যায়, কিন্তু কথোপকথনটা থেকে যায় অসমাপ্ত। প্রতিটি চরিত্র যেন একেকটা শূন্যতার প্রতিনিধি—কারও ঘর নেই, কারও ইতিহাস নেই, কারও অস্তিত্বই নেই। এমনকি গল্পের মধ্যেই গল্প হারিয়ে যায়, যেন লেখকের হাত থেকে চরিত্রগুলোই ফসকে যেতে বসেছে—একটা নিখুঁত উপমা, যদি ভাবতে চান কীভাবে একটা জাতিকে কাগজের কলমের খোঁচায় "তথ্যের গণ্ডগোল" বলে মুছে ফেলা যায়!
গল্পের কেন্দ্রে আছে আলা, যে তার ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতায় ঠাঁই দেয় দাদির স্মৃতিচারণ—এক হারানো ফিলিস্তিন, ১৯৪৮-এর আগের দিনগুলো। দাদির গল্পের ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠে এমন এক বাস্তব, যা আজকের ইতিহাস বইয়ের পাতায় চাপা পড়ে গেছে। আবার আছে আরিয়েল, আলার তথাকথিত ‘উদার সায়োনিস্ট’ বন্ধু, যে ফিলিস্তিনিদের হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা চালায়—এক ধরনের পেশাদার অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, যেন এটি নিছক এক রহস্য, কোনো ব্যক্তিগত অনুশোচনা নয়।
এর ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের আরও কিছু ছেঁড়া-ছেঁড়া মুহূর্ত—কীভাবে তারা এই শূন্যতাকে বয়ে বেড়াচ্ছে, কীভাবে এক জাতির অনুপস্থিতি শুধুই এক শূন্যতা হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে এক ধ্বংসস্তূপ, যার ভেতর চাপা থাকে মুছে যাওয়া নাম, ফেলে আসা কণ্ঠস্বর, আর এক গোপন ইতিহাস, যা কেউ স্বীকার করতে চায় না।
ইবতিসাম তাঁর উপন্যাস সাজিয়েছেন একধরনের সাংবাদিকসুলভ কৌশলে—একটা বস্তুনিষ্ঠতার মুখোশের আড়ালে, যা আসলে আদৌ নিরপেক্ষ নয়। এই স্টাইলটাই অসাধারণ, কারণ এখান থেকেই তিনি তাঁর আসল কাজটা করেন।
ফিলিস্তিনিরা যখন এক ঝটকায় উধাও হয়ে যায়, তখন ইসরায়েল একরকম বিশুদ্ধ অথচ ভয়ংকর ফ্যাসিবাদে ডুবে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে আতঙ্ক, অস্বস্তি, আর নিয়ন্ত্রণের নতুন নতুন মাত্রা তৈরি হয়। এমনকি, সেই নিয়ন্ত্রণ এতটাই সরাসরি, এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, একসময় তা প্রায় হাস্যকর বলে মনে হতে পারে—যদি না বিষয়টা এত নির্মমভাবে বাস্তব হত!
ইবতিসামের নৈর্ব্যক্তিক ভাষার এই নির্মোহ ভয়াবহতাই গল্পটাকে আরও গভীর করে তোলে। কারণ, এখানে কোনো অতিরঞ্জন নেই, নেই কোনো প্রচলিত আবেগের অতিসরলীকরণ। বরং তিনি দেখান কীভাবে নিপীড়করা, শিকারীদের মতো, নিজেদের উপস্থিতিকেই সবচেয়ে বড় সত্য হিসেবে তুলে ধরে। এই উপন্যাস তাই শুধু ফিলিস্তিনের অনুপস্থিতি নিয়ে নয়—এটি মূলত সেই ফাঁপা কাঠামোর গল্প, যেখানে নিপীড়কের ভয় ক্রমশ নিজের আত্মপরিচয়ের ভীতিও কাঁপিয়ে তোলে।
গল্পটা শুরু হয় আলা আর তার দাদিকে নিয়ে। দাদি সেই পুরোনো জাফার কথা বলেন—নাকবার আগের সময়টা, যেন একধরনের মায়াময় স্মৃতি, যেখানে প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঘর তখনো তার আপন পরিচয়ে অক্ষত ছিল। দাদির গল্পে ফুটে ওঠে সেই হারানো শহর, যা শুধু একটি ভৌগোলিক অবস্থান নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস, যার প্রতিটি ইট-পাথরে ফিলিস্তিনের শিকড় গাঁথা।
Palestine Writes Literature Festival-এ ইবতিসাম ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন তিনি এভাবেই উপন্যাস শুরু করেছেন—যাতে করে, গল্পের কেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের অনুপস্থিতি থাকলেও, তাদের কণ্ঠস্বর যেন হারিয়ে না যায়। তিনি শুধুমাত্র ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়ার বৃত্তে আটকে থাকতে চাননি; বরং প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব, তাদের গল্প, তাদের ইতিহাস।
এই কৌশলটাই ইবতিসামের উপন্যাসকে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে। কারণ, নিছক শোক কিংবা শূন্যতার আখ্যান না হয়ে, এটি হয়ে ওঠে এক স্মৃতির পুনর্নির্মাণ—যেখানে অনুপস্থিতিও একধরনের প্রতিরোধ। গল্পটি তাই নিছক ফিলিস্তিনিদের হারিয়ে যাওয়ার নয়, বরং তাদের অস্তিত্বকে পুনর্ব্যক্ত করার, তাদের কণ্ঠস্বরকে সেই শূন্যতার মধ্যেও স্পষ্ট শোনানোর এক গভীর প্রচেষ্টা।
এটাই বইটির সবচেয়ে বড় শক্তি বলে মনে হয়। ইবতিসাম আজেম এখানে দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যক্তিগত গল্পগুলোর সুতোর সঙ্গে বৃহৎ কাঠামোগত বাস্তবতা জড়িয়ে থাকে, আর সেই কাঠামো শেষ পর্যন্ত এক বৈশ্বিক বাস্তবতায় পরিণত হয়।
এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র যেন এক বৃহৎ ইতিহাসের ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি। দাদির স্মৃতিচারণ, আলার ডায়েরির ভেতরে হারানো ফিলিস্তিনের টুকরো টুকরো ছবি, কিংবা আরিয়েলের তথাকথিত বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান—সব মিলিয়ে এগুলো কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের চিরকালীন ছককেও উন্মোচিত করে।
ইবতিসামের কৌশল এখানে নিছক গল্প বলার নয়, বরং ইতিহাসের ভেতর থেকে গল্প তুলে আনার। তিনি দেখান, কীভাবে ব্যক্তিগত স্মৃতি, ক্ষুদ্রতর বেদনা, বা ব্যক্তিগত অস্তিত্বের সংকট আসলে এক বৃহৎ দখলদারি কাঠামোরই ছায়া। আর এই ছায়া শুধু ফিলিস্তিনের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একই রকম নিপীড়ন ও শূন্যতার চক্র তৈরি করে।
এই উপন্যাস শুধু এক অনুপস্থিত জাতির কথা নয়, বরং যে-কোনো উপনিবেশিত মানুষের গল্প, যে-কোনো মুছে ফেলা ইতিহাসের কথা বলে। ইবতিসাম এখানে শূন্যতাকে শুধু দুঃখের প্রতীক বানাননি—তিনি এটিকে এক প্রামাণ্য প্রতিবাদে পরিণত করেছেন।
গল্প যত এগোয়, আমরা জানতে পারি আলার দাদি মারা গেছেন। তারপর আসে সেই ভয়ংকর মুহূর্ত—যখন ফিলিস্তিনিরা হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। শহরজুড়ে আতঙ্ক, অস্বস্তি, বিশৃঙ্খলা। কিন্তু আসল ধাক্কাটা আসে তখন, যখন আরিয়েল খুঁজে পায় আলার ডায়েরি। এখান থেকেই কাহিনি বদলে যেতে থাকে।
এখন আমরা আলার চোখ দিয়ে দাদির গল্প শুনি, তবে সেটা তখনই, যখন আরিয়েল পড়তে চায়। যেন উপনিবেশবাদীর দয়ার ওপর নির্ভর করে নির্যাতিতের ইতিহাস টিকে থাকবে কি না! এই দৃশ্যকল্পটিই ইবতিসাম আজেম নির্মমভাবে তুলে ধরেন—যেখানে নিপীড়কের অনুমতি ছাড়া নিপীড়িতের কণ্ঠস্বরও প্রবাহিত হতে পারে না।
আরিয়েল চরিত্রটি এসেছে তথাকথিত ‘উদার সায়োনিজম’-এর ভেতরের ফাঁপা বাস্তবতা উন্মোচনের জন্য। সে নিজে কোনো বড় কাজ করে না, কিন্তু তার চিন্তার ভেতর দিয়েই ইবতিসাম দেখিয়ে দেন, এই ‘উদার’ মানসিকতা আসলে কতটা মিথ্যে। সে ফিলিস্তিনিদের হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনার ওপর গবেষণা চালায়, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও প্রশ্ন তোলে না সেই দখলদারি ব্যবস্থাকে, যার কারণে এই শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
আমি অনেক মানুষকে চিনি, যারা হয়তো আরিয়েলের মধ্যে নিজেদের ছায়া খুঁজে পাবে—যারা মনে করে, সরাসরি উপনিবেশবাদ সমর্থন না করলেই দায়মুক্তি পাওয়া যায়। অথচ তারা সেই ঔপনিবেশিক কাঠামোর বিরুদ্ধেও কখনো কথা বলে না। ইবতিসামের গল্পের ভেতর দিয়ে এই ভণ্ডামিটাই উন্মোচিত হয়—যেখানে এক পক্ষ চুপ করে থাকে, আর অন্য পক্ষ হারিয়ে যেতে থাকে, ঠিক যেন একটি ইতিহাসের ওপর আরেকটি ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ইবতিসাম এই চরিত্রকে ধাপে ধাপে গড়ে তুলেছেন। গল্পের শুরুতেই দেখি, এক জার্মান মেয়েকে নিয়ে আরিয়েলের বিরক্তি—মেয়েটি তার পূর্বপুরুষদের করা অপরাধের জন্য অপরাধবোধ অনুভব করে, আরিয়েল সেটাকে সহ্য করতে পারে না। তার মতে, মেয়েটি যেন অন্যের ট্রমাকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছে, এক ধরনের শুদ্ধির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা তার কাছে ভণ্ডামি মনে হয়।
এটাই সে আলাকে বলে, যদিও বোঝাই যায়, আলা এতে এতটুকু আগ্রহী নয়। বরং এই কথাগুলো বলার মধ্যে দিয়েই আরিয়েল নিজের অবস্থানকে আরও উন্মোচিত করে ফেলে—তার নিজের ট্রমা নেই, তাই অন্যের ট্রমাকে সে সন্দেহের চোখে দেখে। সে মনে করে, অপরাধবোধও যেন এক বিলাসিতা, যা ইতিহাসের বোঝা হিসেবে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর কাঁধেই পড়েছে।
আরিয়েলের ইংরেজ পরিচয়, আর তার পরিবার যে প্রথম দিকের ইসরায়েলি সেটলারদের মধ্যে ছিল, সেটাই তার বক্তব্যকে আরও সরাসরি ব্যঙ্গাত্মক করে তোলে। সে নিজেই এক ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে, অথচ জার্মান মেয়েটির অপরাধবোধ নিয়ে বিরক্ত হয়! যেন ইতিহাসের বোঝা বেছে বেছে কিছু মানুষের ওপরেই বর্তায়, আর অন্যরা নিজেদের দায়মুক্ত বলে ধরে নেয়।
ইবতিসাম ঠিক এইসব ছোট ছোট মুহূর্তের মধ্য দিয়েই চরিত্রটিকে চমৎকারভাবে ফাঁস করে দেন। সরাসরি উপনিবেশবাদ সমর্থন না করলেও, আরিয়েলের মতো মানুষের চিন্তার মধ্যে সেই একই কাঠামো সক্রিয় থাকে—নিজের অবস্থান স্বীকার না করে বরং অন্যের অপরাধবোধ নিয়ে ব্যঙ্গ করা। আর এখানেই ইবতিসামের চরিত্র গঠনের সূক্ষ্মতা—তিনি আরিয়েলকে সরাসরি দানব বানান না, বরং তার আত্মপ্রবঞ্চনাকে পাঠকের সামনে নিঃসঙ্কোচে মেলে ধরেন।
আমরা জানতে পারি, সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া নিয়ে কিছুটা দোটানায় থাকলেও শেষমেশ আরিয়েল সেটাতেই যোগ দেয়। কারণ? খুব সরল—ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে না গেলে তাকে জেলে যেতে হতে পারে। তাই সে নিজের জন্য একধরনের নৈতিকতা নির্মাণ করে নেয়—‘ভেতর থেকে কিছু পরিবর্তন আনার’ অজুহাত খাড়া করে সৈন্য হওয়ার পথ বেছে নেয়।
কিন্তু, যেই জার্মান মেয়েটিকে সে সহানুভূতির অভিনয় করার জন্য কটাক্ষ করেছিল, সে নিজেই ঠিক একইরকম অভিনয় করছে! তার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া কোনো আদর্শবাদী অবস্থান নয়, বরং কেবল নিজের সুবিধার জন্যই। তার ‘উদার সায়োনিজম’-এর মূল কথা আসলে নিজের অবস্থান অক্ষত রাখা, যেখানে অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো নয়, বরং অন্যায়কে এমনভাবে মেনে নেওয়া যাতে নিজের বিবেকও খুব বেশি অস্বস্তিতে না পড়ে।
একটা দৃশ্যে, তার সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় এক ফিলিস্তিনি শিশুকে। কিন্তু কিছুই পাল্টায় না। এই ঘটনাও তাকে বদলাতে পারে না, কারণ তার ‘ভেতর থেকে পরিবর্তন আনার’ প্রতিজ্ঞা আদতে ছিল এক ছলনা। ইবতিসাম নিশ্চিত করেন, আরিয়েল আসলে কোনো পার্থক্যই গড়ে তুলতে পারছে না। বরং সে সেই পুরনো কাঠামোরই আরেকটি চাকা, যা ঘুরতেই থাকে, থামে না, বদলায় না। তার উপস্থিতি একমাত্র তার নিজের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, দখলদারি ব্যবস্থার জন্য নয়।
এইভাবে ইবতিসাম দেখিয়ে দেন, কিছু মানুষ মনে করে তারা ন্যায়বিচারের পক্ষে, অথচ সেই ন্যায়ের জন্য কিছুই করতে চায় না—বরং পুরো ব্যবস্থাটির সুবিধা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। আরিয়েল এমনই এক চরিত্র, যে বিশ্বাস করে সে ভুলের বিরুদ্ধে, অথচ ভুলের অংশ হিসেবেই রয়ে যায়।
আরও মজার ব্যাপার হলো, তার এই আত্মবিশ্বাস—এই দেশটাকে নিজের বলে ভাবার স্পর্ধা—এটাও এক ঔপনিবেশিক ভুল বোঝাবুঝি। তার ইংরেজ পরিচয়, তার বংশ পরম্পরায় চলে আসা উপনিবেশবাদী সম্পর্ক—এগুলো মিলিয়েই সে শুধু একজন ইসরায়েলি নয়, বরং ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আমল থেকেই এক সরাসরি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করছে। অর্থাৎ, একদম শুরু থেকেই সে দখলদার, এমনকি সে যখন ‘উদার’ সায়োনিজমের মুখোশ পরে থাকে, তখনও।
ফিলিস্তিনিদের এই হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ইবতিসাম আজেম খুব সূক্ষ্ম অথচ ভয়ংকর কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে চিহ্নিত করেন। শহরের ব্যস্ততা যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়, কিন্তু সে স্তব্ধতার কারণ নিয়ে কেউ খোলাখুলিভাবে কথা বলে না।
বাসস্ট্যান্ডে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বাস আসছে না—কেননা আরব ড্রাইভাররা কাজে আসেনি। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের দীর্ঘ লাইন, কিন্তু ভেতরে চিকিৎসক বা নার্স নেই—কারণ তারা ছিল ফিলিস্তিনি। সুপারমার্কেটের তাক খালি হয়ে যাচ্ছে, কেননা দোকানের কর্মচারীরা গায়েব। হোটেলগুলো অচল, কারণ সাফাইকর্মী থেকে শুরু করে রান্নাঘরের লোকজন, সবাই অদৃশ্য।
আর আলার নোটবুক? সেটাও পড়ে থাকে অনাদরে, যতক্ষণ না আরিয়েল সেটাকে তুলে নেয়। যেন তার ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করাই তার কাজ—যেন ইতিহাসও কেবল তখনই মূল্যবান হয়, যখন সেটার পাঠক হয় দখলদার। আলার ব্যক্তিগত স্মৃতি, তার পরিবারের গল্প, তার দাদির ফেলে আসা ফিলিস্তিন—সবকিছুই আরিয়েলের হাতে চলে যায়, ঠিক যেমন পুরো দেশটাই একসময় দখল হয়ে গিয়েছিল।
ইবতিসাম এখানে এক চমৎকার প্রতীক তৈরি করেন—এই নোটবুক আরেকবার সেই দখলের গল্প বলে, সেই ক্ষমতার সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে নিপীড়কের হাতেই ন্যায়বিচারের গল্প তুলে দেওয়া হয়, আর সে ঠিক করে নেয় কোন সত্য টিকে থাকবে, কোনটি মুছে যাবে।
এই ডায়েরিটাই পুরো কাহিনির একটা বিপরীত প্রতিচ্ছবি। একদিকে আছে সেই ছোট ছোট নীরব মুহূর্ত—যেখানে পাঠক অনুভব করে, ফিলিস্তিনিরা নেই, আর তাদের না থাকাটা যেন অদৃশ্য এক শূন্যতার মতো চারপাশকে ঘিরে ধরেছে। শহরটি সেই একই শহর, কিন্তু কিছু যেন ঠিক নেই। দোকানপাট খোলা, রাস্তায় মানুষজন হাঁটছে, রেডিও চলছে—কিন্তু কোথাও কোনো আরবি কথা শোনা যাচ্ছে না, পরিচিত কণ্ঠস্বরগুলো মিশে গেছে বাতাসে। যেন এক ব্যস্ত শহরের ছায়া মাত্র, যেখানে মানুষ আছে, অথচ তাদের অস্তিত্বের একটি বড় অংশ অনুপস্থিত।
অন্যদিকে, মিডিয়া একদম উল্টোভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে—একটি দেশ যেন আতঙ্কে পাগল হয়ে উঠছে। গুজব ছড়ানো হচ্ছে, সীমান্তের ওপারে আরব সেনারা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে, যেন এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা আসলে কোনো সামরিক কৌশলের অংশ। কেউ বলছে, এটা ষড়যন্ত্র, কেউ বলছে, এটা একধরনের নতুন ধরনের ‘সন্ত্রাসবাদ’। তবুও কেউ স্বীকার করছে না যে, এই শহর এক বিশাল শূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—এমন এক শূন্যতা, যা শুধু মানুষ হারিয়ে যাওয়ার নয়, বরং এক জাতির ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, এবং স্মৃতির বিলুপ্তির শূন্যতা।
আরিয়েলও তার লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার প্রতিটি শব্দ যেন শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে গভীর কিছু ভাবতে চায়, কিন্তু তার ভাবনাগুলো কোনো দিকেই পৌঁছায় না। সে বিশ্লেষণ করছে, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুই কাজে আসছে না। কারণ সত্যিটা তো কেউই জানে না! কিংবা বলা ভালো, সত্যটা জানা হলেও কেউ সেটা মেনে নিতে চায় না।
অন্যদিকে, আলার লেখা একেবারে অন্যরকম। তার প্রতিটি বাক্যে শূন্যতার হাহাকার, হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ। কিন্তু এই দুঃখ নিছক ব্যক্তিগত নয়। তার ডায়েরির প্রতিটি শব্দ শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, শুধু তার দাদির জন্য নয়—এটি এক বৃহৎ কষ্টের প্রতিধ্বনি, এক নিঃশব্দ চিৎকার, যা সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া হাজারো কণ্ঠস্বরের অংশ।
ইবতিসাম এখানে এক সূক্ষ্ম কিন্তু ভয়ংকর বাস্তবতা তুলে ধরেন—একজন উপনিবেশকারীর লেখায় কেবলই বিশ্লেষণ আর তথ্য, অথচ নিপীড়িতের লেখায় থাকে সেই অনুভূতি, যা ভাষার চেয়েও গভীর। ইতিহাস যেভাবে লেখা হয়, আর ইতিহাস যেভাবে অনুভূত হয়—এই দুইয়ের মধ্যে ফারাকটা এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এইভাবে ইবতিসাম দেখিয়ে দেন, ফিলিস্তিনিরা হয়তো অনুপস্থিত, কিন্তু তাদের গল্প, তাদের কষ্ট, তাদের স্মৃতিগুলো ঠিকই থেকে যায়—এক টুকরো জাফার মধ্য দিয়ে, যা হারিয়ে গিয়েও প্রতিনিয়ত ফিরে আসে। এই শহরের বাতাস, রাস্তাঘাট, ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি—সবকিছুতেই তাদের অস্তিত্ব লুকিয়ে থাকে, যেন শূন্যতা নিজেই একপ্রকার প্রতিরোধ হয়ে ওঠে।
ফিলিস্তিনিরা হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পর ইসরায়েল দ্রুত এক জাতীয় নিবন্ধনের নির্দেশ দেয়। পুরো দেশের মানুষকে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে নিজেদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে—দেশের বাইরে থাকা ব্যক্তিদেরও। যেন এক আতঙ্ক ঘিরে ধরে শাসকদের—এই বুঝি ফিলিস্তিনিরা দলে দলে ফিরে আসবে, বন্দুক হাতে! যেন তারা কোনো এক অদৃশ্য বিদ্রোহের আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়ে।
এই ভয় থেকেই জন্ম নেয় আরও কঠোর নজরদারি, আরও সন্দেহ, আর সেই সঙ্গে নিজেদের মানুষের প্রতিও আরও হিংস্রতা। সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে আসে, চেকপয়েন্ট বাড়তে থাকে, নাগরিকদের চলাফেরার ওপর নতুন নতুন বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। একসময় এই ভয় এতটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে যে, শাসকেরা নিজেদেরই আক্রমণ করতে শুরু করে। একপর্যায়ে এক মিজরাহি (আরব বংশোদ্ভূত ইহুদি) নাগরিককেই ভুল করে ফিলিস্তিনি ভেবে আক্রমণ করা হয়—যেন রাষ্ট্রের শত্রু নির্ধারণের প্রক্রিয়াটাই এতটাই অস্পষ্ট আর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে, নিজের লোকদের সঙ্গেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
ইবতিসাম এখানে একটা গভীর রাজনৈতিক সত্য উন্মোচন করেন—নিপীড়ন শুধু শাসিতদের জন্যই কষ্টকর নয়, বরং একসময় শাসকদেরও গ্রাস করে ফেলে। ফিলিস্তিনিরা নেই, অথচ ইসরায়েলি রাষ্ট্রযন্ত্র ক্রমশ নিজেদেরই বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করতে শুরু করে। রাষ্ট্র তখন কেবল শত্রু খুঁজে বেড়ায়, কারণ তার অস্তিত্বই দাঁড়িয়ে আছে সেই শত্রুতার ওপর। ইবতিসাম দেখান, নিপীড়করা কখনোই নিপীড়ন বন্ধ করতে পারে না—কারণ একবার শত্রু নির্মাণের এই চক্র শুরু হলে, তা কেবলই নিজের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠে।
উধাও হয়ে যাওয়ার পর যে কণ্ঠগুলো আমরা শুনতে পাই, তার মধ্যে অন্যতম একজন ইরাকি ইহুদি নারী, যিনি হাসপাতালে শুয়ে আরবি ভাষায় কথা বলেন। এই দৃশ্যটাই যেন পুরো রাষ্ট্রীয় বিভাজনকে হাস্যকর করে তোলে—এই বিভাজন কতটা কৃত্রিম, কতটা খেয়ালি! ‘আরব পরিচয়’ কতটা অস্থায়ী—যখন সুবিধার হয়, তখন তা গ্রহণযোগ্য, আর যখন রাষ্ট্রের শাসনের বাইরে চলে যায়, তখনই তা শত্রু হয়ে ওঠে।
ফিলিস্তিনিদের চলে যাওয়া যেন কেবল তাদের অনুপস্থিতির গল্প নয়, বরং রাষ্ট্রের ভেতর জমে থাকা সমস্ত অসংগতি ও সঙ্কটের বিস্ফোরণ। ফিলিস্তিনিরা চলে গেলে রাষ্ট্রটা আস্তে আস্তে নিজের ভেতরেই ফেটে পড়ে। যে মানুষগুলো এতদিন এই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রেখেছিল—পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ডাক্তার, নার্স, নির্মাণশ্রমিক, কৃষক—তাদের অনুপস্থিতি কেবল দৈনন্দিন জীবনকেই অচল করে না, বরং রাষ্ট্রের কাঠামোকে একেবারে ভেতর থেকে দুর্বল করে ফেলে।
আর এই দুর্বলতা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। শাসকদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়, নজরদারির মাত্রা আরও কঠোর হয়, আর তারই ফলস্বরূপ নিজেদের মধ্যেই একেকটি স্তর একে অপরের শত্রুতে পরিণত হতে শুরু করে। সেই ইরাকি ইহুদি নারী, যার মাতৃভাষা আরবি—যার পূর্বপুরুষেরা একসময় আরব দুনিয়ায় সহাবস্থান করত—হঠাৎ করেই রাষ্ট্রের জন্য এক অস্বস্তিকর সত্য হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র বুঝতে পারে, ‘আরব’ এবং ‘শত্রু’ এই দুটি শব্দ এক করে ফেলার যে রাজনীতি এতদিন ধরে চালানো হয়েছে, তা এখন নিজেদের ভেতরেই দ্বন্দ্ব তৈরি করছে।
এই উপন্যাস আসলে এক ভয়ংকর রাজনৈতিক কল্পনার উল্টো দিকে তাকানোর সুযোগ দেয়। ফিলিস্তিনিদের অনুপস্থিতিতে, সায়োনিস্টদের স্বপ্নই যেন তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায়। যে রাষ্ট্র এতদিন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের গল্প বলে এসেছে, তারা হঠাৎ বুঝতে পারে, দখল করা যায়, মুছে ফেলা যায়, কিন্তু সেই শূন্যতার ভার সহ্য করা যায় না।
আর ইবতিসাম আজেম এই দুর্বলতাকে নির্মমভাবে উন্মোচন করেন—যাতে করে একদিন এই ঔপনিবেশিক প্রকল্পটা আসলেই টিকতে না পারে, ব্যর্থ হয়ে যায়। যেন ফিলিস্তিনিরা না থাকলেও, তাদের অনুপস্থিতিই একদিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিচারক হয়ে দাঁড়ায়।
আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্যটা উপন্যাসের প্রায় শেষ দিকে। আরিয়েল অপেক্ষা করছে আলার জন্য, তার নিজের ফ্ল্যাটে নয়, আলার ফ্ল্যাটেই। তার যুক্তিটা খুব সহজ—যদি আলা ফিরে আসে, তবে তো নিজের বাসাতেই ফিরবে। আর তাছাড়া, দুজনের ফ্ল্যাট তো কেবল কয়েকতলা ব্যবধানেই!
কিন্তু প্রথমেই সে যা করে, তা দেখে আমার চোখ কপালে উঠল—সে গোসল করে! যেন একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার, যেন এই ঘরটা তার নিজের। কারও অনুমতি ছাড়াই, যার ঘর সে দখল করে বসে আছে, সেই মানুষটিই যখন অনুপস্থিত!
তারপর সে আরও স্বাচ্ছন্দ্যে জায়গা করে নেয়—
সে রান্নাঘরে ঢোকে। পানি খায়, কফি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আলার রান্নাঘরে কেবল তুর্কি কফি রাখা। কফি বানানোর জন্য নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়ার আলসেমি তার পেয়ে বসে। তাই আলার কিচেনেই হাত চালায়—একটা পাতিলে তিন চামচ কফি, পানি ঢেলে দাঁড়িয়ে থাকে যাতে উথলে পড়ে না।
তারপর চোখ পড়ে আলার মায়ের বানানো জারে রাখা সাদা চিজে। প্লেট নিয়ে চিজ বের করে। সঙ্গে টমেটো, শসা আর সেই মসলাদার জলপাই, যেটা আলার মা প্রতি বছর নিজ হাতে বানান। রুটিও গরম করে নেয়।
এরপর আলার মতো করেই কফি বানিয়ে, খাওয়ার সব আয়োজন গুছিয়ে সে আলার শোবার ঘরে গিয়ে বসে।
এই পুরো দৃশ্যটা একদিকে হাস্যকর, অন্যদিকে আতঙ্কজনক—একজন মানুষ কীভাবে এত অনায়াসে আরেকজনের জীবন দখল করে নিতে পারে! যেন সে চুরি করছে না, বরং যা ফাঁকা পড়ে আছে, তা ব্যবহারের অধিকার তার নিজেরই!
ইবতিসাম এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে দখলের প্রক্রিয়াটাকে আরও ব্যক্তিগত করে তোলেন—যেখানে দখল শুধুই রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক কিছু নয়, বরং ব্যক্তিগত স্মৃতির ভেতরেও ঢুকে পড়ার এক বিকৃত অভ্যাস। আলার মায়ের বানানো জলপাই থেকে শুরু করে আলার নিজের কফি বানানোর রীতি পর্যন্ত, সবকিছুই আরিয়েল নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে।
এই দখলদারিত্ব এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, সে নিজেই বুঝতে পারে না, সে আসলে কী করছে। আর এটাই আসল আতঙ্ক—নিপীড়নের সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ তো তখনই হয়, যখন তা অতি স্বাভাবিক মনে হয়!
এই দৃশ্যটা অনবদ্য। আগেও বলেছি, এই বই ব্যক্তিগত গল্পকে বৃহৎ রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে জুড়ে দেয়, তারপর সেটাকে আরও বিস্তৃত, বৈশ্বিক এক বাস্তবতায় নিয়ে যায়।
আরিয়েল আলার ঘরে অনুপ্রবেশ করে—যেমন ইসরায়েলি সেটলাররা ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে প্রবেশ করেছে, যেমন ঔপনিবেশিকেরা সারা দুনিয়াজুড়ে দখলদারি কায়েম করেছে। সে নিজের জায়গা ছেড়ে অন্যের জায়গায় প্রবেশ করছে, অথচ তা কখনোই ‘দখল’ বলে মনে করছে না—বরং সেটাকে স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে দেখে।
সে যখন আলার রান্নাঘর থেকে খাবার তুলে নিচ্ছে, ঠিক তখনই তার মায়ের ফোন আসে। মা জানায়, তিনি ফাঁকা আরব ঘরগুলো দেখতে যাচ্ছেন, কিনে নেবেন বলে। এই মুহূর্তটা যেন পুরো ঔপনিবেশিক প্রকল্পের এক ক্ষুদ্র অথচ নির্মম প্রতিচিত্র।
আরিয়েল বিরক্ত হয়, মুখ বাঁকায়, যেন এই পুরো ব্যাপারটা তার কাছে একটু বেশি নগ্ন, একটু বেশি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিরক্তি তাকে থামায় না—তার হাত ততক্ষণে প্লেটের দিকে এগিয়ে গেছে। সে খেতে শুরু করে, কফি বানায়, নিজের অস্বস্তিকে চুপচাপ গিলে ফেলে।
এই তো সে! সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়, ফিলিস্তিনি এক শিশুকে গুলি খেতে দেখে, তারপর নির্দ্বিধায় বসে তুর্কি কফির কাপে চুমুক দেয়। তার বিবেক কখনোই তাকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলে না যে সে এসব বন্ধ করবে। বরং, সে নিজের উপস্থিতিকে বৈধ করতে থাকে, যেমন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দখলদাররা নিজেদের জায়গা ‘আদি বাসিন্দা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
আর সবচেয়ে আইরনিক ব্যাপার? সে মনে করে, এই ঔপনিবেশিক প্রকল্প তার ‘ফিরে আসা’। যেন এই ভূমি তারই ছিল, কেবল সে হারিয়ে ফেলেছিল একসময়। অথচ, সে এতটাই অভ্যস্ত সুবিধাভোগী হয়ে উঠেছে যে, নিজের ফ্ল্যাট থেকে কফি আনতেও যেতে চায় না! দখলদারের স্ববিরোধিতা এখানেই—একদিকে এই ভূমিকে নিজের মনে করা, আরেকদিকে তাৎক্ষণিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অন্যের জায়গায় অনুপ্রবেশ করা।
ইবতিসামের সবচেয়ে সূক্ষ্ম অথচ শক্তিশালী রাজনৈতিক ভাষ্য এখানেই—দখলদার কখনোই কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে শাসন করে না, বরং সে অন্যের জীবনযাপনকে নিজের ভেতর এমনভাবে শুষে নেয় যে, দখলটাই একসময় তাকে সংজ্ঞায়িত করতে শুরু করে। এই দখল তখন শুধু জমির নয়, ভাষার, খাবারের, ইতিহাসের, এমনকি স্মৃতিরও। আর সেটাই উপনিবেশবাদী প্রকল্পের চূড়ান্ত বিজয়—যখন দখলদার নিজেও বুঝতে পারে না, সে আসলে কী দখল করে ফেলেছে!
সায়োনিজম আসলে কেবল এক ধরনের সামরিক দখলদারি নয়। এটা হলো বন্দী হয়ে যাওয়া পরিবার, ট্যাঙ্কের গর্জন, মানচিত্রের ওপর নতুন নাম বসিয়ে দেওয়া, অন্যের খাবার নিজেদের বলে চালিয়ে দেওয়া। এটা কেবল বন্দুকের দখল নয়, বরং ইতিহাসেরও দখল।
আমরা জানি না, ফিলিস্তিনিরা আদৌ ফিরে আসবে কি না। জানি না, কেন তারা উধাও হয়ে গিয়েছিল। তারা কি নিজে থেকেই চলে গেছে, নাকি কেউ তাদের মুছে দিয়েছে? নাকি এটা শুধুই এক অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য কল্পনা?
কিন্তু উপন্যাসের শেষ দৃশ্যটা যেন এক শীতল সত্য ঘোষণা করে—আরিয়েল আলার ডায়েরির কিছু অংশ বাছাই করছে, হিব্রুতে অনুবাদ করবে, এরপর এক বই লিখবে ফিলিস্তিনিদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে!
ইসরায়েলের পরিচয়ের ভিত্তি যেন এক ধরনের ঐতিহাসিক শূন্যতা। তারা নিজেদের ইতিহাস বলতে যা বোঝে, তা আসলে অন্যের ইতিহাস চুরি করে তৈরি করা এক বৃত্তান্ত। এমন এক জাতীয় পরিচয়, যার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও প্রয়োজন সেই ‘অপর পক্ষের’ উপস্থিতি—যে পক্ষকে তারা বারবার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে। ফিলিস্তিনিরা যতই অদৃশ্য হয়ে যাক, তাদের শূন্যতাই যেন এক অবিসংবাদিত বাস্তবতা হয়ে থাকে।
এই পরিচয় এতটাই ঠুনকো যে, অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যও ফিলিস্তিনিদের দরকার। যতই মুছে ফেলতে চাও, যতই ইতিহাস পাল্টাতে চাও, জানো, এই ভূমির সত্যিকারের ইতিহাস তোমরা লেখোনি—দখল করেছো।
আরিয়েল নামের চরিত্রটি যেন এই প্রতারণারই প্রতিচ্ছবি। সে লেখে, গবেষণা করতে চায়, বিশ্লেষণ করতে চায়—কিন্তু তার শব্দগুলো শূন্য, বর্ণনাগুলো রক্তশূন্য। কারণ, সে শুধু কাগজে গল্প সাজায়, কিন্তু সেই গল্পের ভেতরে সত্য নেই। তার পরিচয় আর তার ইতিহাস এতটাই দুর্বল যে, নিজের কল্পনার জন্যও তাকে অন্যের স্মৃতি ধার করতে হয়।
তাই সে অন্যের লেখা চুরি করে। আলার ব্যক্তিগত স্মৃতি, তার বেদনা, তার হারিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিন—সব সে নিজের মতো করে লিখবে, নিজের ভাষায়, নিজের নিয়ন্ত্রণে। তার গল্পে ফিলিস্তিন থাকবে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জায়গা থাকবে না।
এভাবেই ফিলিস্তিনিদের স্মৃতি বারবার টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কিন্তু এবার হয়তো আর কেউ থাকবে না সেই স্মৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য। আর এটাই ইবতিসামের সবচেয়ে অমোঘ সতর্কতা—যদি নিপীড়িতরা হারিয়ে যায়, তবে নিপীড়কেরাও একদিন নিজেদের অস্তিত্ব হারাবে। কারণ, মুছে ফেলার ক্ষমতা থাকলেই মুছে ফেলা সম্ভব হয় না। ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম সত্য তো এটাই—কেউ থাকুক বা না থাকুক, স্মৃতির ভূত কখনোই পুরোপুরি হারিয়ে যায় না।