দ্য বুক অফ লেজেন্ডারি ল্যান্ডস - উমবের্তো একো
একোর লেখনী একদিকে সত্য স্পষ্ট করে দেয়, অন্যদিকে কল্পনার জাল বোনার সুযোগও রেখে দেয়, যদি পাঠক তা খুঁজে নিতে চান।
ইতালীয় কথাসাহিত্যিক, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক উমবের্তো একো (৫ জানুয়ারি, ১৯৩২–১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬) প্রতীক ও রূপকের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। তাঁর শৈশবের সেমিওটিক শিশুতোষ বইগুলোর মধ্য দিয়েই এই আগ্রহের শুরু। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর, একো তাঁর দ্য বুক অফ লেজেন্ডারি ল্যান্ডস-এ প্রতীক ও রূপকের জাদুকরী প্রভাব পুনরায় অনুসন্ধান করেছেন।
এই বই ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কল্পিত স্থানগুলোর এক চিত্রময় ভ্রমণকাহিনি—যেখানে আটলান্টিসের মতো বিশাল মহাদেশ থেকে শুরু করে শার্লক হোমসের কল্পিত অ্যাপার্টমেন্টের মতো ক্ষুদ্র স্থান পর্যন্ত, সবকিছুই কল্পনার রাজ্যে প্রাণ পেয়েছে। মানব কল্পনার এক গতিশীল গাইড হিসেবে একো আমাদের নিয়ে গেছেন সেই রহস্যের কেন্দ্রে, যেখানে তিনি অনুসন্ধান করেছেন কেন এই ইউটোপিয়া ও ডিস্টোপিয়াগুলি আমাদের এত গভীরভাবে আকর্ষণ করে।
এই স্থানগুলো কীভাবে আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক বোঝায় এবং আমাদের জগতের অর্থ খুঁজে পাওয়ার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে, সেটিও একো বিশ্লেষণ করেছেন। শেষমেশ, মানচিত্র—যা আমরা মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে সময় এবং আবেগের স্মৃতিগুলোকেও বোঝার জন্য ব্যবহার করেছি—জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার অন্যতম সেরা মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
যুধিষ্ঠির বকরূপী ধর্মের প্রশ্নে বলেছিলেন, দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী বস্তু হলো মানুষের মন। এই মনেই কল্পনা পায় বিচিত্র এবং অসম্ভাব্যগামী দিশা। নদীর এপারের দুঃখ ভুলে ওপারের আদর্শ ভূমি খোঁজা মানুষের চিরকালীন প্রবৃত্তি। সেই চিরবসন্তময় ভূমির কল্পনা থেকেই স্বর্গের ধারণা, সঙ্গে নরকেরও—কারণ বিপরীত ছাড়া তো সুখ পূর্ণ হয় না। সেখানে বিলাসিতার পাশাপাশি চেয়েছি কল্পনার অতীত ধনসম্পদের অবস্থানও।
প্রাচীন যুগ থেকেই লেখকের কল্পনায় এমন আদর্শ ভূমির বিবরণ বারবার উঠে এসেছে। বিভিন্ন জাতির চেতনায় এই দেশগুলো জীবন্ত থাকলেও, বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এই রহস্য ঘিরে রচিত হয়েছে বহু রোমাঞ্চকর গল্প। সম্প্রতি লেখা কয়েকটি থ্রিলারে এই ধারণা নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে এবং পাঠকদের মধ্যে গভীর উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
উমবের্তো একোর দ্য বুক অফ লেজেন্ডারি ল্যান্ডস কল্পনা আর গবেষণার মিশেলে এক অসাধারণ রোমাঞ্চ তৈরি করেছে। অবাক হতে হয়, কীভাবে সামান্য বা সাধারণ এক বাস্তব ঘটনাও কিংবদন্তিতে রূপ নেয়। একোর লেখনী একদিকে সত্য স্পষ্ট করে দেয়, অন্যদিকে কল্পনার জাল বোনার সুযোগও রেখে দেয়, যদি পাঠক তা খুঁজে নিতে চান।
একো ভূমিকার শুরুতেই লিখেছেন:
"কিংবদন্তির স্থানগুলো বিভিন্ন ধরনের হলেও তাদের মধ্যে একটি বিষয় সাধারণ: তারা প্রাচীন কিংবদন্তির মায়ায় আবৃত হোক বা আধুনিক সৃষ্টির ফল হোক, তারা বিশ্বাসের প্রবাহ সৃষ্টি করেছে।"
এই মায়াময় স্থানগুলোর বাস্তবতা নিয়েই এই বইয়ের বিষয়বস্তু।
বইটি পাঠককে বিশ্বপরিক্রমায় নিয়ে যায়—গবেষণা আর কল্পনার মেলবন্ধনে। বইয়ের শুরুতেই চ্যাপ্টা পৃথিবীর ধারণা, যা প্রাচীন কল্পিত স্থানগুলির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত, নিয়ে আলোচনা করেছেন একো। পর্যটক ও দার্শনিকদের বর্ণিত অজানা অঞ্চলের অবস্থান বহুসময়েই চ্যাপ্টা পৃথিবীর ধারণার ওপর নির্ভরশীল ছিল। যদিও এই স্থানগুলি বাস্তবে কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবু মানুষের কল্পনার ছলনায় এগুলোকে ঘিরে অসংখ্য রোমাঞ্চকর গল্প রচিত হয়েছে।
একো ইউটোপিয়ার আকর্ষণকে সম্ভাবনার একটি স্পষ্ট ম্যানিফেস্টো হিসেবে দেখেন:
"প্রায়ই আকাঙ্ক্ষার বস্তু, যখন তা আশা হয়ে ওঠে, বাস্তবতার চেয়েও বেশি বাস্তব হয়ে ওঠে। একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের প্রতি এই আশার টানে মানুষ অনেক সময় অসীম ত্যাগ স্বীকার করতে, এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত হয়। তাদের এই পথচলা পরিচালিত হয় ভবিষ্যতের স্বর্গের—পৃথিবীতে বা অন্য কোথাও—দর্শনে অনুপ্রাণিত ভবিষ্যদ্রষ্টা, ভাববাদী, প্রভাভশালী প্রচারক এবং মন্ত্রমুগ্ধ বক্তাদের দ্বারা, যারা তাদের অনুসারীদের মনে এমন এক চিত্র এঁকে দেন।"
একোর লেখায় একই সঙ্গে যুক্তি ও কল্পনার তুলনা উঠে আসে। উদাহরণ হিসেবে তিনি মার্কো পোলোর বর্ণনা বিশ্লেষণ করেছেন, যেখানে পোলো ইউনিকর্ন দেখেছেন বলে দাবি করলেও একো দেখান, সেটি আসলে একশৃঙ্গ গন্ডার। এইভাবে একো আমাদের দেখান কীভাবে কিংবদন্তি আর বাস্তবতার সীমানা মিশে যায়।
বইটির অন্যতম আকর্ষণ আটলান্টিস নিয়ে আলোচনা। প্লেটো থেকে শুরু করে রেনেসাঁর ভূগোল ও বিজ্ঞানের সঙ্গে আটলান্টিসের সংযোগ একো তুলে ধরেছেন। তিনি বিষয়টিকে পুরোপুরি উড়িয়ে না দিয়ে রহস্যকে জীবন্ত রেখেছেন। আটলান্টিসের মতো কিংবদন্তি স্থানগুলি একোর লেখায় অতিকথন থেকে ইতিকথার দিকে এগিয়েছে, কিন্তু তাদের রোমাঞ্চ হারায়নি।
তবে, ইউটোপিয়ার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী এক অন্ধকার দিকও জড়িত, যা নিখুঁত সুখের ধারণা থেকেই জন্ম নেয় এবং তা অনেক সময় অত্যাচারের রূপ নিতে পারে। একো লেখেন:
"আমরা সবসময় ইউটোপিয়া প্রদত্ত সমাজে বাস করতে চাই না, কারণ সেগুলো প্রায়শই এমন স্বৈরতন্ত্রের মতো হয়ে ওঠে, যা নাগরিকদের স্বাধীনতার বিনিময়ে তাদের উপর সুখ চাপিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, [টমাস] মোরের ইউটোপিয়া বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সহনশীলতার কথা বলে, কিন্তু এগুলো শুধুমাত্র বিশ্বাসীদের জন্য সীমাবদ্ধ করে। নাস্তিকদের সরকারে প্রবেশ নিষিদ্ধ, এবং যদি কেউ নিজের এলাকা থেকে দূরে যাওয়ার জন্য অনুমতি ছাড়াই ধরা পড়ে, তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়; দ্বিতীয়বার এই কাজ করলে তাকে দাসত্বে নিক্ষেপ করা হয়।"
একো আরও যোগ করেন যে, সাহিত্যকর্ম হিসেবে ইউটোপিয়া কিছুটা পুনরাবৃত্তিমূলক হয়ে ওঠে, কারণ একটি নিখুঁত সমাজের আকাঙ্ক্ষা করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই একই মডেলের অনুকরণ করতে বাধ্য হই।
বইটি শুধু লেখকের বিশ্লেষণ নয়, বিভিন্ন ভাষার লেখকের উক্তি, প্রাচীন মানচিত্র, শিল্পকর্ম আর মনোমুগ্ধকর ছবির সম্ভারও পাঠকের কাছে তুলে ধরে। একোর লেখনীতে যুক্তি, ইতিহাস ও থ্রিলার একসঙ্গে মিশে যায়। বিজ্ঞানমনস্ক বা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়—সব ধরনের পাঠকের জন্যই এটি এক অনন্য রচনা।
এই ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে একো ঘুরে দেখিয়েছেন বিশ্বের নানা কিংবদন্তির স্থান। বাইবেলের দেশ থেকে হোমারের ভূমি, পাশ্চাত্যের লেখকদের চোখে প্রাচ্যের রহস্যময় স্থান, স্বর্গ, ইউটোপিয়া, সলোমনের দ্বীপ, পৃথিবীর অভ্যন্তরের কল্পিত জগৎ কিংবা হোলি গ্রেল মিথের স্থান—সবকিছুই তাঁর আলোচনায় এসেছে।
এমনকি সম্প্রতি বিখ্যাত হওয়া রেন-ল্য-শাতোকেও বাদ দেননি। ড্যান ব্রাউনের লেখায় গ্রেল মিথের কেন্দ্র হিসেবে এই স্থানটি খ্যাতি পেলেও, একো একে কাল্পনিক নয়, বরং কিংবদন্তির মর্যাদা দিয়েছেন। তবে একো এখানে কোনও গুপ্ত সংকেত প্রকাশ করেননি; বরং রেন-ল্য-শাতোর তথাকথিত রহস্যকে ইতিহাসের তথ্য দিয়ে অস্বীকার করেছেন। এইভাবে একোর লেখনী যুক্তি আর কল্পনার মিশ্রণে কিংবদন্তির জগৎকে নতুন আলোয় উন্মোচিত করেছে।
বইটি পড়ার সময় এক ধরনের মজার দ্বৈত অনুভূতি হয়। একো পশ্চিমি ভাবনার প্রতিভূ হয়ে লিখলেও, প্রাচ্যের প্রতি পাশ্চাত্যের যে-অতিবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, সেটি তিনি পুরোপুরি এড়াতে পারেননি। যদিও প্রাচ্যকে কেবল উদ্ভট জিনিসের ডিপো বানানোর প্রবণতা তিনি মেনে নেননি, তবু তাঁর লেখায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সূক্ষ্ম ফারাক বজায় থেকেছে।
তাই এই বইতে স্বর্ণলঙ্কা, ইন্দ্রপ্রস্থ বা কৈলাসের মতো প্রাচ্যের কিংবদন্তি স্থানগুলো জায়গা পায়নি। যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়েছিলেন কিনা, বা সেই পথের রহস্য নিয়েও কোনও আলোচনা করেননি একো। পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধ তেমনভাবে তাঁর আলোচনায় উঠে আসেনি। যদি আসত, তবে প্রাচ্যের কিংবদন্তির কিছু ধোঁয়াটে ধারণায় বাস্তবতার আলোকপাত হতো।
তবে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে, একো কল্পনার জগতে বাস্তবতার এক বিপরীতধর্মী নিশ্চয়তা খুঁজে পান। কল্পকাহিনি আমাদের অনিশ্চয়তার অস্তিত্বজনিত অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেয়, কারণ এখানে সবকিছু নির্ভুলভাবে এবং স্পষ্টতই তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী সাজানো থাকে।
"গল্পের সম্ভাব্য জগৎই একমাত্র মহাবিশ্ব, যেখানে আমরা কোনো বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি, এবং এটি আমাদের কাছে সত্যের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। যারা সহজে বিশ্বাস করেন, তারা মনে করেন এল ডোরাডো বা লেমুরিয়া কোথাও না কোথাও ছিল বা এখনও রয়েছে, এবং সন্দেহপ্রবণরা নিশ্চিত থাকেন যে সেগুলি কখনও ছিল না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এটি নির্ভুলভাবে নিশ্চিত যে সুপারম্যান আসলে ক্লার্ক কেন্ট, ড. ওয়াটসন কখনও নিরো উলফের সহযোগী ছিলেন না, এবং আন্না কারেনিনা ট্রেনের নিচে প্রাণ হারিয়েছিলেন—তিনি কখনও প্রিন্স চার্মিংকে বিয়ে করেননি।"
একো এখানে দেখিয়েছেন, কল্পনার মধ্যেই আমরা সেই নিশ্চিত সত্য পাই, যা বাস্তবতা প্রায়ই দিতে ব্যর্থ হয়।
তবু, দ্য বুক অফ লেজেন্ডারি ল্যান্ডস নতুন থ্রিলারের প্লট খুঁজে দেওয়ার মতোই। হারকিউলিসের পিলারের সন্ধানে কোনও আধুনিক অভিযাত্রী রওনা হতে চাইলে এই বই তার জন্য যথেষ্ট প্রেরণাদায়ক।