অলডাস লিওনার্ড হাক্সলি ছিলেন এক ইংরেজ লেখক ও দার্শনিক, যিনি প্রায় ৫০টি বই রচনা করেছেন—প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, ও নন-ফিকশনসহ। তার সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি Brave New World (১৯৩২), যেখানে ভবিষ্যতের এক সমাজচিত্র আঁকা হয়েছে, যেখানে সার্বজনীন সুখের জন্য মানবজাতিকে নিষ্প্রাণ ও যান্ত্রিক করে তোলা হয়েছে। এই বিতর্কিত উপন্যাসটি সমকালীন সামাজিক সমস্যার সমালোচনার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং আজও প্রাসঙ্গিক।
হাক্সলি শুধু উপন্যাসেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না—তিনি ছোটগল্প, ভ্রমণবৃত্তান্ত, নাটক ও চিত্রনাট্যও লিখেছেন। তার রচনাগুলো বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজতত্ত্বের সংমিশ্রণে গঠিত, যেখানে ভবিষ্যতের প্রতি এক গভীর সংশয় ও দর্শনের প্রতি এক অনুসন্ধিৎসা দেখা যায়।
“The Bookshop” হল সেই গল্প, যা অলডাস হাক্সলির ১৯২০ সালে প্রকাশিত গল্পসংকলন Limbo-তে অন্তর্ভুক্ত। এই সংকলনটি হাক্সলির শুরুর দিকের লেখাগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে সমাজ, মানব প্রকৃতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহলের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। The Bookshop গল্পটিও সেই ধাঁচের—পঠন-পাঠনের জগৎ, বাস্তবতা ও বুদ্ধিজীবীদের মনস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে এক শ্লেষাত্মক আখ্যান। এটি হাক্সলির সাহিত্যভঙ্গির সূক্ষ্মতা ও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
বইয়ের দোকান? এখানে? যেখানে আশেপাশের সব দোকানগুলো জীবন ধারণের ন্যূনতম উপকরণ বিক্রি করেই ব্যস্ত? যেখানে মানুষের হাতে বই নয়, বরং এক টুকরো রক্ত-ঝরা মাংস থাকে, যার আঠালো চেহারা কাগজের মোড়কের মধ্যেও ফুটে থাকে? এই এলাকায় বই বিক্রি হবে কীভাবে? প্রশ্নটা করতেই হলো।
এই রাস্তা, শহরের প্রধান ধমনীর মতো, যেখানে সবকিছু ভীষণ দ্রুতগতিতে এগোয়—ট্রাফিকের গতি, মানুষের হাঁটা, বিক্রেতাদের হাঁকডাক। দেখে মনে হয় যেন এ এক জীবনচঞ্চল, আলো ঝলমলে এলাকা। কিন্তু একটু তাকালেই দেখা যায়, চারপাশে জমাট বেঁধে থাকা বস্তি—এমন এক জনজীবনের কোলাহল, যেখানে আলো পৌঁছয় না, কিন্তু প্রয়োজন পৌঁছে যায়। মানুষেরা এখানে তাদের দরকারি কেনাকাটা সেরে নেয়। হাতে ঝোলানো লিনোলিয়াম, পিঠে বাঁধা খড়ের ব্যাগ, মাথায় জড়ানো কালো শাল, পা টেনে হাঁটা এক মুমূর্ষু তাড়না। এদের দেখে মনে হলো, এরা বই কিনবে?
তবু দোকানটা সেখানে দাঁড়িয়ে। ছোট্ট একখানা জায়গা, দরজা আর চার হাত লম্বা অন্ধকারাচ্ছন্ন জানালা—সর্বসাকুল্যে এইটুকুই তার অস্তিত্ব। একপাশে এক বিশাল ফার্নিচারের দোকান, যা এতটাই রাস্তার দিকে গড়িয়ে পড়েছে যে মনে হয়, ফার্নিচারগুলো যেকোনো মুহূর্তে পথচারীদের ঘাড়ে উঠে বসবে। অন্যপাশে এক হোটেল, যার পর্দাঘেরা জানালায় লেখা আছে ছয় পেনির খাবারের বিজ্ঞাপন, অবশ্য সেই লেখাগুলোও রঙ চটে গেছে। এই দুইয়ের মাঝখানে যেন এক ছোট্ট আশ্চর্য ব্যতিক্রম—বইয়ের দোকান!
এখানে বই বিলাসিতা। অন্য প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় এক কল্পনার সামগ্রী। তা সত্ত্বেও, দোকানটা বেঁচে আছে। মরে যায়নি, হারিয়ে যায়নি। এই নির্দয় বাস্তবের মাঝে, যেখানে প্রতিটি বর্গফুটের লড়াই কেবল বেঁচে থাকার জন্য, সেখানে বই জায়গা করে নিয়েছে। ছোট্ট, সংকীর্ণ জায়গায় হলেও, বই বেঁচে আছে। সে বেঁচে থাকার মধ্যেই যেন এক অভ্রান্ত জয়ের গল্প।
দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মালিক—এক ছোটখাটো মানুষ, মুখভর্তি ধূসর দাড়ি, আর এক জোড়া সজাগ চোখ, যা চশমার কাচের কোণায় কোণায় যেন ক্রমাগত খেলে বেড়াচ্ছিল। তাঁর নাক লম্বা, ধারালো, যেন বইয়ের পাতার উপর নতজানু এক বুদ্ধিমান তীক্ষ্ণ পাঠকের প্রতিচ্ছবি।
“ব্যবসা কেমন চলছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি মাথা দুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমার দাদার সময় ভালো ছিল,” বললেন বিষণ্ণ গলায়।
আমি মৃদু হাসলাম। “আমরা ক্রমশ বর্বর হয়ে যাচ্ছি, তাই তো?”
তিনি হাতজোড়া তুলে কপালে হাত রেখে বললেন, “সব দোষ ওই সস্তা পত্রিকার। ক্ষণস্থায়ী যা কিছু, সেটাই টিকে যাচ্ছে। চিরস্থায়ী, ধ্রুপদী জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। “এই সাংবাদিকতা, বা বলা ভালো এই তুচ্ছ, গড়পড়তা দৈনন্দিনতা—এটাই আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।”
তিনি হঠাৎ হাত নাড়লেন, যেন একটা শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না।
“এগুলো ঠিক কিসের উপযুক্ত?”
আমি একটু কটাক্ষ মেশানো কণ্ঠে বললাম, “আগুনের?”
তিনি তাৎক্ষণিক জোর দিয়ে বললেন, “না! পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য।”
তাঁর আবেগ দেখে আমি সহানুভূতির হাসি হাসলাম। “আমাদের চিন্তাধারা দারুণ মিলছে,” বললাম। “আপনার এই গুপ্তধনগুলোর মাঝে একটু ঢুঁ মারতে পারি?”
দোকানের ভেতরটা যেন এক চায়ের রঙের গোধূলি—আলো-আঁধারের রহস্যময় এক মিশ্রণ, যেখানে বাতাসে ভাসছে পুরোনো চামড়ার গন্ধ আর সেই সূক্ষ্ম, প্রায় অদৃশ্য ধুলো, যা ভুলে যাওয়া বইয়ের পাতাগুলো আঁকড়ে থাকে, যেন তাদের গুপ্তধনের একমাত্র রক্ষক। এই ধুলো অনেকটা সেসব মরুভূমির শুকনো বালির মতো, যেগুলোর নিচে হাজার বছরের পুরনো ধ্বংসাবশেষ, গুপ্তধন আর আবর্জনা, অবিশ্বাস্যভাবে অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে।
আমি এলোমেলোভাবে প্রথম যে বইটা হাতে নিলাম, সেটা ছিল এক ফ্যাশন-অ্যালবাম। হাতে রঙ করা প্লেট, ম্যাজেন্টা আর বেগুনি, মেরুন আর সলফেরিনো, আর সেই বিষণ্ণ সবুজের ছায়া—যে রঙ এককালে পরিচিত ছিল “দ্য সরোজ অফ ওয়ের্থার” নামে। পাতার পর পাতা জুড়ে বিশালাকার ক্রিনোলিন পরা নারীরা ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন তারা কোনো বিশাল রাজকীয় জাহাজ, বাতাসে ফুলে ওঠা শামিয়ানার মতো দোল খাচ্ছে। তাদের পা আঁকা হয়েছে পাতলা, চেপে যাওয়া কালো রেখার মতো—যেন চায়ের পাতার শুকনো টুকরো, যা বিনয়ের সঙ্গে পেটিকোটের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে। তাদের মুখ ডিম্বাকৃতি, চকচকে কালো চুলে আবৃত, আর তাদের অভিব্যক্তি?—এক অনবদ্য পবিত্রতার প্রতিমূর্তি।
আমাদের আধুনিক ফ্যাশনের ছবিগুলোর কথা ভাবলাম। উঁচু হিল আর বাঁকা পায়ের খাঁজ, সঙ্কুচিত মুখ আর আমন্ত্রণসূচক ঠোঁটের হাসি—যেন সবকিছু এক কৃত্রিম আত্মপ্রদর্শনের পক্ষে চলে গেছে। এ থেকে হতাশ হওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। আমি নিজে প্রতীকবাদে সহজেই প্রভাবিত হই; আমার মধ্যে হয়তো কিছুটা ফ্রান্সিস কোয়ার্লসের স্বভাব আছে—আমার বিমূর্ত চিন্তাগুলোর জন্য দৃশ্যমান প্রতিমূর্তি চাই। তাই হঠাৎ মনে হলো, যদি আমাকে দাম্পত্যের পবিত্রতা আর সংসারের প্রভাবের জন্য কোনো প্রতীক বেছে নিতে হয়, তবে সেটি হবে ওই কালো পাতার মতো পা, যেগুলো বিনয়ের সঙ্গে প্রশস্ত স্কার্টের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে। আর হাই হিল ও সুঠাম পায়ের খাঁজ?—তা বরং সংসারবিনাশের প্রতীকের উপযুক্ত!
আমার চিন্তার স্রোত খানিকটা ছিন্ন হয়ে গেল যখন বৃদ্ধ দোকানদার কথা বললেন—
“আপনার নিশ্চয়ই সংগীতের প্রতি ঝোঁক আছে?”
আমি একটু হেসে বললাম, “অল্প-স্বল্প।”
তিনি আমার দিকে এক ভারী ফোলিও এগিয়ে দিলেন।
“এটা কখনও শুনেছেন?”
আমি বইয়ের মলাটের দিকে তাকালাম—’রবার্ট দ্য ডেভিল’।
না, আমি কখনও শুনিনি। কিন্তু আমার ভেতর একটা ছোট্ট খচখচানি হলো। নিশ্চয়ই এটা আমার সংগীত শিক্ষা তথা রুচির এক গুরুতর ফাঁক।
বৃদ্ধ দোকানদার বইটি হাতে তুলে নিলেন এবং দোকানের এক কোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এলেন। ঠিক তখনই আমি একটা বিস্ময়কর ব্যাপার লক্ষ করলাম—যেটাকে এতক্ষণ দোকানের সাধারণ কাউন্টার বলে ধরে নিয়েছিলাম, সেটি আসলে এক অদ্ভুত আকারের স্কোয়ার পিয়ানো!
বৃদ্ধ পিয়ানোর সামনে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সুরের কিছু খামতি যদি থাকে, তা মাফ করবেন। এটি এক প্রাচীন ব্রডউড, জর্জীয় যুগের। একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজানো হচ্ছে।”
তিনি পিয়ানোর ঢাকনা খুললেন, আর ফ্যাকাশে হলদেটে কীগুলো যেন আধো-অন্ধকারে মুচকি হেসে উঠল—এক বৃদ্ধ ঘোড়ার দাঁতের মতো।
তিনি বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলেন, যতক্ষণ না কাঙ্ক্ষিত অংশ খুঁজে পেলেন। “ব্যালের সংগীত,” বললেন তিনি। “অসাধারণ! শুনুন।”
তারপর শুরু হলো সেই জাদু।
তাঁর শুকনো, কিঞ্চিৎ কাঁপা-কাঁপা আঙুলগুলো অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় চলতে শুরু করল, আর ট্রাফিকের শব্দের ফাঁক গলে এক উচ্ছল, বর্ণিল সুর ভেসে উঠল—পেঁচানো, নেচে ওঠা এক মিষ্টি সংগীত।
পিয়ানোর গায়ে বয়সের ভার স্পষ্ট। টুংটাং করে বেজে উঠল, মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠল, আর সুর যেন এক অনাহারে শুকিয়ে যাওয়া ঝরনার ধারার মতো টান টান। কিন্তু তবু, সুরটা ছিল, ছন্দটা ছিল—একটা ঝলমলে, ওজনহীন, হাওয়ায় ভেসে চলা মেলোডি।
“এবার মদের গান!” বৃদ্ধ দোকানদার প্রায় চিৎকার করেই উঠলেন, সংগীতের উত্তেজনায় যেন নিজেই এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছেন। তাঁর আঙুল পিয়ানোর কীগুলোর ওপর ঝড়ের মতো নাচতে লাগল—ধাপে ধাপে সুর চূড়ান্ত উত্তেজনার শিখরে পৌঁছতে থাকল, যেন অপেরার সেই চিরচেনা মুহূর্ত, যেখানে গায়ক-গায়িকারা আবেগের বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
আর তারপর এল সেই অনিবার্য মুহূর্ত—মদের গানের কোরাস!
চোখের সামনে ভেসে উঠল কিছু রহস্যময় পুরুষ, লম্বা ক্লোক পরে বসে আছে, হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে, যদিও তাদের হাতে ধরা মদের বোতলগুলো কেবলই কার্ডবোর্ডের—নকল, ফাঁপা।
“পাত্রে ঢাল, ওহে সুধাপ্রেমিকেরা,
এই মহান সুরা, মন ভাসিয়ে দাও!”
বৃদ্ধের কণ্ঠ ছিল ফাটল ধরা, চড়া, প্রায় ভাঙা, কিন্তু তার আবেগ এতটাই প্রবল যে গানের যে-কোনো কারিগরি খুঁত সেখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। এতদিন আমি কখনও কারও মুখে এমন প্রাণখোলা, সর্বস্ব উজাড় করা আনন্দ দেখিনি!
কিছুক্ষণ পর, তিনি আবার পাতাগুলো ওলটাতে লাগলেন। “আহ! ‘ভলস ইনফারনালে’! চমৎকার এক রচনা।”
একটা হালকা বিষণ্ণ ভূমিকা বাজল, তারপর মূল সুর শুরু হলো। যতটা নরকের নৃত্য হওয়ার কথা ছিল, ততটা নাও হতে পারে, তবে বেশ মিষ্টি একটা রস ছিল তাতে।
আমি কৌতূহল নিয়ে তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে গানটির কথা দেখলাম এবং তার সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাইতে শুরু করলাম—
“ওহে জাহান্নামের গুণ্ডারা,
ভূত-প্রেতের ভাঙা সুরে,
তোমাদের রাজাকে নমস্কার করো,
তালি বাজাও, ভয় যেন আরও ঘনিয়ে আসে!”
এক বিশাল, গম্ভীর গর্জনে এক দৈত্যাকার বাষ্পচালিত ব্রুয়ারির ট্রাক ধেয়ে গেল, যেন এক মুহূর্তেই অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেল। বুড়ো লোকটার আঙুল তখনো সেই হলুদ কীবোর্ডের ওপর ঘুরছে, আমার ঠোঁট খুলছে, বন্ধ হচ্ছে, কিন্তু কোনও শব্দ নেই—না কথা, না সুর। যেন এই নির্জন, ধ্যানমগ্ন আস্তানার মধ্যে আচমকা হানা দিয়েছে কল্পনার দানব, আতঙ্কের বিভীষিকা।
আমার চোখ চলে গেল সেই সংকীর্ণ দরজার বাইরে। লোকজন ছুটে চলেছে, গাড়ি-ঘোড়ার বিরাম নেই। যেন একেকটা দানবীয় ছায়ামূর্তি—বহির্জগতের নরকযন্ত্রণা যেখানে মানুষের ইচ্ছাশক্তির কোনও মূল্য নেই। সেখানে একেকজনের অস্তিত্ব শাসন করছে জড় বস্তু, টাকা, যন্ত্র, আর অভ্যাসের অন্ধ অনুশাসন। কিন্তু এখানে, এই ছোট্ট ঘরটায়, আমি বেঁচে আছি ‘বস্তু’র দাসত্ব থেকে এক পা সরে। এক বৃদ্ধ, যিনি সম্ভবত অন্য কোনও সময়ের জীবিত রেশ, এক অবিশ্বাস্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন—রোমান্সের সুর বয়ে নিয়ে চলেছেন, যদিও সময়ের আতঙ্ক-দানবেরা মাঝেমধ্যে তাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়।
“তাহলে নেবেন?” বুড়ো লোকটার কণ্ঠ যেন আমার ভাবনার ফ্রেমে এক কাঁচের ঢিল ছুঁড়ল। “পাঁচ শিলিং দিলেই আপনার।”
এক হাত বাড়িয়ে তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন সেই মোটা, জরাজীর্ণ বইটা। মুখে এমন এক অস্বস্তিকর উদ্বেগের ছাপ, যেন এটাই তার শেষ আশার সম্বল। আহা রে, দরকার! প্রবল, নির্লজ্জ দরকার! আমার শিলিং-পাঁচটাই যেন তার বেঁচে থাকার একমাত্র ভিত্তি। হঠাৎ করেই মনে হল, এতক্ষণ ধরে তিনি নিছক এক চতুর পোষ্য সারমেয়র মতো আমার জন্য পারফর্ম করছিলেন। তার ঔদাসীন্য, তার সংস্কৃতি—সবই এক ব্যবসায়িক কৌশল। প্রতারিত বোধ করলাম। তিনিও সেই একই বিভীষিকার দলভুক্ত, এই অদ্ভুত পরিহাসময় নির্বান-মন্দিরে এক পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ প্রতারক।
তবু, অদ্ভুত এক অবচেতন দয়ার বশে আমি দুটো হাফ-ক্রাউন বাড়িয়ে দিলাম। তিনি নিঃশব্দে কাগজে বইটা মুড়তে শুরু করলেন।
“বিশ্বাস করুন,” বললেন, “এটা ছেড়ে দিতে আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। বইগুলোকে আমি বড্ড ভালোবাসি। কিন্তু এদের একদিন না একদিন যেতেই হয়।”
তিনি এমন এক আন্তরিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন যে আমার মনের তিক্ত বিচারবোধের জন্য লজ্জা লাগতে শুরু করল। তিনিও আমার মতোই এক অনিচ্ছুক বাসিন্দা এই নরকের—আমার মতোই ছুটতে থাকা অথচ থেমে থাকা এক আত্মা।
বাইরে শুরু হয়েছে সন্ধ্যার খবরের কাগজ বিক্রি করার চিৎকার—”জাহাজ ডুবে গেছে!”, “ট্রেঞ্চ দখল!”, “অমুকের নতুন উজ্জীবনী বক্তৃতা!”
আমি আর পুরনো বইওয়ালা একবার চোখাচোখি করলাম, কিন্তু কোনো কথা হল না। কিছু বলার ছিল না। বুঝতে পারছিলাম দুজনেই। আমরাও, গোটা মানবজাতিও, একই পরিণতির মুখে—বস্তুর বিজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একরকমের অসহায় শিকার।
মানুষ মরছে ট্রেঞ্চে, বুড়ো বইওয়ালাও নেমে পড়েছে লড়াইয়ে—জীবনের এই নিরন্তর হত্যাযজ্ঞের মাঝে পদার্থই শেষ হাসি হাসছে। এবং, রিজেন্টস পার্ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম, আমার ক্ষেত্রেও পদার্থই জিতেছে। বইটা অতিরিক্ত ভারী হয়ে উঠেছে, রীতিমতো বোঝা। প্রশ্ন উঠল—আমি ‘রবার্ট দ্য ডেভিল’-এর এই পিয়ানো স্কোর নিয়ে কী করব? বাড়ি নিয়ে গিয়ে কী হবে? আরেকটা বোঝা বাড়বে, আরেকটা নিষ্প্রয়োজনীয় বস্তু আমার চলার পথে ভারী হয়ে ঝুলে থাকবে। এই মুহূর্তে সেটার ওজন ছিল অকল্পনীয়, রীতিমতো ঘৃণ্যভাবে বোঝার মতো।
আমি পার্কের জলসাজানো দিঘির রেলিংয়ে ঝুঁকে, যতটা সম্ভব বিনয়ীভাবে, বইটা গাছগাছালির মধ্যে ফেলে দিলাম।
প্রায় মনে হয়, জীবনের সমস্যার সমাধান খোঁজার চেয়ে, জীবনটাকে জাস্ট টেনে নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। থাকা যথেষ্ট কঠিন, সেখানে বাড়তি ভাবনা চাপিয়ে, সেই অস্তিত্বের কাঁধে আরেকটা বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার মানে হয় না। হয়তো সবচেয়ে বুদ্ধিমান কাজ হচ্ছে মানবজাতির এই ‘অসহ্য অবস্থান’কে বিনা প্রশ্নেই মেনে নেওয়া—“একটা নিয়মে জন্ম, আরেকটা নিয়মে বাঁধা”—এমনটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে সামনের দিকে চলতে থাকা।
ওহ, কী হাস্যকর এই অস্তিত্বের অসুবিধা! এবং তার ওপর আমি পাঁচ শিলিং খরচ করলাম একদম বৃথা, যা এই দুর্ভিক্ষের সময় মোটেই হেলাফেলা করার মতো নয়।
This article was first published on kokshopoth.com