মারিও ভার্গাস ইয়োসা এক অন্তর্দ্বন্দ্বময় বিবর্তনের আখ্যান
তাঁর সাহিত্যিক দৃষ্টিতে এই দ্বৈততা ছিল নিত্যসঙ্গী—একদিকে যেমন তিনি সমাজের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকে তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে ঠিক সেই সমাজেরই প্রাচীন সৌন্দর্য ও মানবিক সম্ভাবনার গুণগান করেছেন। ইয়োসার জন্য প
মারিও ভার্গাস ইয়োসার সাহিত্যজীবনের শুরুটাই ছিল একটি প্রবল অভিঘাত—লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যে তিনি যে-ধরনের দুঃসাহসিক এবং প্রাঞ্জল বয়ানশৈলী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তা দ্রুতই তাঁর উপস্থিতিকে অমোচনীয় করে তোলে। তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাস—The Time of the Hero এবং The Green House—উভয়েই ছিল প্রচলিত গঠনভঙ্গি এবং সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে একরকম স্পষ্ট বিদ্রোহ। প্রথমটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেরুর সামরিক কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে, এবং দ্বিতীয়টি—তার জটিল কাঠামো, বহুতর সময়রেখা ও নানা দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণে—লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যে এক আধুনিকতাবাদী নান্দনিকতা সূচিত করে। ফ্ল্যাশব্যাকের প্রচলিত রীতিকে তিনি অবলীলায় অতিক্রম করে একরৈখিক ধারার ভেতরে বহুরৈখিকতা এনেছিলেন, যেন বয়ানের ভেতরই সময়ের প্রবাহ বহমান হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুধু ভাষিক কৌশলেই নয়—পেরুর সমাজবাস্তবতার যে জটিলতা, শ্রেণি-বৈষম্য, ইতিহাসের ঘূর্ণিপাকে জর্জরিত একটি রাষ্ট্রের অন্তর্দহনের যে-চিত্র, তা তিনি এঁকেছিলেন এমন নিরাবরণ বর্ণনায়, যা একদিকে নির্মম, অন্যদিকে করুণার নির্মিত সৌন্দর্যেই দীপ্ত।
তাঁর রাজনৈতিক পথচলা ছিল একটি অন্তর্দ্বন্দ্বময় বিবর্তনের আখ্যান—যেখানে একদা স্বপ্নমগ্ন মার্ক্সবাদী একদিন হয়ে উঠলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির এক নিবেদিতপ্রাণ প্রবক্তা। এই রূপান্তর কোনো আকস্মিক চেতনার ফল ছিল না, বরং দীর্ঘ হতাশার অন্তর্লীন ফল, যার সূচনা ঘটে কিউবান কবি হেবার্তো পাদিয়ার কারাবরণের মধ্য দিয়ে—একটি ঘটনা যা তাঁর কাছে বাক্স্বাধীনতার অবদমনের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে, রাফায়েল ত্রুহিয়োর মতো স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে তাঁর ধারালো সমালোচনাও স্পষ্ট করে তোলে, যে রাষ্ট্র যখন সন্ত্রাসের যন্ত্র হয়ে ওঠে, তখন তা কেবল শারীরিক নয়, এক প্রকার মানসিক অবরোধও সৃষ্টি করে নাগরিকের মধ্যে।
এই চেতনার ভেতর দিয়েই তিনি ধীরে ধীরে আলিঙ্গন করেন Milton Friedman-এর অর্থনৈতিক তত্ত্ব—একটি রূপান্তর, যা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নয়, বরং ২০শ শতকের লাতিন আমেরিকান চিন্তাজগতের বৃহত্তর পটপরিবর্তনের প্রতিফলন। সেই সময় রাজনৈতিক উচ্চারণ প্রায়শই দুই মেরুর মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েছিল—বাম বনাম দক্ষিণ, বিপ্লব বনাম প্রতিক্রিয়া—এবং তারই ফাঁকে প্রকৃত বিতর্কের সূক্ষ্ম স্তর হারিয়ে যেতে বসেছিল। তিনি এই মেরুবিভক্ত আলোচনাকে পেছনে ফেলে এক অনুসন্ধানী এবং আত্মজিজ্ঞাসামূলক পথ খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন—যেখানে মতাদর্শ নয়, বাস্তবতা এবং নৈতিক বোধ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৯৯০ সালে মারিও ভার্গাস ইয়োসা রাজনীতিতে পা রাখেন—তাঁর সাহিত্যিক যাত্রার এক বিস্ময়কর মোড়, যেখানে কল্পনার চরিত্ররা বাস্তব জীবনের মঞ্চে নামতে চাইল। পেরুর রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হন তিনি, এবং শেষপর্যন্ত পরাজিত হন আলবের্তো ফুজিমোরির কাছে—যিনি কিনা পরবর্তীকালে প্রায় একই রকম অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যকর করেন, যেগুলোর জন্য ইয়োসা সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই নির্বাচনী লড়াই শুধু একটি রাজনীতিকের প্রত্যাখ্যান ছিল না, বরং তা ছিল এক জাতির অন্তর্লীন বিভাজনের নগ্ন প্রকাশ। তাঁর শৈল্পিক উচ্চাশা এবং ইউরোপমুখী মনোভঙ্গিকে অনেকেই গ্রহণ করতে পারেননি—যাঁদের জীবনের সংগ্রাম তিনি এতদিন তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছিলেন, তাঁরাই যেন হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
নির্বাচনী প্রচার-পর্বে পেরুর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি যে কতটা শোচনীয় ছিল, তাও উদ্ভাসিত হয়—নিয়ন্ত্রণহীন মুদ্রাস্ফীতি, দারিদ্র্য আর বেকারত্ব যেন রাষ্ট্রের পাটাতনে পচন ধরিয়েছিল। যদিও তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি, এই পর্ব তাঁর লেখায় বারবার ফিরে আসা একটি প্রসঙ্গের—বুদ্ধিবৃত্তিক আদর্শ আর রাজনৈতিক বাস্তবতার ফাঁকের—জীবন্ত প্রতিফলন। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নেতৃত্বের ভার বহন করার যে-কঠিন বাস্তবতা, তা কেবল তাত্ত্বিক আদর্শে আয়ত্ত করা যায় না; কল্পনার স্বাধীনতা যেখানে শেষ হয়, রাষ্ট্রক্ষমতার দায় সেখানে শুরু।
ভার্গাস ইয়োসার প্রবন্ধগুলিতে বারবার ফিরে আসে এক গভীর হাহাকার—উচ্চ সংস্কৃতির ক্রমাবসান এবং গণমাধ্যম-নির্ভর ভোগবিলাসের প্রতাপ। তাঁর চোখে ‘সংস্কৃতি’ কোনো অর্থনৈতিক কার্যকলাপের আনুষঙ্গিক বা সমাজের অলঙ্কার নয়, বরং নিজস্ব একটি জীবন্ত সত্তা—যার মুখচ্ছবিতে লুকিয়ে থাকে নৈতিকতা, সৌন্দর্য এবং আত্মোপলব্ধির সম্ভাবনা। এক্ষেত্রে তিনি প্রায়শই টি.এস. এলিয়টের বক্তব্যকে সমর্থন করেন—সংস্কৃতির এই সংবেদনশীলতাই মানবজীবনকে গভীরতর করে তোলে, আর যখন তা পণ্যায়নের থাবায় পড়ে, তখন তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠে।
এই সংকটচিহ্নিত চেতনায় তিনি যুক্ত করেছিলেন গি দ্য বোর্দ-এর তত্ত্ব, যেখানে ভোগবাদী সমাজকে বিশ্লেষণ করা হয় ‘spectacle’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে—এক এমন প্রদর্শনমূলক বাস্তবতা, যেখানে আমাদের মনোযোগ ছিনিয়ে নেয় চমক, কিন্তু হারিয়ে যায় প্রশ্ন। ইয়োসার মতে, এই ক্রমাগত প্রদর্শনের আসক্তি মানুষের শিল্পবোধ ও বৌদ্ধিক স্বাধীনতার পরিসরকে সংকুচিত করে তোলে।
তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল নান্দনিক বা দার্শনিক নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক আহ্বান—আমাদের ভাবনার জগতে কীভাবে পণ্য আর প্রগতির নামে শূন্যতা গৃহস্থালি পেতে বসেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার। এতে একদিকে যেমন তাঁর রক্ষণশীল সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের প্রকাশ পাওয়া যায়, তেমনি প্রতিফলিত হয় একটি যুগের আত্মসংকট—যেখানে ‘বিনোদন’ আসন দখল করেছে ‘অন্তর্দৃষ্টি’-র।
ভার্গাস ইয়োসা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্টে লড়েছিলেন—সাহিত্যের স্বাভাবিক আনন্দপ্রাপ্তির জায়গা থেকে, সমালোচনাত্মক তত্ত্বের ঊর্ধ্বস্বরের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাডেমিক পরিসরে সাহিত্যকে যেভাবে বিশ্লেষণের কাঠামোয় ফেলে পাঠ করা হয়, তা পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যের সহজ, আন্তরিক সংলাপকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে পাঠে অনুভবের বদলে কেবল তত্ত্বের বিশ্লেষণ থাকে, সেখানে সাহিত্য তার মানবিক পরিসর হারিয়ে ফেলে।
তিনি প্রশংসা করতেন সার্ত্র কিংবা বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো লেখকদের, যাঁরা তাঁদের সাহিত্যচর্চায় সমাজের রূপান্তরমূলক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁদের লেখায় যুক্তি থাকলেও, তা কখনোই আবেগ বা মানবিক উত্তরণের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু ডিকনস্ট্রাকশনের মতো চিন্তাধারা, তাঁর দৃষ্টিতে, সাহিত্যের পাঠ-প্রক্রিয়াকে এমন এক শূন্য ও নির্বিষ পরিসরে ঠেলে দেয়, যেখানে শিল্প আর কোনো তীব্রতা বা রূপান্তরের ডাক বহন করে না—বরং হয়ে ওঠে নিছক এক ভাষাবিন্যাসের খেলা।
এই সমালোচনার মধ্যে দিয়ে ইয়োসা মনে করিয়ে দেন—সাহিত্য কেবল উচ্চশিক্ষিত পাঠকের এলিট আলোচনার বিষয় নয়। সাহিত্যের কাছে যেতে হলে চাই এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি, অভিজ্ঞতার প্রতি খোলা মন, যা প্রত্যেক পাঠকের নাগালের মধ্যে থাকে। তিনি যে পাঠ-সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখতেন, তা ছিল বোধের, স্পর্শের, অনুরণনের—একটা এমন ভাষা যা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে থেকেও মানুষকে নাড়িয়ে দেয়, তাড়িত করে, রূপান্তরিত করে।
ভার্গাস ইয়োসার যে বুদ্ধিদীপ্ত প্রবন্ধসমূহে আমরা সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তাঁর সতর্ক উচ্চারণ শুনি, The Discreet Hero উপন্যাসটি যেন তারই এক কথাসাহিত্যিক প্রতিধ্বনি—দুটি সমান্তরাল কাহিনির মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন নৈতিক পতন, সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনা এবং আধুনিক জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পারিবারিক বিশ্বাসঘাতকতার অন্তঃস্রোত। লিমা ও পিউরার পটভূমিকায় আবর্তিত দুই প্রধান চরিত্র যেন একে অপরের প্রতিবিম্ব, উভয়েই এক বিকৃত বাস্তবতার মধ্যে চলাফেরা করছেন—যেখানে দুর্নীতি, লোভ আর বিশ্বাসভঙ্গ প্রতিটি সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।
রিগোবের্তো—যিনি তাঁর অবসরের পর এক ধ্যানমগ্ন, সংস্কৃতিসমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখছিলেন—হঠাৎ করেই আক্রান্ত হন বাস্তব জীবনের কঠিন, প্রায় কর্কশ অভিঘাতে। এই সংঘর্ষ, একদিকে কল্পিত সৌন্দর্যের কাঙ্ক্ষা, আর অন্যদিকে সময়ের প্রতিহিংসামূলক অস্থিরতা, উপন্যাসটির কেন্দ্রে এক গভীর বৈপরীত্য এনে দেয়।
এইভাবেই, ইয়োসা তাঁর সাহিত্যিক নির্মাণের ভিতর দিয়ে দেখান যে উচ্চ সংস্কৃতির যে-আকাঙ্ক্ষা, তা আজকের সমাজে কতটা নাজুক ও অসহায়—সাংস্কৃতিক পরিশীলন যেখানে ক্রমশই পরাজিত হয় আর্থিক লাভের বিপরীতে। তাঁর এই কাহিনি কেবল কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নয়—বরং একটি বৃহৎ সমাজের, যেখানে রুচির পরিসর কমে আসছে, নৈতিকতার সংজ্ঞা ক্ষয়ে যাচ্ছে, এবং যেখানে সাহিত্য শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায় সেইসব শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য।
বিদেশে—বিশেষত ইউরোপে—দীর্ঘ সময় কাটালেও মারিও ভার্গাস ইয়োসার হৃদয়ের কেন্দ্রে যে দেশটি চিরকাল অধিষ্ঠান করেছিল, তা তাঁর নিজভূমি পেরু। দেশটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনো প্রশান্ত ছিল না; বরং ছিল এক প্রকার নিরাময়হীন সংক্রমণ—নিজেরই কথায়, এক incurable affliction। পেরুর ভেতরকার জটিলতা, সংঘাত, বৈচিত্র্য, দারিদ্র্য ও গৌরব—এসবই হয়ে উঠেছিল তাঁর সৃষ্টির মূল জ্বালানি। এই আবেগ থেকেই জন্ম নিয়েছে তাঁর রাজনৈতিক আক্রমণ, সামাজিক পর্যবেক্ষণ, আবার সেই ভালোবাসা থেকেই এসেছে সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের প্রতি এক প্রগাঢ় রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি।
তাঁর সাহিত্যিক দৃষ্টিতে এই দ্বৈততা ছিল নিত্যসঙ্গী—একদিকে যেমন তিনি সমাজের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকে তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে ঠিক সেই সমাজেরই প্রাচীন সৌন্দর্য ও মানবিক সম্ভাবনার গুণগান করেছেন। ইয়োসার জন্য পেরু ছিল না কোনো নিটোল স্বপ্নভূমি, আবার নিছক হতাশারও কেন্দ্র নয়—বরং এমন এক দেশ, যার দুর্বোধ্যতা তাঁকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে গল্প বলার দিকে, প্রশ্ন তোলার দিকে, এবং সর্বোপরি ভালোবাসার দিকে।
এই পারস্পরিক টানাপোড়েনের সম্পর্ক—ভালোবাসা আর সমালোচনার মধ্যকার এই স্থায়ী উত্তেজনা—ছিল তাঁর লেখার অন্তঃসূত্র, যেটি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে সৃষ্টিশীল রাখে, জাগিয়ে রাখে, পেরুকে আবারও নতুন করে বোঝার চেষ্টা করে যায়। তাই বলা যায়, পেরু তাঁর কাছে শুধু জন্মভূমি নয়, ছিল তাঁর কল্পনার বিশুদ্ধতম তীর্থ।