গাধা এবং নৌকা: ইতিহাসের আর্থসামাজিক সার্কাসে গাধা কে, নৌকা-ই বা কাকে বলে?
A critical analysis of Chris Wickham’s book, “The Donkey and the Boat”. ক্লাস স্ট্রাগলের গন্ধ শুঁকে বুঝতে হবে গাধাটা কে চড়ায়, আর নৌকাটা কে বয়ে নিয়ে চলে?
কিছুদিন আগে একটা বই পড়ে শেষ করেছিলাম, উদ্ভট নাম। "গাধা ও নৌকা” লিখেছেন ক্রিস উইকহ্যাম। বইটির শিরোনাম যেন একটা রাজনৈতিক স্যাটায়ারের চিৎকার—'গাধাও পড়তে হবে, নৌকাও বুঝতে হবে!' মানে স্থানীয় পণ্যবিনিময় যেমন বোঝা দরকার, তেমনই দূরদূরান্তের ব্যবসা-বাণিজ্যের খেয়াপারও খতিয়ে দেখা চাই। ক্রিস উইকহ্যামের বক্তব্য—অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক চেহারা বোঝা মানে শুধু অ্যাকাউন্টস খাতায় চোখ রাখা নয়, তার ভেতর ক্লাস স্ট্রাগলের গন্ধ শুঁকে নেওয়া। গাধাটা কে চড়ায়, আর নৌকাটা কে বয়ে নিয়ে চলে—এইটাই আসল প্রশ্ন।
অক্সফোর্ডের চিশেল চেয়ারে বসার আগে প্রায় তিন দশক বার্মিংহামের বাতাস গায়ে মেখেছিলেন উইকহ্যাম। ক্লাসঘরের ধুলো আর মধ্যযুগের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি হাতড়ে কাটানো সে সময়টা কেবল শিক্ষকতার নয়, তত্ত্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোরও। আশির দশকে যখন বাজারে নয়া-উদারনীতির ঝড়, তখন তিনি লিখলেন “The Other Transition” (পড়তে চাইলে আমার সাথে যোগাযোগ করুন)—একটা লেখা, যার শরীরে মার্ক্সবাদ আর ইতিহাসচর্চার মিলনরস। তবে নতুন বই The Donkey and the Boat একধাপ এগিয়ে, একধাক্কায় উল্টে দেয় আগের খাতা। এখানে তিনি ফেরত গেছেন উৎপাদন সম্পর্ক আর বিনিময়ের ঘরজামাই সম্পর্কের কাছে। সময়টা? ৯৫০ থেকে ১১৮০—একটা সময়, যাকে নিয়ে অনেকে বেহুশ ছিল, ভাবতো এটাই সেই মৌলিক বাণিজ্য বিপ্লবের সূচনা, যেখান থেকে পুঁজিবাদের বীজ প্রথম অঙ্কুর গজায়। উইকহ্যাম সে কাহিনিতে আবার আলো ফেললেন, তবে এইবার গাধার গাড়ি আর নদীপথের ব্যস্ততা দেখিয়ে।
ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটা ‘হোম-গ্রোন’ আন্দোলন ছিল, যারা গ্লোবাল গরমিলকে কাঁচকলা দেখিয়ে বলেছিলেন—‘বাড়ির খবর রাখো আগে’। উইকহ্যাম সেই ধারা থেকে উঠে আসা লোক। পল সুইজি বনাম মরিস ডবের সেই অমর ‘ফিউডালিজম টু ক্যাপিটালিজম’ WWE রেসলিং ম্যাচ থেকে শুরু করে, যেইখানে একজন বলছেন—‘বাজারই সব’, আর অন্যজন পাল্টা হাঁকছেন—‘ছোট প্রযোজকেরা আসল নায়ক’। উইকহ্যাম এই রিংয়ে বসেছেন উইথ পপকর্ন, কিন্তু জাজ করছেন ছোট লোকগুলোর পক্ষেই। সুতরাং, মাঝযুগীয় ইয়োম্যান বা কামার-লোহার মতো ‘লেসার মেন’-দের পেশাগত প্রাণশক্তিকেই তিনি অর্থনীতির সেলফ-স্টার্টার বলে মনে করেন।
রডনি হিলটন নামক এক মধ্যযুগীয় অর্থনীতির হোমিওপ্যাথ, যিনি বোধহয় ক্লাস স্ট্রাগল আর রুরাল ইকোনমির প্রেমকাহিনি লেখার আগে পেঁয়াজ কাটতেন, তিনিও উইকহ্যামের অন্যতম গুরু। হিলটনের গবেষণায় দেখা গেছে, শোষণের ভিতর দিয়েই বাজার গড়ে ওঠে—সোজা কথায়, ‘ভাত খেলে ঘাম হয়’ নয়, ‘ঘাম ঝরিয়ে ভাত জোটে’।
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন বলেছিলেন, "তুমি যদি পৃথিবীর বাজারব্যবস্থা বোঝো, তাহলে পৃথিবীটাই বুঝে ফেলবে!" উইকহ্যাম তার উত্তরে চোখ ঘুরিয়ে বলেন, “মোটেই না, ভাই! পৃথিবীর খোলনলচে বোঝা মানে তো প্রথমে রান্নাঘরের চাবি খোঁজা।” কারণ পঞ্চাশের দশকের গ্লোবাল থিয়োরিগুলোর ভিতর লোকাল প্যাটার্ন হারিয়ে যায়। মার্কেটের গিয়ার-চেনটা যদি শুধু আমেরিকা-ফ্রান্স-ইটালির এক্সপোর্ট ফিগারে থেমে থাকে, তাহলে যে গ্রামে মেলা বসে, সেটা ব্যাখ্যা করবে কে?
উইকহ্যাম দেখিয়েছেন, মার্কিন এক্সপোর্ট গত ২০০ বছরে একবার মাত্র ১০% জিডিপি ছুঁয়েছে, বাকি সময় গড় ৭%—মানে পৃথিবীর বড় দোকানেও লোকাল চায়ের দোকান থাকেই। লোকার্নো চুক্তি আর ন্যাশনাল লেভেলের পুঁজিপতিরা যাই করুক, পাড়ার বাজারের হাল না বুঝলে অর্থনীতি বোঝা হয় না।
উইকহ্যামের দুনিয়ায় অর্থনীতির ভেতরে যুদ্ধ চলছে—যে যুদ্ধ কৃষক বনাম জমিদার, কামার বনাম কাস্টমস অফিসার। তিনি বলেন, এই দ্বন্দ্বই ঠিক করে দিচ্ছে কার খাটুনিতে কত পয়সা, আর কে সেই পয়সা ঘুরিয়ে বাজারে লাগাবে। সরল ভাষায়—মার্কেট মানে তো শুধু ট্রেড নয়, এটা ক্ষমতার রাজনীতি। হিলটন বলছেন, “জমিদার যদি শোষণ করে, কৃষকও কম যায় না—পাঁচ কেজির জায়গায় তিন কেজি ধান জমা দিয়ে বলে, ‘সার খারাপ ছিল।’”
উইকহ্যামের সমাজচিন্তায় ভেসে আসে কার্ল পোলানির ঘ্রাণ, কিন্তু জলে সাঁতার কাটা শেখান মার্ক্স। কার্ল পোলানি বলেছিলেন, “মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে সম্পর্কের উপরে—রিপ্রোসিটিভ, রিডিস্ট্রিবিউটিভ, এক্সচেঞ্জ।” উইকহ্যাম একটু নাক সিঁটকে বলেন, “তবে ক্লাস স্ট্রাগলের গন্ধ কই?” পোলানি যেখানে 'উৎসবের আদানপ্রদান' নিয়ে গবেষণায় মেতে ছিলেন, উইকহ্যাম সেখানে ‘মেটাফিজিক্স-অফ-মজুরি’ খুঁজছেন।
ডেভিড গ্রেবার আর মার্শাল শেলেন্সের ভাবনা আবার এতটাই কালচারাল, যে অর্থনীতিই তাতে জাদুঘরের বস্তু হয়ে যায়। শেলেন্সের মতে, “প্রত্যেক লেনদেনই একটা সমাজতাত্ত্বিক ঘটনা।” মানে, আপনি পেঁয়াজ কিনছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির ভদ্রতা পালনের পালা চলছে। কিন্তু এই ভাবনা যখন আর্থিক আধিপত্যের বিশ্লেষণে আসে, তখন উইকহ্যামের মতো লোকেরা বলে, “ওটা তো সেন্টার টেবিলে ফুলদানির গল্প, পাশের ঘরে কলের পানি নেই।”
উইকহ্যাম সোজা বলছেন—দুই ধরনের অর্থনীতি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি চালু ছিল। এক, যেখানে কৃষকের ঘাড় ধরে তার উৎপাদন টেনে নেওয়া হয় (ফিউডাল/ট্রিবিউটারি), দুই, যেখানে কাউকে মজুরি দিয়ে কাজ করানো হয় (ক্যাপিটালিজম)। প্রথমটা ছিল ল্যাটিন আমেরিকার ইনকা যুগ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ভারতের লর্ড কার্জনের কুড়েঘর পর্যন্ত। দ্বিতীয়টা—নতুন, তবে অনেক বেশি স্টাডি হয়েছে, কারণ মুঠোফোন আর স্টক মার্কেট থাকলে বই বেশি লেখা যায়।
উইকহ্যামের জোর, যে পদ্ধতিতে উৎপাদন চলে, সেটাই ঠিক করে দেয় রাজনীতি, সামাজিক কাঠামো, এমনকি যে চা দোকানে আপনি চিনি চান বা দুধ চান না, তাও। আর সেই জায়গায় শ্রেণি-সংগ্রাম বসে আছে ছুরি-মাছির মতন। হ্যালডনের মতো উইকহ্যামের গুরুজনেরা বলেন, “যদি ঠিকমতো থিওরি বানানো যায়, তাহলে সেই থিওরি জিজ্ঞেস করবে—'এই ট্যাক্স কে দিচ্ছে, কাকে দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে?'”
নতুন ইনস্টিটিউশনাল ইকোনমিক্স বলে—নিয়ম, প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাস এইগুলোই চালায় দুনিয়া। উইকহ্যাম বলে, “সব ফালতু! ক্লাস স্ট্রাগল না থাকলে এই নিয়মগুলো কেমন করে জন্ম নিল, সেটা বোঝা যায় না।” ইনস্টিটিউশন মানে যদি হয় একটা বিয়ে, তাহলে ক্লাস স্ট্রাগল হচ্ছে শাশুড়ির চোখরাঙানি।
উইকহ্যামের মতে, ছোট প্রযোজকেরা শুধু মাটি চষে বাজারে আলু বেচে না, তারা নিয়ম তৈরি করে, তার বদলে সরকার ট্যাক্স নেন, সেই ট্যাক্স দিয়ে অফিসারদের বেতন হয়, সেই অফিসাররা বাজারে ভর্তুকি দেয়, ফলে আবার কৃষকের আলু বিক্রি বাড়ে—সোজা কথায়, সব টোস্টারের মধ্যে একটা করে শ্রেণীসংগ্রামের স্পার্ক প্লাগ থাকে।
যতক্ষণ না পর্যন্ত গাধার পিঠে চাপিয়ে নেওয়া ধান কেউ বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচছে, নৌকা দিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে রেশম আনছে, আর তার ফাঁকে সরকার, পুঁজিপতি আর মজুররা 'কে কত ভাগ পাবে' তা নিয়ে ঝগড়া করছে, ততক্ষণ ইতিহাস এক আধপাকানো পুঁইশাক। উইকহ্যাম সেই পুঁইশাকে নারকেল কোরা দেয়। বোঝান, বাজার কেবল সংখ্যার খেলা নয়। এটা অনুভব, আধিপত্য, এবং কখনও কখনও শ্রেণি-নাটকীয় ঈশ্বরেরও চক্রান্ত।
সুতরাং, দয়া করে শুধু জিডিপির চার্ট দেখে পৃথিবী ব্যাখ্যা করবেন না। একবার ভাবুন, গাধার ঘামে কারা ভিজছে, নৌকার ছইতে কারা শুয়ে গল্প লেখে।
আর যিনি এসব লিখেছেন, উইকহ্যাম সাহেব—তিনি নিজেই যেন ইতিহাসের এক নিখুঁত তামাশাবাজ, যিনি আমাদের বুঝিয়ে দেন, অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত একটা পারফর্মেন্স। ক্লাস, ক্যাশ, আর কালচার—এই তিনে বাঁধা একটা রাজনৈতিক সার্কাস, যার রিংমাস্টার হচ্ছেন আপনি নিজেই। যদি চান, এক দিন গাধা, আরেক দিন নৌকা। জাস্ট দেখে নিন কে পিঠে চেপেছে।
হ্যাপি রিডিং