শরৎচন্দ্র হেঁটে চলেছেন কুড়ি শতকের হাত ধরে, আর একুশ শতকের বুক চিরে ঢুকলেন বানু মুশতাক। তবে তিনি ঠাকুরবাড়ির লাইব্রেরি থেকে আসেননি, এসেছেন কর্নাটকের আদালতের বারান্দা ঘেঁষে, সঙ্গে রয়েছে বারোটি মেয়ে—কারও আঁচলে দুধ নেই, কেউ আবার নিজের রক্ত মুছে সিঁথিতে দিয়েছে স্বাধীনতা। আর এসব গল্পের নাম—“হার্ট ল্যাম্প”, যেখানে হার্ট শব্দটা ইংরেজি হলেও মশলাদার রসায়নে কন্নড়ে লাল হয়ে উঠেছে। এবং না, কোনও হাউসফুল মাল্টিপ্লেক্সে নয়, ঠিক লন্ডনের টেট মডার্ন-এর চত্বরেই—প্রাইজটা পেল বইটি, বর্ণপরিচয়ের প্রথম পাতার মতো অবাক করে দিয়ে।
বইটি লিখেছেন বানু মুশতাক। পেশায় আইনজীবী, নেশায় সমাজ-খুঁচিয়ে দেখা এক লেখক। তিনি যখন লিখছিলেন, তখন ইনস্টাগ্রাম ছিল না, ট্রেন্ডিং ট্যাগ ছিল না—ছিল শুধু দক্ষিণ ভারতের কিছু মহিলা, যারা তাঁকে এসে বলতেন, “আন্টি, একটুখানি আইনের আলো দেখান।” আর বানু সেই আলোকিত নোটিশ পাঠিয়েছেন গল্পের আকারে।
এবছরের বুকার পুরস্কার তাই মেলেনি কোনও দালান-কাঁচের উপন্যাসকে। মেলেনি সেইসব কাল্পনিক কাহিনিকে, যেখানে লেখক প্যারিসে বসে ইস্তাম্বুল নিয়ে কবিতা লেখেন, চা না খেয়ে কফির গন্ধে সাহিত্য চর্চা করেন। বরং মেলেছে ‘Heart Lamp’-কে, যে বই একটাও “সেক্স সিন” ছাড়াই ‘ইরোটিক ইনজাস্টিস’-কে খুলে দিয়েছে পাটকাঠির মতো।
তবে এটুকু হলেই হতো না। বইটা ছিল কন্নড় ভাষায়। ভাষাটা যে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন মানুষের মুখে ঘোরে, তা আমরা জানি না—আমরা জানি “সাউথ ইন্ডিয়ান” মানে ইডলি-ডোসা। সেই ভুলকে কাঁচা লঙ্কা খাইয়ে ঠিক করেছেন দীপা ভাস্তি। তিনিই অনুবাদ করেছেন বইটি, আর শুধু অনুবাদ নয়, করে দেখিয়েছেন—ট্রান্সলেশন মানে কেবল ‘Translate’ নয়, এটি Transcend-ও।
এই দীপাই প্রথম ভারতীয় অনুবাদক যিনি আন্তর্জাতিক বুকার জিতলেন। এটা প্রায় সেইরকম, যেন হরিপুরার পাড়ার লিটল ম্যাগাজিন “ঝুড়ি" জাতীয় পুরস্কার পেল—তাও আবার স্টিফেন কিং আর মার্গারেট অ্যাটউডদের হ্যাট গলে।
আর যিনি পুরস্কারটা হাতে তুলে দিলেন? ম্যাক্স পোর্টার, সেই লেখক যিনি নিজে বুকার লংলিস্টে ছিলেন। বললেন, “This book glows.” আমরা বলি, “আরে ভাই, হার্ট ল্যাম্প না জ্বলবে তো হ্যারি পটারের ওয়ান্ড জ্বলবে নাকি?”
এবার একটা বিষয় না বললে চলছে না। ভারতের তরফে আন্তর্জাতিক বুকার আগে পেয়েছিলেন গীতাঞ্জলি শ্রী। এবার পেলেন বানু মুশতাক। এবং দুইবারই জিতেছে সেই ভারত, যারা টিভি চ্যানেলের পর্দায় “ভুলে যাওয়া ভারত” বলে একখানা মিথ তৈরি করে, যাতে কারও কারও গল্প সেখানে স্থান না পায়। অথচ ওই ভারতই আবার বুকার মঞ্চে উঠে পড়ে নিজের হারিয়ে যাওয়া ছায়াগুলিকে প্রজেক্টরে তুলে আনে।
সবশেষে বলা যাক—এই বইয়ের প্রকাশক ‘And Other Stories’, একশো কপি ছাপিয়েও যারা ধান্দা করে না, প্রিন্টে প্রথম ভুল হলে জাস্ট হেসে নেয়। এবার তারা বুকার পেল। তাও কেমন যেন চুপিচুপি—না কোনও বলিউডি প্রচার, না সোশ্যাল মিডিয়ায় রিলের মাতামাতি।
তাই বলি ভাই, বইমেলায় গিয়ে “আচ্ছা, নতুন কী পড়বো?” বলে ফেসবুকে স্টেটাস না দিয়ে এই বইটা কিনে ফেলুন। কারণ, এখানে মেয়েরা শুধু 'কান্নার মালা' হয়ে থাকে না, তারা হয়ে ওঠে বুকারের আলোয় ঝলসে ওঠা একেকটা ‘হার্ট ল্যাম্প’।
যে দেশ এখনো বলে “মেয়েরা বাইরে গেলে বিপদ”, সেখানকার মেয়েদের লেখা বই আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলো জ্বালায়। এটাই বইয়ের জয়, এটাই ভাষার বিদ্রোহ। এবং সবথেকে বড় কথা, সাহিত্য আজও শেখায়—লিঙ্গ নয়, ভাষা নয়, শুধু হৃদয় জ্বালালেই আলো আসে। Heart Lamp-এর মতো।