বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধী উত্থান - রিটন খান
বর্তমান বৈশ্বিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিভাবে বিজ্ঞান-বিরোধী মানসিকতা মূলধারায় পরিণত হয়েছে এবং সংস্কৃতি-রাজনীতিতে এরা কত প্রভাবশালী।
অনেকদিন থেকেই উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বুদ্ধিবৃত্তিক-বিরোধীরা কীভাবে সমাজে শক্ত অবস্থান গড়ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা বা রাজনীতি হতে শুরু করে প্রায় সকল ক্ষেত্রকেই প্রাভাবিত করছে। আইজ্যাক আসিমভ একবার বলেছিলেন, “আমেরিকায় একটি অজ্ঞানতার সংস্কৃতি আছে এবং এটি সর্বদাই ছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক-বিরোধী প্রবণতা আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে ক্রমাগতভাবে প্রবাহিত হয়েছে, এই ভ্রান্ত-ধারণা দ্বারা পুষ্ট হয়েছে যে গণতন্ত্র মানে— আমার অজ্ঞতা যা তোমার জ্ঞানের মতোই মূল্যবান।” কথাগুলো আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়, যখন দেখা যায় জগতে বুদ্ধি-বৃত্তিক-বিরোধী চিন্তা-ভাবনা কত দ্রুত ক্রম বর্ধমান।
বিজ্ঞানের উপর আক্রমণ সবচেয়ে বেশি, যা বেশ উদ্বেগজনক। ১৯৯৫ সালে কার্ল সাগানের সর্তকবার্তাটি মনে পড়ে— “মানুষ এমন যুগে প্রবেশ করছে— যেখানে তারা নিত্যদিনের প্রযুক্তি বোঝার ক্ষমতা হারাবে”; আজ যা সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। পৃথিবীর আকার, জলবায়ু পরিবর্তন বা প্রাণীর বিবর্তনের মতো বিজ্ঞানের মৌলিক-তথ্যও আজ প্রশ্নবিদ্ধ; এই ‘অজ্ঞতার উদ্যাপন’ যা বহুআগে সাগান বলেছিলেন। সমাজ আজ বুদ্ধি-বৃত্তিক প্রতারণার শিকার কারণ তথ্য-তত্ত্ব-উপাত্তহীন মনগড়া কথা জনসাধারণে কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, আর বৈজ্ঞানিক মতবাদ-বিরোধী কথা আজ-ফ্যাশন।
আমি প্রায়ই ভাবি আমরা কিভাবে এখানে পৌঁছলাম? বিজ্ঞান-বিরোধী মানসিকতা এত গভীরে প্রবেশ করলো কীভাবে? উত্তর খুঁজতে ইতিহাসের শরণাপন্ন হই। স্ট্যালিনের শাসনকালে বিজ্ঞানীদের উপর অত্যাচার ছিল সবচেয়ে ভীতিকর উদাহরণগুলোর একটি। লিসেঙ্কো নামের এক ভুয়া-বিজ্ঞানী কোনো বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই কৃষিক্ষেত্রে জেনেটিক্স জ্ঞানকে অস্বীকার করে এবং স্ট্যালিনের সমর্থনে এক ভ্রান্ত-তত্ত্ব প্রচার করে; তার এমন ভুল কৃষিনীতির কারণে লক্ষাধিক মানুষ ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ করে। এই ভুয়া-তত্ত্ব অস্বীকৃতির কারণে বহু মানুষকে চরম নিপীড়ন— এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছিল। আমরা কি তবে সে পথেই হাঁটছি?
বর্তমান বৈশ্বিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিভাবে বিজ্ঞান-বিরোধী মানসিকতা মূলধারায় পরিণত হয়েছে এবং সংস্কৃতি-রাজনীতিতে এরা কত প্রভাবশালী। “বিজ্ঞান-বিরোধী এজেন্ডায় সর্বপ্রথম বিজ্ঞানকে ভুল বা ক্ষতিকারক এমন ভুয়া-ধারণা জনপ্রিয় করতে হয় এবং এই প্রবণতা এখন মূলধারায় সহজেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। জলবায়ু-পরিবর্তন অস্বীকারে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো লাভবান হয়, তেমনি বিবর্তনবাদ অস্বীকারে ধর্মীয় মতবাদগুলো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শক্তিশালী আর্থ-রাজনৈতিক পক্ষগুলো নিজ স্বার্থে বৈজ্ঞানিক মতবাদ অস্বীকারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
ধর্মের প্রভাব সবসময় বিজ্ঞান-বিরোধী মনোভাবে বড় ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি ধর্মীয় ঐতিহ্য বা মূলমন্ত্র “বিশ্বাস”কে— চ্যালেঞ্জ করে, ফলে ধার্মিকপক্ষের মধ্যে ভীতি-সঞ্চার হয় এবং তাদের কঠোর প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়। বিজ্ঞান— ঈশ্বর সৃষ্টির মতো ধর্মীয় বিশ্বাসকেও প্রশ্নবিদ্ধ করলে ধার্মিকপক্ষ বিষয়টিকে ব্যক্তিগত হুমকি মনে করে এবং সর্বত প্রতিরোধী হয়ে উঠে। “বিজ্ঞান-বিরোধী-মানসিকতার অন্যতম প্রধান উপাদান— ধর্ম; কারণ উভয়ের অগ্রগতি বিপরীতমুখী এবং বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ ধর্মের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে অবলুপ্তির সম্ভবনার সৃষ্টি করে।” দূর্ভাগ্যক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিও বিজ্ঞান-বিরোধী-মানসিকতায় ক্রমশ আক্রান্ত হচ্ছে, অজ্ঞতা আর কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণের কারণে বিজ্ঞান-বিরোধীতা ক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকেও গ্রাস করছে। সমাজের ন্যায়বিচারমূলক আন্দোলনগুলোকে রাষ্ট্রবিরোধী নাম দিয়ে পুলিশি অত্যাচারকে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদ বিজ্ঞান-বিরোধী মনোভাবের সঙ্গে জড়িত, যা সমাজকে আরও বিভাজিত করছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক-বিরোধীর তিনটি উপাংশ রয়েছে। প্রথমত, ধর্মীয় অযুক্তিবাদীতা (Religious Anti-Rationalism), যার অর্থ অনুভূতিকে তথ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। দ্বিতীয়ত, জনপ্রিয়তাবাদী অভিজাত বিরোধী (Populist anti-elitism) জ্ঞানমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবিশ্বাস। তৃতীয়ত, বাস্তববাদী (Instrumentalism) যেখানে জ্ঞান শুধুমাত্র তখনই মূল্যবান, যখন তা কোনো বাস্তব প্রয়োজন পূরণ করে, সাধারণত সাময়িক লাভের জন্য। এই নীতিগুলোর সমন্বয় নতুন জ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। “সমাজে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষমতাসীনদের উপকারের আসবে এমন ভুল-তথ্য প্রচারিত হয় এবং আগে থেকেই ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জকারীদের চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয়।”
বুদ্ধিবৃত্তিক-বিরোধী তত্ত্বে রাজনীতিবিদ, কর্পোরেশন আর ধর্মীয়প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। জনসাধারণ ক্ষতিকারক এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে সাধারণত অপারগ আর এই সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা বিনা প্রতিরোধেই তাদের কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে। একই কৌশল বিজ্ঞান-অস্বীকারের মতো কাজে ব্যবহৃত হয়; যেমন বর্তমানের অন্যতম বৈশ্বিক-হুমকি জলবায়ু-সমস্যার বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপত্র দেওয়ামাত্র আপনি হয়তো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন।
সবচেয়ে বেশি হতাশ হতে হয়, যখন দেখি ইন্টারনেটে বিষয়ভিত্তিক অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ইনফ্লুএন্সারের কথা গবেষণাভিত্তিক তথ্য, তত্ত্ব আর উপাত্তের চেয়ে বেশি গুরুত্ব, গ্রহণযোগ্যতা আর প্রচার পায়। এই ব্যবস্থার সমূল উৎপাটন না হলে ভয়ঙ্কর-ভবিষ্যৎ সামনে, বড় হুমকিতে ধরণী আর ধরণীস্থ সমস্তকিছু। “ডোন্ট লুক আপ” চলচ্চিত্রে অত্যন্ত সুন্দর করে দেখানো হয়েছে কিভাবে সাধারণ মানুষ কোনো বাস্তব হুমকিতেও রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হয়েছিল; যদি আরেকটি মহামারি বা ভিন্ন কোনো বিপর্যয় ঘটে আমাদের প্রতিক্রিয়াও হয়তো চলচ্চিত্রের সাধারণ মানুষের মতোই হবে। জনসাধারণ বা ক্ষমতাহীনরা রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হবে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করবে আর অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থে তা ব্যবহার করবে।
এই সমস্যার সহজ কোনো সমাধান আছে বলে মনে হয় না; বিজ্ঞান-শিক্ষার প্রচার আর ভুল তথ্য-তত্ত্ব-উপাত্তের উৎসমুখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে সমাধানের প্রথম এবং এই মুহূর্তের একমাত্র পদক্ষেপ। আশার আলো ক্ষীণ মনে হলেও আমার বিশ্বাস সময়ক্ষেপণ না করে যাত্রা শুরু করলেই আলোকিত পৃথিবী বেশি দূরে নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তুষ্ট-পুষ্ট পৃথিবী আবার ফিরে পাবো আমরা সবাই।