একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষতান্ত্রিক অবহেলা সত্ত্বেও নারীর ভূমিকা
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৭ জন নারী সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৭১ সালের নতুন বাংলাদেশ সরকার তাদের একজনকেও অন্তর্ভুক্ত করেনি। এটি কি শুধুই একপ্রকার প্রশাসনিক ভুল ছিল, নাকি এটি ক্ষমতার পুরুষ
একাত্তর যেন এক দীর্ঘ মহাকাব্য, যা কেবল নয় মাসে আবদ্ধ ছিল না। ইতিহাসের পাতা উল্টালে বুঝতে পারি, এটি একদিনে গড়ে ওঠেনি, যেমনটি বিপ্লব কোনো ক্ষণস্থায়ী দহন নয়—এ এক দীর্ঘ সংযত আগুন, যা সমাজের অন্দরমহলে জ্বলে জ্বলে পরিণত হয় দাবানলে। কিন্তু সেই অগ্নিশিখায় নারীরা কোথায়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বললেই চোখে ভাসে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া জনগণ, গণহত্যার নির্মম চিত্র, শহীদদের আত্মদানের কাহিনি। এই ন্যারেটিভ নির্মাণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পুরুষ। ইতিহাস যেন নিজের বিবরণে নারীদের রাখার প্রয়োজনই বোধ করেনি। অথচ, যুদ্ধ মানেই কেবল সম্মুখসমর নয়। যুদ্ধ চলে চোরাগোপ্তা পথে, রাজপথে, সংসারে, মনে। যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রধারীদের পাশে ছুটে চলা সেইসব নারী—যারা তাদের শরীরকে যুদ্ধের মুদ্রায় পরিণত হতে দেখেছে, যারা আশ্রয় শিবিরে রুটি বানিয়েছে, আহতদের সেবা দিয়েছে, কিংবা কেবল আত্মগোপন করেও শাসকের চোখে ধুলো দিয়েছে—তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নয়?
মুক্তিযুদ্ধের প্রথাগত আলোচনায় ‘নারীর ভূমিকা’ বলতে মূলত ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটিই উচ্চারিত হয় বেশি। রাষ্ট্র এক ধরনের প্রতীকী আত্মগ্লানি ঢাকতে গিয়ে ধর্ষিতাদের ‘বীরাঙ্গনা’ বলে গৌরবদানের চেষ্টা করেছে, অথচ একই রাষ্ট্র তাদের পুনর্বাসনে ব্যর্থ হয়েছে। কেবল প্রতিরোধের নয়, সংগ্রামেরও অংশ ছিলেন তারা। কিন্তু এই অংশগ্রহণকে রাষ্ট্র ও সমাজ কেন সীমিত করে দিল শুধুমাত্র ‘বীরাঙ্গনা’র খোলসে?
একটু পেছনে তাকাই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যখন ক্লাব আক্রমণের ঠিক আগে আত্মাহুতি দিলেন, তার চিঠির ভাষা ছিল স্পষ্ট—পুরুষতন্ত্রের ছক ভেঙে নারীও যুদ্ধ করতে পারে। অথচ, ইতিহাস তার আত্মদানের গর্বিত পুনর্লিখন করলেও, তাকে শারীরিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরল উদাহরণ হিসেবেই দেখতে চেয়েছে। কারণ, সমাজ একটিই ভাষ্যকে শক্তিশালী করতে চায়—যুদ্ধ মানেই পুরুষের ব্যাপার।
এই একই মানসিকতা একাত্তরেও বহাল থাকে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর পর প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব নেয় প্রশিক্ষিত পুরুষ সৈনিকরা—ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আনসার। জনগণও ধীরে ধীরে এতে যোগ দেয়। কিন্তু নারী সমাজ? তারা কোথায়? তারা মাঠে নামেনি? তাদের ভূমিকা কি শুধুই ধর্ষিত হওয়া, নির্যাতিত হওয়া, নয়তো পালিয়ে বেঁচে থাকা?
এখানেই মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত বয়ানের গলদ। নারীদের ভূমিকা কেবল ভিক্টিম হিসেবে দেখানো হয়েছে, অথচ প্রতিরোধের বয়ানে তাদের স্থান দেওয়া হয়নি।
নারীরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন, অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, রান্না করে তাদের খাবার জুগিয়েছেন। এমনকি, অনেক নারী বন্দুক হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। নূরজাহান মুরশিদ, বেগম মুজাফ্ফর, সুফিয়া কামালের মত নারীরা শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের নয়, একাত্তরের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতারও অংশ ছিলেন। কিন্তু তাদের এই যুদ্ধকে রাজনৈতিক পুরুষতন্ত্র কেবল ‘সহযোগী’ ভূমিকায় নামিয়ে এনেছে।
এবং এখানে আসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—১৯৭১-এ নারীরা প্রতিরোধ করলেও, ১৯৭২-এ তারা কোথায়? রাষ্ট্র তাদের স্থান দিল কোথায়? স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে নতুন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো, কিন্তু সেখানে কোনো নারী কি ছিল? মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যে সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই সরকারের রূপরেখায় কোনো নারীর স্থান ছিল কি?
"না"—এই ‘না’টুকুই আসলে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর সবচেয়ে নির্মম প্রকাশ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৭ জন নারী সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৭১ সালের নতুন বাংলাদেশ সরকার তাদের একজনকেও অন্তর্ভুক্ত করেনি। এটি কি শুধুই একপ্রকার প্রশাসনিক ভুল ছিল, নাকি এটি ক্ষমতার পুরুষতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের সচেতন প্রয়াস?
আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই—মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের কোনো একটিতেও কোনো নারীকে কমান্ডার বা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ভূমিকার জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অথচ, শরণার্থী শিবিরের হাসপাতালগুলোতে নারীরাই সেবিকা ছিলেন, গেরিলা বাহিনীতে অনেক নারীই কাজ করেছেন। কিন্তু তারা কখনোই স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হননি, বরং তাদের আত্মত্যাগকে নীরবতার মধ্যে চাপা দেওয়া হয়েছে।
আজ, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর, নারী অধিকার ও সাম্যের প্রশ্নে বাংলাদেশ অনেকদূর এগোলেও, সেই যুদ্ধের ইতিহাসে নারীর ভূমিকা আজও অবহেলিত। কারণ, রাষ্ট্রীয় পুরুষতন্ত্র কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, ইতিহাস রচনাতেও প্রভাব বিস্তার করে। রাষ্ট্র যখন ১৯৭১-এর ন্যারেটিভ নির্মাণ করেছে, তখন সেটি একটি সুনির্দিষ্ট ধাঁচে তৈরি হয়েছে—যেখানে মুক্তিযোদ্ধা মানেই পুরুষ এবং নারী মানেই ‘যুদ্ধের শিকার’।
কিন্তু ২০২৪ সালে এসে আমরা কি সেই ন্যারেটিভ মেনে নেব? একবিংশ শতাব্দীর নারী কি কেবলমাত্র ‘বীরাঙ্গনা’র ছাঁচে বন্দী থাকতে রাজি?
আজকের নারী অধিকারের লড়াই কেবল নারীদের লড়াই নয়, এটি বৃহত্তর সামাজিক মুক্তির আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীদের স্থান পুনরুদ্ধার করা মানে শুধু ইতিহাস সংশোধন করা নয়, বরং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা।
আজ, যারা রাজপথে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিচার চায়, তারা কেবল একটি ঘটনা বা একটি আইনের পরিবর্তন চায় না। তারা চায় এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে নারী আর ‘অদৃশ্য’ থাকবে না, যেখানে তার শরীর রাজনীতির হাতিয়ার হবে না, যেখানে রাষ্ট্র শুধুমাত্র পুরুষের নয়, বরং তার প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।
এ লড়াই শুধু বিচার প্রতিষ্ঠার নয়, বরং সমানাধিকারের বাংলাদেশ গড়ার।