বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত বই!
উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ধর্ম ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে হলেও এর ভেতরের গল্প আসলে অভিবাসন, পরিচয় এবং বিশ্বাসের রূপান্তর নিয়ে।
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সালমান রুশদির উপন্যাস The Satanic Verses নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। বইটি যেমন সাহিত্যিক মহলে প্রশংসিত, তেমনই এক ভয়ানক রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সংঘাতের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৮৯ সালের ভালোবাসা দিবসে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রুশদির বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়াটি শুধুমাত্র লেখকের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ নয়, বরং বইটির প্রকাশ এবং প্রচারের সাথে জড়িত সকলকেই মৃত্যুর শাস্তির আওতায় আনা হয়েছিল। এই ধর্মীয় আদেশটি শুধু রুশদি নয়, তার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য নিরীহ মানুষকেও ভয়াবহ বিপদের মুখে ফেলে দেয়।
ফতোয়ার ঘোষণার পরপরই বইটির অনুবাদক এবং প্রকাশকদের উপর আক্রমণ শুরু হয়। ইতালিয়ান অনুবাদক ইত্তোর ক্যাপ্রিওলো গুরুতরভাবে আহত হন, আর জাপানি অনুবাদক হিতোশি ইরাগাশি নৃশংসভাবে খুন হন। নরওয়ের প্রকাশক উইলিয়াম নিয়াগার্ডকে গুলি করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডগুলো সাহিত্যিক জগতের বাইরেও বিপুল প্রভাব ফেলেছিল, প্রমাণ করেছিল যে একটি বই কখনও কখনও কেবল তর্ক-বিতর্কে সীমাবদ্ধ থাকে না, এর রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবও হতে পারে ভয়ংকর।
তবে যতটা বিতর্ক বইটির প্রেক্ষাপটে জন্ম নিয়েছে, আমি মনে করি তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বইটির ভেতরের গল্প—যা কেবল ধর্ম বা বিশ্বাস নিয়ে নয়, বরং মানুষের অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতির সংকট নিয়ে কথা বলে। The Satanic Verses যদি শুধুমাত্র মহাউন্ড অধ্যায়টির উপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করা হয়, তবে তা হবে একপেশে বিচার। এই অধ্যায়টি, যেখানে রুশদি একধরনের স্বপ্ন বা কল্পনার ভেতর দিয়ে নবী মুহাম্মদের কাহিনীকে পুনরায় নির্মাণ করেন, বইটির ৫০০ পৃষ্ঠার সামান্যই অংশ দখল করে আছে। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত অংশের ভিত্তিতে পুরো উপন্যাসকে বিচার করা, আমার মতে, অত্যন্ত সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, রুশদির আসল গল্পটি হল অভিবাসন, পরিচয় এবং বিশ্বাসের পরিবর্তন। বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র গিব্রিল ফরিশতা এবং সালাদিন চামচা, দুজনই ভারতীয় মুসলিম, যারা এক বিমান দুর্ঘটনার পর পরাবাস্তব পরিস্থিতিতে একধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। গিব্রিল পরিণত হয় ফেরেশতা জিব্রিলে, আর সালাদিন পরিণত হয় শয়তানে। এই রূপান্তরগুলো একদিকে যেমন তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে, তেমনই তাদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্নতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। গিব্রিল এবং সালাদিনের এই মানসিক এবং শারীরিক রূপান্তর আমাকে ভীষণভাবে ভাবায়। অনেক অভিবাসীর অভিজ্ঞতা এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে—নিজের পরিচয়ের সাথে লড়াই, নিজেদের মূল সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং নতুন সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চাপ।
বিশেষ করে সালাদিনের চরিত্রটি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সে নিজেকে তার ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, নিজ পরিচয়কে অস্বীকার করতে চায়, এবং এই প্রত্যাখ্যান তাকে আক্ষরিক অর্থে এক শয়তানে পরিণত করে। অন্যদিকে গিব্রিল, একজন জনপ্রিয় অভিনেতা, যার কাজ মূলত দেব-দেবীদের চরিত্রে অভিনয় করা, সেও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এই দুই চরিত্রের যাত্রা আমাদের পরিচয়, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির গভীর প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়।
ধর্মীয় বিতর্কের বাইরে গিয়ে, রুশদির লেখা আমাদেরকে দেখায় কীভাবে অন্ধ বিশ্বাস এবং একগুঁয়ে ভক্তি মানুষকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। বইটির একটি subplot, আয়েশা নামের একটি চরিত্র, যিনি দাবি করেন যে তার মাকে মক্কায় একটি তীর্থযাত্রায় নিয়ে গেলে তার স্তন ক্যান্সার সেরে যাবে, যা বিশ্বাসের বিপদকে তুলে ধরে। তার অনুসারীরা আয়েশার কথায় বিশ্বাস করে, এবং এই তীর্থযাত্রার সময় তাদের অনেকেই মারা যায়। আয়েশার দাবির সত্যতা নিয়ে রুশদি ইচ্ছাকৃতভাবে ধোঁয়াশা রেখে যান—আয়েশা অংশটিতে আমরা বিভিন্ন ধরনের রিপোর্ট পাই, যা পরস্পরবিরোধী। কিছু লোক তাদের নিরাপদে পার হওয়ার কথা বলে, আবার কেউ কেউ বলে তারা সমুদ্রে ডুবে গেছে। এই দোলাচল আমাদেরকে এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়—কোনটাকে আমরা সত্য বলে মেনে নেব?
এই বইয়ের মাধ্যমে রুশদি আসলে আমাদের প্রশ্ন করেন—আমরা বিশ্বাসের পেছনে কত দূর পর্যন্ত ছুটবো? আর সেই বিশ্বাসের নামে আমরা কী কী ত্যাগ করতে প্রস্তুত? এই প্রশ্নগুলো সহজ নয়, এবং রুশদির উত্তরের মধ্যে কোনও সান্ত্বনা নেই। তার গল্পের মধ্যে যে অন্ধ বিশ্বাসের পরিণামগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা মানুষের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে। মানুষ কতটা অন্ধ হয়ে অন্যের কথায় চালিত হতে পারে, এই প্রশ্নটি আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।
রুশদির সাহিত্যের আরেকটি চমৎকার দিক হলো তার পরাবাস্তবতা। বইয়ের চরিত্ররা যেভাবে বাস্তবতার সঙ্গে পরাবাস্তবতাকে মিশিয়ে ফেলে, তা অবিশ্বাস্য এবং চমকপ্রদ। তবে এটা কেবল ফ্যান্টাসি নয়—এটা হলো Magic realism, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে জাদুবাস্তবতার অস্তিত্ব। রুশদির লেখার মধ্যে এই দুটোর মিশ্রণ তার উপন্যাসকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে, এবং আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
The Satanic Verses যে শুধুমাত্র ধর্ম বা অবমাননার গল্প নয়, তা বলা জরুরি। এটি মূলত মানুষের যাত্রা এবং আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার গল্প। এটি এমন এক উপন্যাস যা আমাদের বারবার প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, এবং আমাদের পরিচয়ের জটিলতাকে তুলে ধরে। রুশদির কাহিনী আমাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেয়। শেষ পর্যন্ত, এই উপন্যাস আমাদের বলে যে আমরা সকলেই এক জটিল যাত্রার মধ্যে রয়েছি—এই যাত্রা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।