সাম্রাজ্যের ছায়া থেকে সমঝোতার ভোরে
সমতা-ভিত্তিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে গেলে আমাদের চাই এক নবতর বোঝাপড়া—কীভাবে এই পুঁজিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক গাঁটছড়া খুলে দেওয়া যায়। না হলে, গণতন্ত্র কেবল একটা ‘ট্রেডমার্ক’ হয়ে থাকবে।
অবসানের প্রান্তে সাম্রাজ্য: পুঁজিবাদ, প্রতিরোধ, ও নতুন বিশ্বব্যবস্থার খসড়া
ট্রাম্পের কৌশলী চালচালনাকে যদি দেখেন, আপনি ফিরে যাবেন ত্রিশের দশকের জার্মানিতে—যেখানে ইতিহাস একবার ভুল করেছিল, আর আজকের আমেরিকা সেই ভুলটিকে পুনরাবিষ্কারের পথে। হিটলারের মতোই, ট্রাম্পও ক্ষমতার সংকটে পড়ে ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়, যেনো ‘স্মিথসোনিয়ান’ কোনও সেকুলার বার্নিং বুকসের উৎস। ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সকে বসিয়ে তিনি বললেন, ‘অ্যান্টি-আমেরিকান আদর্শ’ দূর করতে হবে—যেন কুরিয়েটররা নয়, কন্সটেবলরা এখন ইতিহাসের পাহারাদার। এই কাণ্ড শুধু এক ব্যক্তির নয়, বরং গণতন্ত্রের হাড়ে-গোড়ায় লাগা ফাটলের প্রতিধ্বনি। এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে, প্রশ্নটা আরও তীক্ষ্ণ হয়—যদি আয় বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, আর এক ধরনের নাগরিক অতৃপ্তি ক্রমশ বাড়তেই থাকে, তবে আধুনিক গণতন্ত্র কি কর্তৃত্ববাদের শরণ নেয় না? না কি আমরা নিজেরাই তার জন্য পথ বানিয়ে দিচ্ছি?
ভূরাজনৈতিক পালাবদলের আয়নায় তাকালে, পানামা খাল আর গ্রিনল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে আমেরিকার অতীত গৌরব। ট্রাম্প এই পুরোনো ভূখণ্ডগুলো ফিরিয়ে আনার কথা বলেন, যেন শ্লথ পতনের ভিতরেও একটা ঔপনিবেশিক গর্জন তোলা যায়—বলে রাখা ভালো, পতনশীল সাম্রাজ্যগুলোর এটা একটা পুরনো খেলা। বাইরের দিকে আগ্রাসী হুংকার তুলে ভিতরের পচন ঢাকতে চায় তারা—হানিবল যেমন আলপস ডিঙোয়, আর পেছনে রোম ইতোমধ্যেই ভেঙে পড়ে। ট্রাম্পের কথাবার্তায় তাই শুধু জাতীয়তাবাদ নয়, বরং এক অন্তর্লীন অসহায়তা শোনা যায়।
এই পরিস্থিতিতে, যখন আমেরিকা নিজেই নিজের গ্লোবাল অবস্থান নিয়ে দিশেহারা, আর অর্থনৈতিক অস্থিরতা গলা চেপে ধরেছে, তখন প্রয়োজন একটা জাতীয় আত্মবিশ্লেষণ। আমরা কারা? কোথায় যাচ্ছি? আর কাদের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের পরাশক্তি ভাবছি?
ট্রাম্পকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করলেই সংবাদ শিরোনাম জমে ওঠে। ইতিহাসে দুজনই উঠে এসেছেন চাপা উত্তেজনা আর সামাজিক অস্থিরতার পিঠে চড়ে—কিন্তু পটভূমি ছিল আলাদা, খেলার বোর্ড আলাদা, এবং দাবার ঘুঁটিগুলোও ঠিক একরকম ছিল না। কীভাবে একেকটি নেতা, সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে, অতীতের ছায়া নিজের অজান্তেই গায়ে মেখে ফেলেন—সেটাই বোঝা জরুরী । রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ছাঁচগুলো, একদিন জার্মানিতে যেমন দেখা গিয়েছিল, আজকের আমেরিকার আলো-ছায়ায়ও তার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এইখানেই আসে সতর্কতা—যতটা না তুলনার মোহে ঢোকা, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার আজকের জটিল বাস্তবতা খতিয়ে দেখা। নেতার আচরণকে বিশ্লেষণ করতে হলে শুধু ব্যক্তি নয়, চারপাশের টানাপোড়েন, গণমানস, ও অব্যক্ত ভয়-আশংকার সূক্ষ্ম রূপরেখাও ধরতে হয়।
ডান নয়, বাঁ নয়, বরং গোটা কাঠামোতেই ফাটল দেখা গেছে। আমেরিকার দুই প্রথাগত দলই যেন পুরনো ভাড়াটে—দেয়ালের ছোপছোপ ছেঁড়া রঙে তারা ভবিষ্যতের মুখ দেখে না। ডেমোক্র্যাট পার্টি নিজের ভিতরেই টানাপোড়েনে ভুগছে—একদিকে মধ্যপন্থার ক্লান্ত ধ্যানমগ্নতা, আরেকদিকে প্রগতিশীল তরুণদের ধৈর্যচ্যুতি। স্ট্যাটাস কুও যখন বিপর্যস্ত, তখন প্রশ্ন ওঠে—নতুন রাজনৈতিক ভূগোল কি তৈরি হচ্ছে?
ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে, সমাজ যখন দোলাচলে, তখন পুরনো দলিলপত্র বাতিল করে নতুন সংবিধান খোঁজে মানুষ। কখনো সেটা হয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, কখনো নীরব বৈপ্লবিক পরিবর্তনে। আজকের আমেরিকার রাজনীতিতে সেই মেরু বদলের ইঙ্গিত স্পষ্ট—যেন পুরনো দলগুলো ভেঙে ফেলে কোনো নতুন কন্টেইনারে ঢালা হচ্ছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। এই রূপান্তর কেবল আজকের নয়; এটা এক পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, যেখানে শাসনের ধরন বদলায় মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী।
আমেরিকা তার ছেঁড়া ব্যাজ গায়ে, এক অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্য নীতিতে ট্রাম্প থেকে বাইডেন, কেউই সাদাসিধে খেলেননি—শুল্ক আর নিষেধাজ্ঞার খেলায় ঘুঁটি ফেলে ভেবেছেন, প্রতিপক্ষ বসে বসে ধ্বংস হবে। কিন্তু বাস্তবতা চায় অন্য পাঠ। যেমন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে ধরে নিয়েছিল আমেরিকা যে, ইউক্রেন যুদ্ধের খেসারত তারা অর্থনীতিতে দেবে। বাস্তবে হয়েছে ঠিক উল্টোটা—রাশিয়া চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, ভারতের সঙ্গে অদ্ভুত কূটনৈতিক লেনদেনে নেমেছে। বিশ্ববাজারে একটা নতুন অক্ষরেখা তৈরি হয়েছে, আর আমেরিকা সেই মানচিত্রে ক্রমশ একা।
এইখানেই প্রশ্নটা জাগে—আমেরিকার এই একমুখী কৌশল কি নিজেকেই কাবু করছে না? যদি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়, তবে হয়তো পুরনো কৌশল মুছে নতুন অঙ্ক কষতে হবে। কারণ এখনকার অর্থনীতি আর শুধু ডলারের গৌরবে চলে না—এখানে রুবল, ইউয়ান, আর কূটনৈতিক ক্ষিপ্রতাও বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
এলন মাস্করা এখন কেবল প্রযুক্তির রাজারাজরা নন, তারা রাষ্ট্রেরও এক প্রকার নিগূঢ় অনুষঙ্গ—টাকায় মোড়ানো ক্ষমতার নতুন বংশবদ। এই দেরিতে-পেকে-ওঠা পুঁজিবাদের যুগে, ক্ষমতা আর পুঁজির সীমারেখা মুছে যাচ্ছে; রাষ্ট্রের গায়ে এখন কর্পোরেট ট্যাটু। মাস্কের মতো ধনকুবেরেরা যখন মহাকাশ নীতির ব্লুপ্রিন্ট আঁকেন, তখন বোঝা যায়, নীতি নির্ধারণের কাজ আর কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে নেই—বরং তা হয়ে উঠেছে এক ধরণের ইলনিয় সাম্রাজ্য।
এই কর্পোরেট-রাষ্ট্র জোটকে নতুন করে পড়া দরকার, কারণ এ শুধু অর্থনীতির রূপান্তর নয়—এ এক রাজনৈতিক ভূমিকম্প। যাদের হাতে যত সম্পদ, তাদের কণ্ঠেই এখন নীতি। কর্পোরেট ‘কানসেন্ট’ হয়ে উঠছে রাষ্ট্রিক ক্ষমতার নতুন নৈতিকতা।
এইখানে এসে, সমতা-ভিত্তিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে গেলে আমাদের চাই এক নবতর বোঝাপড়া—কীভাবে এই পুঁজিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক গাঁটছড়া খুলে দেওয়া যায়। না হলে, গণতন্ত্র কেবল একটা ‘ট্রেডমার্ক’ হয়ে থাকবে, যার মালিকানা রয়ে যাবে কয়েকজনের হাতে।
ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে যাঁরা হাঁটেন, তাঁরা জানেন—প্রতিটি সাম্রাজ্যই একদিন ক্লান্ত হয়, জয়ধ্বনি থামে, পতাকা ম্লান হয়। রোম হোক, ব্রিটিশ হোক, বা অটোমান—সবাই একসময় ‘অপরাজেয়’ ছিল, যতক্ষণ না তারা ইতিহাসের পালাবদলের বৃত্তে হারিয়ে গেল। আজকের আমেরিকা সেই বৃত্তে দাঁড়িয়ে—হাতের ঘড়িতে বাজছে শেষের আগমনী সুর।
চীন এখন কেবল একটা দেশ নয়, বরং এক আদর্শ—প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠ, বাজারে বিস্তৃত, আর কূটনীতিতে একপ্রকার সুচতুর বাঘ। এশিয়ার দিকে অর্থনৈতিক ভার সরে আসা মানে শুধু বাজার হারানো নয়—এ এক নব্য সাম্রাজ্যিক সংগীত, যেখানে সুরটা আমেরিকার নয়।
এই ইতিহাসপাঠের মধ্যে লুকিয়ে আছে আত্মরক্ষার কৌশল। যদি আমেরিকা তার অতীত জয়গাথা ভুলে গিয়ে নতুন সমীকরণ বুঝতে পারে, তবে হয়তো তার পতনটা বিলম্বিত হবে, হয়তো রূপান্তরের মাধ্যমে সে আবার উঠে দাঁড়াবে। কারণ ইতিহাস শুধু কাঁটা নয়, সে আয়নাও—যেখানে ঝলসে ওঠা ভবিষ্যতের ছবি দেখতে হলে, অতীতের ছায়ায় চোখ রাখতেই হয়।
চীন এক অদ্ভুত কায়দায় ইতিহাসকে বাঁকিয়ে নিয়েছে—মার্কসকে যেমন তারা বইয়ের পাতায় রাখেনি, তেমনি কবরেও পাঠায়নি। বরং মার্ক্সবাদকে তারা লাঙল ধরানো চাষির হাতে তুলে দিয়ে বলেছে, “তোমার কাজ শুরু হোক এখন।”
এইভাবে, একদিকে তারা সমাজতন্ত্রের কাঠামো ধরে রেখেছে, অন্যদিকে বাজার অর্থনীতির হাওয়া টেনে এনেছে ঘরের ভেতর। ফলাফল? এক হাইব্রিড দানব, যেটি পুঁজিবাদের যুক্তি মেনে চলে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখে রাষ্ট্রের কঠোর হাতে। পশ্চিমা মার্ক্সবাদ যেটাকে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা ভাববে, চীন সেটা বানিয়েছে তার কৌশলগত চাল।
এই মডেল আমেরিকার জন্য এক চাপা আতঙ্ক—কারণ এখানে বৈপরীত্য নয়, মেলবন্ধনই নিয়ম। চীনের এই আধা-মার্কসবাদ, আধা-মার্কেট কনফিগারেশন বিশ্বব্যবস্থার ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে, যেখানে ‘স্বাধীন বাজার’ কথাটা শুধু পশ্চিমের সম্পত্তি হয়ে থাকছে না।
এই বাস্তবতা আমাদের বাধ্য করছে—পুঁজিবাদ, যেমনটা আমরা চিনতাম, সেই কাঠামো কি এখন পুনর্বিবেচনার সময়ে পৌঁছেছে? চীনের ছায়া পড়ছে শুধু বাজারে নয়, দর্শনে, কাঠামোতেও।
বিশ্বকমিউনিজমের ইতিহাস এক সরল সিঁড়ি নয়—বরং এক জটিল গোলকধাঁধা, যেখানে ট্রটস্কির কলম আর মাও সেতুংয়ের কামান সমান গুরুত্ব পায়। আলোচনার সূত্রপাত ট্রটস্কির বৈশ্বিক বিপ্লবের স্বপ্ন দিয়ে—যেখানে সমাজতন্ত্র ছিল এক সর্বব্যাপী আগুন। কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধ এসে সে আগুনকে ভাগ করে দিল—একদিকে স্টালিনের কাঠ-কঠিন শৃঙ্খলা, আরেকদিকে মাওর লালবই আর কৃষক-প্রণোদিত বিপ্লব।
মাও প্রথমে সোভিয়েত লাইনে হাঁটলেও পরে সেই রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে দিলেন নিজেই। জন্ম নিলো এক নতুন ধারা—মাওবাদ, যেটা ভিয়েতনাম থেকে লাতিন আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিল এক ভিন্নতর লালচিহ্ন। এই ভাঙন শুধুই আদর্শগত ছিল না, তা ছিল ভূরাজনৈতিক কৌশলেরও চূড়ান্ত রূপ।
আজ, এই ইতিহাসপাঠ আবার প্রাসঙ্গিক, কারণ ইউরোপ ধীরে ধীরে পিছনের সারিতে সরে যাচ্ছে, আর মঞ্চের আলো পড়ছে এশিয়ার দিকে। চীন, তার প্রযুক্তি আর বাজারনির্ভর আধিপত্য নিয়ে, এক নতুন বলয় তৈরি করেছে, যেখানে পুরনো আদর্শিক দ্বন্দ্ব আর নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটছে। এই বাস্তবতাই দেখায়, ক্ষমতার নতুন মানচিত্র আঁকতে গেলে পুরনো মতাদর্শের টানাপোড়েন বুঝে চলতে হয়।
যখন পুঁজিবাদ নিজেই তার চেহারা বদলাতে শুরু করে, তখন ইউরোপের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এক ক্লান্ত শিল্পীর শেষ স্ট্রোকের মতো—ম্লান, কিন্তু স্মরণীয়। সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে এতকাল বিশ্বব্যবস্থার গতি নির্ধারণ করেছে, আজ তা আর চালকের আসনে নেই। এখন চীন দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সেই দোরগোড়ায়—যেখানে সে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং হতে পারে নতুন ধারার নেতৃত্বদাতা।
এই নতুন ধারার গোড়ায় সাম্রাজ্য নয়, বরং সহযোগিতা; কর্পোরেট প্রতিযোগিতা নয়, বরং কৌশলগত সমঝোতা। মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদেরা, বিশেষত পরবর্তী প্রজন্মের, এই সম্ভাবনার কথাই ভেবেছিলেন—এক বিকল্প আধিপত্যহীন বিশ্ব, যেখানে ক্ষমতার মানচিত্র নয়, বরং সংহতির রূপরেখা আঁকা হবে।
এটা কেবল একটি রাজনৈতিক কল্পনা নয়; বরং বাস্তবতার এমন এক সম্ভাব্য রূপ, যেখানে অতীতের সাম্রাজ্যচক্র ভেঙে নতুন জোট, নতুন চিন্তা, নতুন কাঠামো তৈরি হতে পারে।
এই পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটে চোখ মেলে থাকাই আজকের জরুরি রাজনীতি। কারণ, ইতিহাসের স্রোত যেদিকে মোড় নেয়, আমাদের ভবিষ্যৎও গড়ে ওঠে সেই নদীপথে দাঁড়িয়ে।
আটলান্টা
১৭ই এপ্রিল, ২০২৫