প্রথম যখন হান কাং-এর কোনো বই পড়ি, সেটা ছিল ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’। বইটি এতো অদ্ভুত, পড়ার পর কয়েকদিন ধরে আমি অস্বস্তিতে ছিলাম। মূলত এই বইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয় নিয়ে—বিচ্ছিন্নতা বা অ্যালিয়েনেশন। আর এই বিচ্ছিন্নতার গভীরে যাওয়ার জন্য লেখক এমন একটা পথ বেছে নিয়েছেন, যা পাঠককে ভাবনার জালে আটকে ফেলে। তাই, যখন দ্য হোয়াইট বুক সম্পর্কে শুনলাম, তখন আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, যদিও জানতাম এটি তার আগের লেখাগুলোর থেকে ভিন্ন হবে। এবং আমি ভুল ভাবিনি—তবুও আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না যে এটা আমাকে কতটা প্রভাবিত করবে।
একটা ছোট ঘটনা দিয়ে শুরু করি। কয়েক বছর আগে আমি একটা আর্ট গ্যালারিতে গিয়েছিলাম, যেখানে “নেগেটিভ স্পেস” নিয়ে একটি প্রদর্শনী চলছিল। নেগেটিভ স্পেস বলতে বোঝায় সেই শূন্য জায়গাগুলি, যা আমাদের আশেপাশে থেকেই প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে। ওখানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম একটি প্রায় পুরোপুরি সাদা ক্যানভাসের সামনে। প্রথমে মনে হচ্ছিল, হয়ত এটা কোনো কৌশল বা আধুনিক শিল্পের নামে প্রহসন। একটা স্তব্ধ শূন্যতা খা খা করে ওঠে। মনে হচ্ছিল একা আছি, শূন্যতায় আছি। কিন্তু যত বেশি সময় ধরে তাকিয়ে ছিলাম, তত বেশি তা ধ্যানের মতো মনে হচ্ছিল—এক ধরনের নীরব বিদ্রোহ, যেন শূন্যতাকে পূর্ণতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘দ্য হোয়াইট বুক’ পড়া আমাকে ঠিক তেমনই এক অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
‘দ্য হোয়াইট বুক’ কোনো প্রচলিত উপন্যাসের মতো নয়। এখানে কোনো স্পষ্ট কাহিনি নেই, ধারাবাহিক চরিত্রের বিকাশ নেই, এবং এটি কবিতার মতো পড়তে পড়তে হঠাৎ গভীর ধ্যানের মধ্যে ডুবে যেতে হয়। শিরোনামের “সাদা” শুধু রঙের প্রতীক নয়, বরং এর সাথে জড়িত সবকিছুর—পবিত্রতা, জীবন, মৃত্যু, অনুপস্থিতি—একটি প্রগাঢ় প্রতিফলন। কাং এই সাধারণ রংটি নিয়ে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা এবং হারিয়ে যাওয়া বোনের স্মৃতিকে একত্রিত করে একটি গভীর দার্শনিক আখ্যান গড়ে তুলেছেন। ছোট ছোট কবিতার মতো অধ্যায়গুলি প্রতিটি একটি সাদা বস্তুকে কেন্দ্র করে—লবণ, তুষার—যা প্রত্যেকে এক নিজস্ব অর্থে ভরা।
যা আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে, তা হলো তার বোনের অকালমৃত্যু এবং উপন্যাসের স্থান ও প্রেক্ষাপট, ওয়ারশ শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে হান কাং-এর জীবনকে জুড়ে দেওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরটি কাং-এর বোনের মৃত্যুর সাথে এক বিরল সম্পর্ক তৈরি করে। কাং এই ইতিহাসের ভগ্নাংশ এবং যুদ্ধোত্তর সময়ের নিঃসঙ্গতা দিয়ে নিজের বোনের অনুপস্থিতিকে অনুভব করেন। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে—যদি তার বোন বেঁচে থাকতেন, তার জীবনটা কেমন হতে পারত? কী ধরনের মানুষ হতেন তিনি?
এখানে একটা সাধারণ অনুভূতি রয়েছে, যেটা আমাদের সবারই কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। যেমন, এক জায়গায় কাং লিখেছেন, “If you had lived beyond those first few hours, I would not be living now.” এটা শোনার পর গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো একটা অনুভূতি হয়। যেন তার নিজের অস্তিত্বই নির্ভর করছে বোনের অনুপস্থিতির উপর। এই লাইনটা পড়ার সময় আমি নিজের জীবনের “যদি এমন হত” মুহূর্তগুলোর কথা ভাবছিলাম—সেসব মানুষ যারা হয়ত অন্যভাবে বাঁচতে পারত, সেসব জীবন যা অন্যরকম হতে পারত।
‘দ্য হোয়াইট বুক’ পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে যেন এক ধ্যানমগ্ন জগতের মধ্যে প্রবেশ করছি। লেখাটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু আবেগে ভরপুর। কিছু কিছু অধ্যায় তো এক-দুই লাইনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। একটি অধ্যায় আছে, যেটার শিরোনাম “To the stillness”—যেখানে কাং এমন এক মুহূর্তের কথা বলছেন যা স্থির, নীরব, এবং সেই নীরবতা যেন শান্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। এই ধরনের শূন্যতা গোটা বই জুড়ে ছড়িয়ে আছে, যেমন সেই আর্ট গ্যালারির সাদা ক্যানভাসটি ছিল একা, নিঃসঙ্গ কিন্তু গভীর।
তবে শুধু অনুপস্থিতির কথাই নয়, বইটির মধ্যে আশার কিছু ঝলকও আছে। কাং তার বোনের জীবন কল্পনা করে কিছু সুন্দর মুহূর্ত তুলে ধরেছেন—তার হাসি, তার বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, বা তার ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্ত। এগুলো যেন ম্লান এক পৃথিবীর মধ্যে উজ্জ্বল কিছু আলোকরশ্মির মতো, যা অমূল্য।
এখানে একটি বিষয়ের কথা না বললেই নয়, তা হলো ডেবোরাহ স্মিথের অনুবাদ। কাং-এর এই সূক্ষ্ম, কাব্যিক টেক্সটকে এমন দারুণভাবে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করা এক সাহসী কাজ। স্মিথ তার কাজটি নিখুঁতভাবে করেছেন, মূল লেখার মর্মার্থ এবং লিরিক্যাল সৌন্দর্য ধরে রেখেছেন।
‘দ্য হোয়াইট বুক’ সবার জন্য নয়। এটি একটি ধীরগতির বই, যা ধীরে ধীরে উপভোগ করতে হয়। যদি আপনি কোনো উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনি বা প্রচলিত গল্পের আশা করেন, তাহলে আপনি হতাশ হবেন। তবে যদি আপনি আমার মতো সেই শূন্যতার মাঝে সৌন্দর্য খুঁজে পান, শব্দের ফাঁকগুলিতে আলো-ছায়ার খেলা দেখতে পছন্দ করেন, তবে এই উপন্যাসটি আপনাকে অনেক আনন্দ দেবে এবং বহুদিন ধরে ভাবাবে।
আর কী বলব, ‘দ্য হোয়াইট বুক’ আমাকে গভীর এক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে—শুধু জীবন ও মৃত্যুর বিষয়ে নয়, আমাদের সাথে থাকা গল্পগুলি, আমাদের হারানো মানুষগুলো, এবং তাদের জীবনগুলো কেমন হতে পারত সেই ভাবনায়। চলে যাওয়া মানুষদের অনুপস্থিত যেমন আমরা অনুভব করি আবার একই সাথে তাদের স্মৃতির স্থায়িত্বও আশা করি। হান কাং এখানে এমন কিছু সৃষ্টি করেছেন—এমন একটি উপন্যাস, যা বলার চেয়ে না বলা কথাগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার লেখনীর মাধ্যমে।
তাহলে আমি কি বইটি পড়ার পরামর্শ দেব? অবশ্যই। তবে সময় নিয়ে পড়ুন, এবং নীরবতাকে কথা বলতে দিন।
প্রথম প্রকাশিত বাংলা ট্রিবিউন।