ওরা এলো আমার জন্য
যদি আপনি ‘নির্বিচারে’ কাউকে আটকাতে পারেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া, প্রমাণ ছাড়া, বিচারকের সামনে না হাজির করে, তাহলে একদিন কেউ আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। তখন আপনি শুধু বলতে পারবেন—"কিন্তু আমি তো আমেরিকান
এই সপ্তাহে একখানা দুর্দান্ত ফটোসেশন হলো। শ্যুটিং স্পট – এল সালভাদরের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা শিবির। চরিত্র – আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সচিব ক্রিস্টি নোয়েম। ক্যামেরার সামনে তিনি একটু তাক করে দাঁড়িয়েছেন। যেন বলছেন, “জানি আমি কী করছি। আর তা পুরোপুরি ফটোজেনিক।” ক্যামেরার লেন্সে তাঁর প্রতিফলন দেখে আমার মনে পড়ল – এই ছবিটা আর একটা ছবির মতো দেখতে। বা অনেকগুলো ছবির মতো। যেগুলোতে পেছনে শিবির, সামনে একজন রাষ্ট্রশক্তির প্রতিভূ, এবং মাঝখানে হারিয়ে যাচ্ছে বিচারব্যবস্থা।
এই মুহূর্তে আমেরিকা নামক দেশটি গণতন্ত্র নামক অ্যাপের বেটা ভার্সন চালু করেছে, যাতে ‘due process’ বলে একটা ফিচার ছিল—কিন্তু আপডেটে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে।
অভিযান শুরু হয়েছে ২২০ জনের উপর। জাতীয়তা: ‘ভেনেজুয়েলান’। দোষ? কেউ জানে না। আইনি প্রক্রিয়া? ধুত্তোর! নাম, বয়স, উচ্চতা দেখে দেখে ধরে নিয়ে গিয়ে প্লেনবন্দি করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো এল সালভাদরের সেই কারাগারে, যেটি তার খ্যাতির দিক থেকে গুয়ারানতানামোর মাসতুতো ভাই। অনেকে বলছে, ওটা আসলে একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। আমি বলছি না, ওরা বলছে। আমি শুধু ওদের বলাটা একটু চেঁচিয়ে বলছি। কারণ চুপচাপ বললে কেউ শুনবে না।
এমনকি এই তালিকায় যারা ‘নাগরিক’ ছিল, যাদের কাগজপত্র চেকিংয়ে ছিল, যাদের নামেই হজমের ওষুধ বানানো যেত (মানে নিরীহ), তাদেরও পাঠানো হয়েছে। কারণ ‘due process’ এক প্রকার অলসদের বিলাসিতা, ট্রাম্প প্রশাসনের মতে।
তারপর?
তারপর ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল – বোস্টনের রাস্তায় একজন তরুণী, একজন ছাত্র, একজন লেখক, একজন ‘op-ed’ লিখিয়েছেন—ইসরায়েল সম্পর্কে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রতি ছিলেন ক্রিটিক্যাল। ফল? গ্রেপ্তার। কারণ তিনি ছিলেন ছাত্র ভিসায়। এখন তাঁর অবস্থান লুইজিয়ানার এক ডিটেনশন ক্যাম্পে। আইস এজেন্টরা তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। মানে, আপনি লিখছেন, এবং তাতে আপনি থাকছেন না। কারণ সরকার বলে, 'তুমি আর লেখক নও, তুমি আমাদের সমস্যা।'
এটাই যদি না হয় আধুনিক ফ্যাসিবাদ, তাহলে ভোরের আজানটা হয়তো হেভি মেটালের ব্যান্ডের চিৎকার।
অনেকেই বলবে—"ভেনেজুয়েলান গ্যাং মেম্বার, যারা অবৈধ ভাবে এসেছিল, তারা কী করে due process পাবে?"আমি বলব—"একই কারণে, যেটা আপনার নাগরিক সত্তাকে টিকিয়ে রাখে। কারণ due process = প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আপনি নির্দোষ।"
এবং যদি আপনি ‘নির্বিচারে’ কাউকে আটকাতে পারেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া, প্রমাণ ছাড়া, বিচারকের সামনে না হাজির করে, তাহলে একদিন কেউ আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। তখন আপনি শুধু বলতে পারবেন—"কিন্তু আমি তো আমেরিকান!"তখন তারা বলবে—"হ্যাঁ, কিন্তু আপনি গ্যাং সদস্য, বা সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী, বা অন্ততঃ আমাদের মতে তো তাই।"
আপনি তখন কোনও কোর্টে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন না, কারণ কোর্টে যাওয়ার সুযোগও পাবেন না।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—ট্রাম্প প্রশাসন এত ভয় পায় কেন due process-কে?
কারণ, এটা অপ্রকাশ্য রাখতে সুবিধা হয়।কারণ, এতে আতঙ্ক ছড়ানো যায়।কারণ, এতে তারা একজনকেও ছাড়ে না, এবং বাকি সবাইকে বোঝায়—"তুমি চুপ না থাকলে, তুমিও যেতে পারো ওখানে।"
সোজা বাংলায়, ফ্যাসিবাদ মানে কেবল চাকার নিচে মানুষ টেনে দেওয়া নয়, সেটা হলো আইনের ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছিঁচকে নাগরিককে কাগজপত্রহীন বানিয়ে দেওয়া।
এখন অনেকে বলবেন—"ওরা তো আমাদের দেশি নয়!"আমি বলব—"যখন নিয়ম ভাঙা হয়, সেটা শুধু বাইরের লোকদের জন্য না। সেটা আপনাকেও ধরতে পারে। তখন আপনি কী করবেন? বলবেন, ‘আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে’? সেটার ছবি তুলে ইনস্টাগ্রামে দেবেন?"
আমরা এখন এক বিচিত্র যুগে বাস করছি। যেখানে গোপনে কথা বলার দরকার নেই—প্রকাশ্যে কেউ চিৎকার করলেই, পুলিশ এসে নিয়ে যাচ্ছে। এবং আপনি যদি ফেসবুকে বেশি চটান, তাহলে আপনি ‘অপারেশন এল সালভাদর’-এর পরবর্তী কিস্তিতে নায়কের চরিত্রে থাকতে পারেন।
এই প্রজেক্টের নাম হতে পারে—"নেশন বিল্ডিং – সিজন থ্রি: দ্য ডিপোর্টেশন কনসেনট্রেশন"
ক্লাইম্যাক্সে থাকবে—একজন আমেরিকান নাগরিক, নিজেকে প্রমাণ করার কাগজ না পেয়েএকটা গর্তে বসে বলছে—“আমি কি আছি?”অফস্ক্রিন ভেসে আসবে এক কণ্ঠ—“নো ফর্ম, নো হিউম্যান।”
এখনও যদি আপনি চুপ থাকেন, তাহলে মনে রাখবেন,কাল কে যাবে,আজকে সে গেছে।
এই দৃশ্যের পরও যদি আপনার গলা শুকিয়ে না আসে, তাহলে আপনার কাছে গণতন্ত্র কেবলই একটা অ্যাপে ব্যবহৃত পাসওয়ার্ড, যার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে।
আমরা বলি, “Liberty and Justice for All”—কিন্তু এই ‘All’-এর মধ্যেও এখন কাস্টিং কল চলে।কে নাগরিক, কে নন,কে টিপ্পনী লিখেছে, কে চুপ থেকেছে—সবই ফিল্টার।
এইটাই কি আমাদের নতুন সংবিধান?
না হলে, এবার চেঁচান।অন্ততঃ নিজের জন্য।কারণ একদিন আপনিও বলবেন—"কিন্তু আমি তো কিছু করিনি..."হ্যাঁ, ঠিক সেই কারণেই তো আপনাকে তুলে নেওয়া হলো।
শেষ কথা?এই দেশে আজ সবাইই ‘সাবঅল্টার্ন’।কেউ শুধু ক্যামেরার ফোকাসে, কেউ তার বাইরে।
আনন্দে থাকুন। যতক্ষণ না আপনার টার্ন আসে।
প্রথমে ওরা এল কমিউনিস্টদের নিতে। আমি চুপ রইলাম। (কমরেডের লাল টুপি আমার মাথায় ছিল না) তারপর এল সোশ্যালিস্টদের জন্য। আমি আবার চুপ রইলাম। (চুপচাপ থাকা একটা অভ্যাস) তারপর এল ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের ধরতে। আমি চা খেতে খেতে চুপ করে গেলাম। (কাজ নেই, কথা কেন?) তারপর এল ইহুদিদের জন্য। আমি রিমোটের বোতাম টিপে চ্যানেল পালটে দিলাম। (ইহুদি, মুসলমান, খ্রিস্টান—সবারই গলা কাটা যায়, আমার মাথা অক্ষত থাকলেই হল। খবরের পর বিজ্ঞাপন আসে, আমি পাউডার কিনি।) শেষবার—ওরা এলো আমার জন্য। কিন্তু চারদিকে শুধু বাতাস, কেউ ছিল না, কেউই না, বলার মতো কেউ না— (একটা শব্দও ওঠে না, টিউব লাইটের আলোয় শুধু কাঁচভাঙা ছায়া।) বলুন তো, আপনি কোন স্তবকে রয়েছেন? নাকি আপনি সেই নিঃশব্দ বাতাস?