যে বই আমেরিকা গড়ে দিয়েছিল
আড়াইশো বছর পরে এসে অবাক লাগে, Common Sense এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে প্ল্যাকার্ডে, স্লোগানে, উদ্ধৃতিতে।
টমাস পেইন জানুয়ারি ১৭৭৬-এ Common Sense ছাপালেন, উদ্দেশ্য খুব সোজা। তেরোটা ব্রিটিশ উপনিবেশকে বোঝানো যে রাজতন্ত্র নামক জিনিসটা মাথা থেকে নামানো দরকার। ছ’মাস পরেই তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করল। মাঝখানে কোনও জাদু ঘটেনি। ঘটেছিল একটা পুস্তিকা, পাতলা কাগজে মোটা কথা।
আড়াইশো বছর পরে এসে অবাক লাগে, Common Sense এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে প্ল্যাকার্ডে, স্লোগানে, উদ্ধৃতিতে। ট্রাম্প-বিরোধী মিছিলে মানুষ লিখছে, “In America, the Law Is King!” মনে হয় কথাটা আজকের দিনের। অথচ সেটা ১৮ শতকের। পেইনকে ডান-বাম সবাই নিজের মতো করে ব্যবহার করেছে। রোনাল্ড রেগান ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল নমিনেশন নিতে গিয়ে বললেন, “We have it in our power to begin the world over again.” লিবার্টেরিয়ানরা এখনও আওড়ায়, “government… is but a necessary evil।” কিন্তু একটা জিনিস কমই বলা হয়—পেইনের আসল রাগটা ছিল রাজা নামক ধারণাটার বিরুদ্ধে।
আমেরিকান বিপ্লব একদিনে শুরু হয়নি। ১৭৭৫-এর এপ্রিলে লেক্সিংটন আর কনকর্ডে গুলি চলল। মিলিশিয়া ব্রিটিশ সেনাদের বস্টন পর্যন্ত তাড়া করল। জুলাইয়ে জর্জ ওয়াশিংটন ক্যামব্রিজে এসে কন্টিনেন্টাল আর্মির কমান্ড নিলেন। তবু তখনও পরিষ্কার ছিল না, যুদ্ধটা ঠিক কী জন্য। কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের অনেকে তখনও “reconciliation” শব্দটা আঁকড়ে ধরে আছেন। রাজাকে একটু বোঝানো গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে—এই ভদ্রলোকি ভ্রান্তি। ১৭৭৬-এর ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে স্বাধীনতার পক্ষে কোনও অপ্রতিরোধ্য যুক্তি পৌঁছয়নি। ওই দিন Common Sense বেরোল।
ওয়াশিংটনের হাতে বইটা পৌঁছেছিল ঘোড়ার পিঠে। কিংস হাইওয়ে ধরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা জানি, ওঁর কপিটা প্রথম সংস্করণের প্রথম প্রিন্ট। ৩১ জানুয়ারি ক্যামব্রিজ থেকে তিনি লিখলেন, এই পুস্তিকার “sound Doctrine” আর “unanswerable reasoning” যেন মানুষকে সিদ্ধান্তহীন না রাখে। তিন মাসে ১২০,০০০ কপি বিক্রির দাবি করেছিলেন পেইন। ইতিহাসবিদ ট্রিশ লফরান হিসেব কষে বলছেন, এক বছরে ৭৫,০০০-এর বেশি নয়। তাতে কী? তিন মিলিয়ন মানুষের দেশে এত কপিই যথেষ্ট।
প্রশ্ন উঠল, রাজা না থাকলে শাসন করবে কে? পেইনের উত্তর ছিল, কোনও ব্যক্তি নয়। একটা চার্টার। মানুষ নিজেরাই লিখবে, নিজেরাই অনুমোদন দেবে। আজও যখন কোনও ফেডারাল অফিসার সংবিধান রক্ষা করার শপথ নেয়, কোনও রাজাকে নয়, তখন পেইনের সেই প্রস্তাবটাই নীরবে কার্যকর হয়।
পেইনের সাফল্যের বড় কারণ, তাঁর ভাষা। ইতিহাসবিদ এরিক ফনার বলেছেন, Common Sense এক নতুন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করেছিল। জন লক, রুশো, মন্টেস্কু—সবাই ওঁর মাথায় ছিল। কিন্তু নাম নেননি। উদ্ধৃতি দেননি। দার্শনিকদের লম্বা বাক্য তিনি ভেঙে দিলেন ছোট ছোট বাক্যে। এমনভাবে, যেন স্কুলের মাস্টার বোঝাচ্ছেন, কিন্তু গলায় আদেশ নেই, আছে জেদ।
বইয়ের শুরুতেই পেইন একটা এনলাইটেনমেন্ট এক্সপেরিমেন্ট করেন। বলেন, ধরুন কয়েকজন মানুষ নির্জন জায়গায় বসতি করল। “state of natural liberty।” তারপর এল রাজারা। বাগানে সাপের মতো। মানুষ তো জন্মগতভাবে সমান। এই সমতা নষ্ট হলো কী করে? “present race of kings”-এর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, প্রথম রাজা আসলে ছিল “the principal ruffian of some restless gang।” এই উপমা লাইব্রেরির নয়, সরাইখানার।
১০৬৬ সালে উইলিয়াম দ্য কনকারার ইংল্যান্ড দখল করেছিলেন। পেইন বললেন, এতে কোনও “honorable” উৎস নেই। “A French bastard landing with an armed banditti”—এর মধ্যে ঈশ্বরত্ব খোঁজা হাস্যকর। এই ভাষা ভদ্রলোকি নয়। ইচ্ছে করেই নয়।
পেইন জর্জ থার্ডকে ডাকলেন “the Royal Brute of Britain।” আর বললেন, আমেরিকার স্বাধীনতার তারিখ আসলে প্রথম গুলির দিন। লেক্সিংটন আর কনকর্ড। অর্থাৎ ঘটনা হয়ে গেছে। এখন আর পিছোনোর রাস্তা নেই। “A new era for politics is struck।” লাইন টানা হয়েছে, পা পড়ে গেছে।
সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল, তেরোটা আলাদা উপনিবেশকে একসঙ্গে অনুভব করানো। ম্যাসাচুসেটসে যা হচ্ছে, সেটা যেন জর্জিয়ার লোকও নিজের বলে ভাবে। পেইন তাই সহানুভূতির ভাষা ব্যবহার করলেন। “The laying a Country desolate with Fire and Sword,” এটা শুধু কারও একার সমস্যা নয়। প্রকৃতি যাকে অনুভব করার ক্ষমতা দিয়েছে, তার সবার সমস্যা।
তিনি পাঠককে বললেন, কয়েক মিনিটের জন্য কল্পনায় বোস্টনে যান। সেখানকার লোকের দুর্দশাকে নিজের করে নিন। এই কল্পনাই জাতি গঠনের প্রথম খসড়া।
তবে পেইনও সীমাবদ্ধ ছিলেন। উইলিয়াম দ্য কনকারারের বিরুদ্ধে “natives”-এর সম্মতির কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজেই বসতি স্থাপনকারীদের আদিবাসী নিধনকে জায়েজ করেছিলেন। আফ্রিকান দাসদের প্রতি সহানুভূতি ছিল সীমিত। “begin the world over again” কথাটার মধ্যেই একটা বিপজ্জনক ভুলে যাওয়ার রাজনীতি আছে।
তবু প্রশ্নটা আজও জরুরি। Common Sense নিখুঁত কি না, সেটা নয়। প্রশ্ন হল, জটিল সময়ে এর বুদ্ধিটুকু কী কাজে লাগে। পেইন বলেছিলেন, “the law is king।” সঙ্গে শর্ত জুড়েছিলেন। “In free countries, the law ought to be king।” ইতিহাস দেখিয়েছে, আইন প্রায়ই অন্যায় করেছে। ন্যায়সঙ্গত আইনও সমানভাবে প্রয়োগ হয়নি। সম্ভবত পেইন জানতেন, এই রাজনৈতিক পরীক্ষাটা কোনওদিন শেষ হবে না। এটা চলমান কাজ। অসম্পূর্ণ, অস্বস্তিকর, কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়।



