গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন এমন এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, যা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাচীন ও ধনসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের উপর এক আক্রমণাত্মক শাসনপ্রয়াস। প্রেসিডেন্ট অ্যালান গারবার এবং বোর্ডের সিনিয়র ফেলো পেনি প্রিট্স্কারকে পাঠানো এক অত্যুগ্র পত্রে হোয়াইট হাউস দাবি করে, তারা হার্ভার্ডের পাঠ্যক্রম, নিয়োগনীতি এবং ভর্তি-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয় যদি এ দাবি মেনে নিত, তবে তা কেবল আত্মনিয়ন্ত্রণ নয়—শিক্ষার স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শ বিসর্জনের নাম হতো।
হার্ভার্ড এ যুদ্ধে পিছু হটেনি। বরং প্রেসিডেন্ট গারবার এক চিঠিতে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন: “কোনো সরকার—সে যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন—বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কী পড়াবে, কাকে ভর্তি নেবে বা নিয়োগ দেবে, তা নির্দেশ দিতে পারে না।” এই অবস্থান শুধু একক বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়; এটি সমগ্র দেশের উচ্চশিক্ষা কাঠামোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।
হার্ভার্ডের এই সিদ্ধান্ত মোটেও সহজ ছিল না। মাত্র সপ্তাহদুয়েক আগেই ট্রাম্প প্রশাসন ৯ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল ফান্ডিং “পর্যালোচনার” ঘোষণা দেয়, যা হার্ভার্ডের বিপুল ৫০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট চাপের বিষয়। অথচ, এর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রশাসনের চাপের কাছে মাথা নত করার মতো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল—যেমন, ইসরায়েল-বিষয়ক সমালোচনাকে কার্যত অ্যান্টিসেমিটিজমের সমতুল্য ঘোষণা, মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকদের সরিয়ে দেওয়া, পশ্চিমতীরের বীরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা সম্পর্ক স্থগিত, এমনকি প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কমিটিকে শাস্তি প্রদান।
এইসব পদক্ষেপ অনেকেই দেখেছিলেন একরকম “anticipatory compliance” বা প্রশাসনিক সন্তুষ্টির আগাম প্রচেষ্টা হিসেবে—যেমনটা ঘটেছিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, যারা মার্চ মাসে অবৈধ চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। প্রশ্ন হলো, তবে কেন হার্ভার্ড শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করল?
প্রথম কারণ, আপোষ করে কেউ রক্ষা পায় না—তা কলম্বিয়া আমাদের দেখিয়েছে। $৪০০ মিলিয়নের তহবিল হারানো সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও নতুন দাবির মুখে পড়তে হয়েছে, এমনকি প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণের হুমকিও এসেছে। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ক্যাটরিনা আর্মস্ট্রং-এর পদত্যাগও এই প্রেক্ষাপটে ঘটেছে। একইভাবে দেশের প্রভাবশালী নয়টি আইনি প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের সঙ্গে আপোষ করে এক বিলিয়ন ডলারের সমান pro bono সেবা দিতে রাজি হয়েছে—মূলত বেআইনি হুমকির সামনে আত্মসমর্পণ করেই। অথচ চারটি প্রতিষ্ঠান আইনি পথে লড়ে জয়লাভ করেছে।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের দাবি এতটাই অযৌক্তিক ছিল যে হার্ভার্ডের কাছে তা প্রত্যাখ্যান ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন, নিয়োগে “দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য” নিশ্চিতকরণ, বিদেশি ছাত্রদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই, DEI কার্যক্রম বিলুপ্তি, প্যালেস্টিন-পন্থী সংগঠন ও ন্যাশনাল লইয়ার্স গিল্ড নিষিদ্ধকরণ—এসব ছিল একটি অশুভ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার স্পষ্ট ছক। এবং, অবশেষে চিঠিটিকে “অননুমোদিত” বললেও প্রশাসন তা ফিরিয়ে নেয়নি।
তৃতীয়ত, জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের কণ্ঠস্বর হার্ভার্ডকে সাহস জুগিয়েছে। প্রায় হাজারখানেক সাবেক শিক্ষার্থী, শত শত অধ্যাপক এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ল্যারি সামার্স একযোগে শিক্ষাগত স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। প্রিন্সটন, ওয়েসলিয়ান, জর্জটাউন—এমনকি ইয়েল ও স্ট্যানফোর্ডের নেতারাও প্রকাশ্যে হার্ভার্ডের সমর্থনে মুখ খুলেছেন। এই সম্মিলিত প্রতিরোধ একটি শক্তিশালী সিগন্যাল—নীরবতা নয়, প্রতিবাদই ভবিষ্যতের পথ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবিলম্বে ২.২ বিলিয়ন ডলারের অনুদান স্থগিত করেছেন এবং হুমকি দিয়েছেন হার্ভার্ডের কর-ছাড় অবস্থা বাতিল করার। এমনকি ছাত্রদের বিরুদ্ধে ভিসা-বাতিল ও “বিদেশনীতি ক্ষতিগ্রস্ত” করার অভিযোগ আনা হয়েছে, যেমনটা কলম্বিয়া, জর্জটাউন ও টাফটসের ছাত্রদের বিরুদ্ধে হয়েছে। প্রশাসন হয়তো জানে না—এ লড়াই একতরফা নয়।
এই লড়াই কেবল হার্ভার্ডের নয়, এক রাষ্ট্রের শিক্ষার স্বাধীনতা বনাম কর্তৃত্ববাদের সংঘর্ষ। সংবিধানিক প্রেক্ষিতে প্রশাসনের কোনো ভিত্তি নেই, প্রথম সংশোধনী এই ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করে। হার্ভার্ড যদি জেতে, তবে তা উচ্চশিক্ষার জন্য এক ঐতিহাসিক বিজয় হবে; যদি হারে, তবে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
আটলান্টা
২১শে এপ্রিল, ২০২৫