অশ্রুমিশ্রিত হ্যামলেট, সমুদ্রস্নাত ওডিসি, আর জেমস জয়েসের গিঁটধরা ‘ইউলিসিস’-যেন ‘চোখের জল ফেলে পাঠ্যপুস্তক’
ইউলিসিসকে ফ্লোবেরের উত্তরাধিকারী হিসেবে ধরা যায়—যিনি যেন তাঁর শেষ, অসমাপ্ত গ্রন্থের জায়গা থেকে শিল্পের সেই রেখাটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আরও দূর। .. . এমন এক বই, যা কোনও সিরিয়াস লেখকের এড়ানো চলে না।
মি. এজরা পাউন্ড মেরক্যুর দ্য ফ্রঁস-এ লিখেছেন: কিছু নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইউলিসিসকে ফ্লোবেরের উত্তরাধিকারী হিসেবে ধরা যায়—যিনি যেন তাঁর শেষ, অসমাপ্ত গ্রন্থের জায়গা থেকে শিল্পের সেই রেখাটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আরও দূর। এই উপন্যাসটিকে একধরনের ‘সোনাটা’র আদলে নির্মিত উপন্যাস বলাই চলে। এটি হোমারের ওডিসির মহাকাব্যিক ছায়াপথ অনুসরণ করে—বহু ঘটনার সঙ্গে মিল থাকে, কখনও হুবহু, কখনও ধোঁয়াটে। এইভাবে রচনাটির কাঠামো একরকম নিয়ন্ত্রিত হয়। এমনকি বলা যায়, ফ্লোবেরের উপন্যাসগুলোর চেয়েও এটির গঠন দৃঢ়। একটা অর্ধলাইনও খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে চিন্তার ঘনত্ব কম পড়েছে—এমন এক দীর্ঘ ও শ্বাসরুদ্ধকর আখ্যানের মধ্যে। এটাকে নিখাদ বাস্তববাদী উপন্যাসও বলা যায়, যেখানে প্রতিটি চরিত্র নিজের মতো করে কথা বলে, যার বাইরের জগতেও নির্ভরযোগ্য প্রতিফলন রয়েছে। . . এমন এক বই, যা কোনও সিরিয়াস লেখকের এড়ানো চলে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ক্লাসে প্রথম দিনেই শিক্ষক বললেন, ‘ইউলিসিস’ পড়ার আগে পড়তে হবে হোমারের ওডেসি আর শেক্সপিয়রের হ্যামলেট। শুনে মনে হল, বই পড়া নয়, যেন বিয়ের আগে শালার বিয়ে অ্যারেঞ্জ করে আসা লাগবে। এরপর এল “recommended readings”—তালিকাটা দেখে মনে হল যেন রামের বনে যাবার আগে শত্রুঘ্নর বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র বিলি করছি।
আমি হোস্টেলের খাটে বসে ভাবছি, “এ তো যুদ্ধে যাবার ট্রেনিং-এর চেয়েও দুঃসাধ্য।" তখনই মনে পড়ল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর উক্তি: “তাইলে হালায় যুদ্ধেই যামু না।” আমিও ভাবলাম, ইউলিসিস পড়া মানেই যদি এমন ডারউইনীয় ইভল্যুশনের প্র্যাকটিকাল এক্সাম হয়, তাহলে যুদ্ধেই যাব না। কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস না হোক, পাশ তো করতেই হবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে ফেললাম।
আসুন দেখি ইউলিসিস বুঝতে হলে কী কী বই পড়তে হয়, যেন এটা পাঠ্যতালিকা নয়, গোয়েন্দা বিভাগে যোগদানের আগে ডোপ টেস্ট। (গোপন তথ্য; আমি ওই সব বোনাস বই পড়িনি)
The New Bloomsday Book – যেন ইউলিসিসের স্ক্রিপ্টের স্ক্রিপ্ট।
A Reader’s Guide to James Joyce – পাঠকের গাইড বই পড়ার গাইড।
James Joyce’s Ulysses (Stuart Gilbert) – ইউলিসিসকে ইউলিসিস বানানো পুরোহিতদের পূজা-পাঠ।
Critical Essays (edited by Clive Hart & David Hayman) – যেন ওয়াই-ফাই না থাকলে ইউলিসিস বুঝতে পারবেন না, এই তাদের গ্রন্থিপূর্ণ ওয়্যারলেস সংযোগ।
আর যাঁদের মনে পড়ে, যে বইটা পড়ার আগেই পাণ্ডুলিপি তৈরির খোঁজে দিন গুনছেন, তাঁদের জন্য আছে:
Ulysses: The Mechanics of Meaning (Hayman) – এখানে ‘মিনিং’ শব্দটাই অন্ধকারে ভিজে থাকা মশারির মত।
Joyce's Voices – জয়েসের কানে কে কী বলছে, তার প্রতিধ্বনি।
The Argument of Ulysses – বইটা যেন তর্কের বিয়ে বাড়ি।
Ulysses on the Liffey – লিফফি নদী জলের চেয়ে ব্যঞ্জনায় বেশি তরল।
জয়েসের জীবনের ঝগড়াঝাঁটি জানতে হলে:
James Joyce (Ellmann) – জয়েসের জীবনের হাই ডেফিনিশন ড্রামা।
Shakespeare and Company (Sylvia Beach) – যেখানে বই ছাপা হয়েছিল, আর যেখানে সাহিত্যিকেরা গোপনে কাঁদতেন।
আর যদি আপনি ইউলিসিসের 'পথ চলা' জানতে চান:
James Joyce’s Dublin – যেন বর্ণমালার জন্য রাস্তা বানানো হয়েছে।
The Ulysses Guide (Nicholson) – যাত্রা নয়, যেন জয়েসীয় ট্রেজার হান্ট।
ইউলিসিস: মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দৈনন্দিন জীবন দেখার মহাভারত
ইউলিসিস একমুখো গালভরা উপন্যাস নয়। এটি 'নভেল অফ অ্যা নভেল ইন অ্যা নভেল'। জীবনের এক দিন, এক শহর, দুই পুরুষ, আর উনিশ ঘণ্টা সময়ের ভিতর দিয়ে ভাষার সমস্ত সীমা ভাঙার নাম—ইউলিসিস।
Stephen Dedalus: একজন শিক্ষক, যার হৃদয়ে দার্শনিকতার আগুন, কিন্তু তাতে পোলাও রান্না হয় না। শুতে যায় পতিতালয়ে, ঘুমায় ফুটপাথে, জেগে থাকে মাতালের কণ্ঠে।
Leopold Bloom: বিজ্ঞাপনের লোক, যার দিন শুরু হয় ব্রেকফাস্ট দিয়ে, আর শেষ হয় স্টিফেনকে আশ্রয় দিয়ে। তার স্ত্রী মলি দুপুরবেলা অন্য এক পুরুষের সঙ্গে বিছানায় যায়, এবং ব্লুম সেটা জানেন। কিন্তু সে চিৎকার করে প্রতিবাদ করে না, শুধু ভেতরে ভেতরে ভাঙে।
বইটিতে ঘটনা কম, ভাবনা বেশি। যে ভাবে আপনি বাসে বসে কেউ একজন হাঁচলে ভাবেন, “আমি কি গায়ে লাগিয়ে নিলাম?”—তেমনি বইটাও। হাঁচি থেকে শুরু করে ঈশ্বর, মাতৃত্ব, দেশপ্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা—সবই ঘাই খাচ্ছে।
বইটা পড়তে পড়তে কখনও মনে হবে আপনি ট্রেনের জানালার পাশে বসে দার্শনিক তন্ময়তায় হারিয়ে গেছেন, কখনও মনে হবে আপনি পাঠশালার ছাত্র হয়ে গেছেন—পাস করতেই হবে।
আমি ওই সব বোনাস বই পড়িনি। আমার পড়ার পাসপোর্ট ছিল, ভিসা ছিল না। কিন্তু আমি ইউলিসিস পড়ে বুঝলাম—এই বইটা একটা গদ্যের চন্দ্রযান। শব্দের মাধ্যমে ভাবনা ও ভাষার সেইসব অলিগলি খুলে দেয়, যা দৈনন্দিন জীবনের মোড়কে লুকিয়ে থাকে।
এটা শুধু পড়ার বই নয়, এটা মাথা ঠুকে বোঝার বই। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হয়, বুঝে না পড়লে বরং মজা বেশি।
এই উপন্যাস বুঝতে গেলে নয়, ভুলতে গেলে লাগে সাহস। যেমন Stephen বলে—
History is a nightmare from which I am trying to awake.
আর Leopold Bloom যেন পুরো উপন্যাসে ঘুমোতে গিয়ে বেঁচে ওঠেন।
তাই বলি, যারা ইউলিসিস পড়ে ‘সত্যি কিছুই বুঝিনি’ বলেন, তাঁদের সম্মান করি। আর যারা বলেন ‘সব বুঝে ফেলেছি’—তাঁদের জন্য ভানুর জবাব, “হালায়, যুদ্ধেই যাইবা না।”
তাই ভাবছি ইউলিসিস নিয়ে একটা সিরিয়াস প্রবন্ধ লিখে ফেলি। পড়তে চাইলে কমেন্টে জানাবেন। অবশ্য না জানালেও লিখবো তাতে কোন সন্দেহ নেই।
done