ফারাহ দাভোইওয়ালার বই What is Free Speech?
ইতিহাস হিসেবে বইটি খানিকটা হতাশ করে। বাকস্বাধীনতা রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে আঠারো শতকের ব্রিটেন ও আমেরিকায় স্পষ্ট রূপ পায়, ঠিকই। কিন্তু ধারণা হিসেবে তার শিকড় অনেক গভীরে।
সহিষ্ণুতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি নয়। ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়েই মানুষ কী ভাববে, কী বিশ্বাস করবে, কোনটা সত্য, কোনটা নৈতিক, তার একটা তালিকা আগেভাগেই বানানো থাকত। সেই তালিকা নামত ওপর থেকে। ঈশ্বরের নামে, ঈশ্বরের প্রতিনিধির নামে, বা ঈশ্বর-মনোনীত শাসকের নামে। ভিন্নমত মানে শুধু মতভেদ নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কখনও আইন দিয়ে, কখনও বলপ্রয়োগে, কখনও সমাজের চোখরাঙানিতে, ভিন্নস্বরে কথা বলাকে চেপে রাখা হয়েছে।
ফারাহ দাভোইওয়ালা তাঁর বইয়ে দুটো কাজ করতে চান। প্রথমত, বাকস্বাধীনতার ইতিহাসকে তিনি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা ও রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে খতিয়ে দেখেন। দ্বিতীয়ত, এই ধারণার সীমাবদ্ধতা, অসঙ্গতি ও অন্তর্নিহিত টানাপোড়েনগুলোর দিকে আঙুল তোলেন। তিনি বাকস্বাধীনতার বিরোধী নন, তবে সমর্থক হিসেবেও খুব উৎসাহী নন। তিনটি হাততালির বদলে এখানে বড়জোর একটা ক্ষীণ, অনিচ্ছুক তালি জোটে।
ইতিহাস হিসেবে বইটি খানিকটা হতাশ করে। বাকস্বাধীনতা রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে আঠারো শতকের ব্রিটেন ও আমেরিকায় স্পষ্ট রূপ পায়, ঠিকই। কিন্তু ধারণা হিসেবে তার শিকড় অনেক গভীরে। সেই কারণে দাভোইওয়ালার এই দাবি বিস্ময়কর যে ১৭২১ সালে দু’জন তুলনামূলক অখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক, থমাস গর্ডন ও জন ট্রেঞ্চার্ড, তাঁদের Cato’s Letters কলামের মাধ্যমে নাকি আধুনিক রাজনৈতিক বাকস্বাধীনতার ধারণা “আবিষ্কার” করেন। এতে ইরাসমাস, মিল্টন, বেইল, স্পিনোজা, লক প্রমুখ চিন্তকের প্রতি ন্যায় করা হয় না। তাঁদের লেখা তখনকার ক্ষমতার চোখে ছিল যথেষ্ট বিপজ্জনক। দাভোইওয়ালার পরবর্তী ইতিহাসবর্ণনা তুলনামূলকভাবে প্রচলিত ধারার, কিন্তু তথ্য বাছাই এতটাই নির্বাচিত যে বোঝা যায় লেখকের নিজের সংশয়ই এখানে চালকের আসনে।
এই সংশয়গুলোই বইটির সবচেয়ে চিন্তাজাগানিয়া অংশ। সেগুলো ধীরে ধীরে সামনে আসে, তবে মোটামুটি তিনটি মূল আপত্তিতে ধরা যায়। প্রথমত, তাঁর মতে বাকস্বাধীনতার ধারণা নিজেই অসংগত, কারণ বাস্তবে এটি সর্বদাই ব্যতিক্রম ও শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ। এই ব্যতিক্রমগুলো যুগের পূর্বধারণা বহন করে, ফলে ধারণাটি একসময়ে পরিণত হয় অর্থহীন স্লোগানে। দ্বিতীয়ত, তিনি হেরবার্ট মার্কুসের ‘Repressive Tolerance’-এর যুক্তি টানেন। বাকস্বাধীনতা আসলে ধনী ও ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার, কারণ প্ল্যাটফর্মে তাঁদের প্রবেশাধিকার বেশি। তৃতীয়ত, বাকস্বাধীনতা নাকি ‘group libel’ বা আজকের ভাষায় ‘hate speech’-কে উৎসাহ দেয়, যা সংখ্যালঘুদের অপমান ও ক্ষতির পথ খুলে দেয়। তাই তাঁর প্রস্তাব, যেমন আর্থিক পরিষেবা নিয়ন্ত্রিত হয়, তেমনই বাককেও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
দাভোইওয়ালার উদাহরণ নির্বাচন মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও দাসপ্রথার প্রতি ক্ষোভ দ্বারা চালিত। তিনি দেখান, ব্রিটেনে ঘরে বসে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল, অথচ উপনিবেশে দাস ও আদিবাসীদের সেই অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। এই সূত্রে তিনি জন স্টুয়ার্ট মিলকে দেখেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ও ভারতে বাকনিয়ন্ত্রণের সমর্থক হিসেবে, উদারনীতির প্রধান প্রবক্তা হিসেবে নয়। এতে মিলের চিন্তার কেন্দ্রীয় যুক্তি অনেকটাই আড়ালে চলে যায়।
বইয়ের শিরোনামের প্রশ্নের উত্তর আসলে বেশ সোজা। বাকস্বাধীনতা মানে তথ্য ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাহ্যিক বাধার অনুপস্থিতি। বিতর্কটা মূলত এই বাধা কোথায়, কখন এবং কেন আরোপ করা যাবে, তা নিয়ে। মতপ্রকাশ ক্ষমতাকে দুর্বল করে, তাই যেখানে শাসন সম্পূর্ণরূপে বলপ্রয়োগের ওপর দাঁড়িয়ে, সেখানে এর জায়গা নেই। দাস, উপনিবেশিক প্রজা, কিংবা আজকের রাশিয়া ও চীনের নাগরিক—সবার ক্ষেত্রেই সেন্সরের যুক্তি মূলত এক।
বাকস্বাধীনতায় আমাদের বিশ্বাসের দুটো বড় কারণ আছে। প্রথমত, মতপ্রকাশে বাধা আমাদের নৈতিক ও চিন্তাশীল সত্তাকে খর্ব করে। রাষ্ট্র যখন এই বাধা দেয়, তখন নাগরিককে সে ক্ষমতার যন্ত্রে পরিণত করে। এই সম্পর্ক নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। দ্বিতীয়ত, সত্য ও প্রজ্ঞার একচেটিয়া মালিক কেউ নয়। শুধু মানুষের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার জন্য নয়, বরং সত্য নিজেই গতিশীল। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বাড়ে, সত্যও বদলায়।
একসময় মানুষ বিশ্বাস করত সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, কারণ বাইবেলের অনুমোদন ছিল। একসময় দাসপ্রথা, নারীর নিকৃষ্টতা, সমকামিতার দমন সামাজিকভাবে স্বীকৃত ছিল। সংখ্যালঘুরাই শেষ পর্যন্ত এই ধারণাগুলোর ভাঙন থেকে লাভবান হয়েছে। মিল যাকে বলেছিলেন ‘collision of adverse opinions’, তা সব সময় সত্য দেবে এমন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ভালো ফল দেয়।
বহুত্ববাদী সমাজেও বাকস্বাধীনতা সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সেই সীমা সব সময় অসংগত নয়। প্রচলিত আইন সাধারণত শব্দ ও কর্মের মধ্যে পার্থক্য করে। শব্দ তখনই অপরাধ, যখন তা সরাসরি হিংসা উসকে দেয়। ২০২৪ সালে অভিবাসন হোস্টেলের সামনে দাঙ্গায় উসকানি দেওয়া সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে সাজা দেওয়ার যুক্তি এখানেই।
আইনগত নিয়ন্ত্রণ মানেই বলপ্রয়োগ। উদার সমাজে তা ন্যায্য কেবল তখনই, যখন তা অন্য ধরনের বলপ্রয়োগ ঠেকাতে প্রয়োজনীয়। ব্রিটেনের Public Order Act 1986-এর 3A ধারা, যা ঘৃণামূলক বক্তব্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে, সেখানে সমালোচনা, বিদ্রূপ, অপছন্দ প্রকাশের স্পষ্ট ছাড় রয়েছে। দাভোইওয়ালা শব্দ ও কর্মের পার্থক্য মানতে চান না। কিন্তু এই পার্থক্য বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত। অপমানজনক কথাও সাধারণত বলপ্রয়োগ নয়, যতক্ষণ না তা হিংসার ডাক দেয়।
মুক্ত মতপ্রকাশের দুনিয়ায় ভুল, আঘাতকারী ও ক্ষতিকর কথা হবেই। কিন্তু কোনটা স্পষ্টতই ভুল, সেই মানদণ্ডও বিপজ্জনক। একসময় যা স্পষ্ট সত্য ছিল, পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ভুল ও প্রজ্ঞার মাঝের সীমারেখা প্রায়ই বিতর্কযোগ্য। সত্য ও জ্ঞান চাইলে ভুল ও বোকামিকেও সহ্য করতে হয়। বিকল্প হল আমাদের চিন্তার বড় অংশ রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া। রাষ্ট্রের জ্ঞান, নিরপেক্ষতা বা প্রজ্ঞা আমাদের চেয়ে বেশি—এই দাবি ইতিহাস কখনও সমর্থন করেনি।



