স্ক্রল করতেই থাকি—কেন থামতে পারি না?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্ক্রল প্রযুক্তিনির্ভর পরিসর ক্রমাগত ব্যক্তিকে তার নিজের অবস্থান নিয়ে এক প্রকার আত্মসংশয়ে ঠেলে দিচ্ছে—যেখানে অন্যের সুখ যেন তার নিজের ব্যর্থতার প্রামাণ্য চিত্র হয়ে ওঠে।
আমাদের স্মার্টফোনগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন তারা আমাদের উদ্বেগকে পুঁজি করে আমাদের মনোযোগ বন্দি করে রাখে। প্রতিটি নোটিফিকেশনই সম্ভাব্য ভালো কিংবা খারাপ কোনো বার্তার সংকেত বয়ে আনে—এমন এক অনিশ্চয়তার উৎপত্তি ঘটায়, যার নিষ্পত্তির জন্য আমরা অবচেতন তাড়নায় সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি হাতে তুলে নিই। এই অভ্যাস অনিয়ন্ত্রিত হলে উদ্বেগ বাড়ে, এবং এভাবে উদ্বেগ থেকেই ফোনে তাকানো ও নোটিফিকেশন চেক করার প্রবণতা এক আত্মবর্ধনশীল চক্রে পরিণত হয়। ফলত, আমাদের সামগ্রিক মানসিক স্থিতি এক ধরণের 'ডিজিটাল নৈঃশব্দ্যভঙ্গের' ভিতর দিয়ে সর্বদা উত্তেজিত থাকে—যেখানে প্রযুক্তি শুধু সংবেদনের বাহক নয়, বরং উদ্বেগ উৎপাদনেরও এক কাঠামোগত এজেন্ট হয়ে ওঠে।
জ্যঁ টোয়েঙ্গের বই Generations-এ উল্লিখিত একাধিক গবেষণাই দেখিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এক প্রকার নিঃশব্দ কিন্তু তীব্র আক্রমণ হেনে চলেছে। সংযোগের প্রতিশ্রুতি এবং বিনোদনের চটক থাকা সত্ত্বেও, এই প্রযুক্তিনির্ভর পরিসর ক্রমাগত ব্যক্তিকে তার নিজের অবস্থান নিয়ে এক প্রকার আত্মসংশয়ে ঠেলে দিচ্ছে—যেখানে অন্যের সুখ যেন তার নিজের ব্যর্থতার প্রামাণ্য চিত্র হয়ে ওঠে। এই আত্মসংঘাতের প্রেক্ষাপটে বাড়ে বিষণ্নতা, অপূর্ণতার অনুভব এবং এক ধরণের অন্তর্গত নিঃস্বতা।
যদিও এই অনুষঙ্গে সরল কারণ-পরিণামের যুক্তিবিন্যাস নিয়ে বিতর্ক চলমান, তথাপি মোবাইল ফোনের অতিনির্ভরতা ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে একটি সাংগঠনিক সম্পর্কের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। একাধিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, প্রযুক্তির নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহারে 'আমি' নামক চৈতন্য একদিকে গলিয়ে যাচ্ছে এলগরিদমিক আবেগব্যবস্থাপনায়, অন্যদিকে শরীর-মন-সমাজ—এই ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব অনবরত প্রতিস্থাপিত হচ্ছে 'সর্বত্রগামী স্মার্টস্ক্রিন'-এর ভিতরে। এইভাবে স্মার্টফোন যেন আমাদের মনোজাগতিক ভূগোলের নতুন মানচিত্র আঁকছে—যেখানে অস্থিরতা, উদ্বেগ ও একাকীত্ব একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, এবং আমাদের চেতনা হয়ে পড়ে এক প্রকার প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদিত বস্তু।
স্ক্রল করা আমাদের ভালো লাগে—কারণ স্মার্টস্ক্রিন নামক বস্তুটি আমাদের ইন্দ্রিয়তৃষ্ণার সুনিপুণ অর্গানাইজার হয়ে উঠেছে। আমাদের 'রুচি'কে ডেটায় পরিণত করে, এলগরিদম সেই ডেটাকেই বারবার আমাদের সামনে রেখে দেয়, যেন আনন্দের এক অগাধ প্রবাহে আমরা ডুবে থাকি, অথচ সেই আনন্দ নির্মাণে আমাদের সক্রিয় ভূমিকাটুকু প্রায় নিষ্ক্রিয়। এই মুহূর্তে মুহূর্তে পুরস্কৃত হওয়ার প্রক্রিয়াটিই আমাদেরকে ফোনে ফিরে যেতে শেখায়, আবার শেখায় তা-ই যেন না থাকার ব্যথাও।
এমনকি যদি একে ‘নেশা’ না-ও বলা হয়, এই আনন্দ-লালসা—যা স্বেচ্ছায় নয় বরং প্রলুব্ধ প্রক্রিয়ায় চালিত—প্রমাণ করে দেয় আমরা কেন অবচেতনভাবে বারবার স্ক্রিনে ফিরে যাই। এক অর্থে, প্রযুক্তির চটজলদি আনন্দ-ইঞ্জিনিয়ারিং আমাদের মনোজাগতিক কাঠামোতে এমন এক অভ্যাস নির্মাণ করে, যেখানে আমরা বিশ্বাস করি আমরা ‘বেছে নিচ্ছি’; অথচ আমাদের বেছে নেওয়ার পরিসরটুকু আগেই মডেল করা হয়েছে—আমাদের চোখের জন্য, আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য, আমাদের আকাঙ্ক্ষার ক্যালিব্রেশনের জন্য।
আবেগ-জাগানোই এখন এলগরিদমের মুখ্য তাত্ত্বিক কর্মসূচি। তবে সেই আবেগ যদি শুধু ভালোবাসা বা কৌতুক হত, তবুও কথা ছিল। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাগ, ঘৃণা, আতঙ্ক—এই প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী অনুভবগুলোই সবচেয়ে বেশি ‘ইনগেজমেন্ট’ তৈরি করে, আর ঠিক এই সূত্রেই সোশ্যাল মিডিয়া নামক ক্ষমতাগর্ভ কারখানাগুলো তাদের তথ্যপ্রবাহকে নির্মাণ করে। ফেসবুক বহু আগেই বুঝে গেছে—যে-কথা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে, সেই কথার চারপাশে বেশি সময় কাটানো হয়।
এইভাবে ‘ইনগেজমেন্ট’–যা আপাতভাবে নিরীহ অংশগ্রহণের অন্য নাম—বিষক্রিয় এক প্রলম্বিত উত্তেজনার স্থাপত্যে পরিণত হয়। ফলত, প্ল্যাটফর্মগুলো হয়ে ওঠে ‘ক্রোধ-সংলগ্ন প্রতিধ্বনি-কক্ষ’, যেখানে আমরা ক্রমাগত সেই কথাই শুনে যাই, যা আমাদের আরো প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে, আরো বিভাজিত করে তোলে, আরো বেশি সময় স্ক্রিনে আটকে রাখে।
এই প্রক্রিয়া কোনো নিরীহ ডিজিটাল বিন্যাস নয়; বরং এটি এক প্রকার 'আবেগ-চালিত রাজনৈতিক অর্থনীতি', যেখানে মনোযোগই মুদ্রা, রাগই বিনিয়োগ, আর বিভাজন নিজেই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বেশি লাভজনক পণ্য।
‘ডোপামিন ফাস্টিং’—এই শব্দযুগল যখন প্রথমে প্রযুক্তিভোগী নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা এক আধুনিক উপবাসব্রতের আভা নিয়ে হাজির হয়েছিল। কথিত হয়েছিল, একটু থেমে গেলে, উপভোগ থেকে সাময়িক বিরত থাকলে, আমাদের ‘সুখগ্রাহী নিউরন’গুলো যেন নতুনভাবে রিসেট হবে—আবার খাঁটি আনন্দ অনুভব করতে পারবে। কিন্তু দ্রুতই এই ধারণাটি বিজ্ঞানসিদ্ধ নাকি ছদ্মবিজ্ঞান, তা নিয়ে বিতর্ক জমে ওঠে, এবং শেষ পর্যন্ত অনেকেই একে 'বায়োকেমিক্যাল রিসেট’ নয় বরং ‘উদ্দীপনা-বর্জন’ হিসেবে পাঠ করতে শেখেন।
এই পাঠ গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, সহজলভ্য মনোরঞ্জন থেকে একধরনের স্বেচ্ছা-নিবৃত্তি আমাদের ‘অভ্যাস-ব্যবস্থাকে’ ভিন্ন কায়দায় শৃঙ্খলিত করে তুলতে পারে। এখানে প্রযুক্তি থেকে পিছু হঠা মানে কেবল অ্যান্টি-টেক ভাবাপন্নতা নয়, বরং তা একধরনের সক্রিয় আত্মনিয়ন্ত্রণ—যা প্রাচীন গ্রিক স্টোয়িক দর্শন থেকে শুরু করে ভারতীয় ঋষিপরম্পরার উপসংহার পর্যন্ত বিস্তৃত।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়: এই সংযম কি কেবল ব্যক্তিগত ‘চ্যালেঞ্জ’? নাকি এটি এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের সংকেত—একটি যুগে, যেখানে আনন্দ নিজেই হয়ে পড়েছে পণ্যে বিনিমেয়?
স্মার্টফোন আমাদের হাত থেকে শুধু সময়ই নয়, ধীরে ধীরে ছিনিয়ে নিচ্ছে কিছু মৌলিক ক্ষমতা—জানার, বুঝার, এবং সমস্যার মোকাবেলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সেই প্রাথমিক প্রবৃত্তি। তথ্যের জন্য প্রতিটি অনুসন্ধান আজ পরিণত হয়েছে এলগরিদমের অনুকম্পায় অনুমোদিত একরৈখিক যাত্রায়, যেখানে প্রশ্নেরও একধরনের ‘বিন্যাস’ আছে, এবং উত্তরও গৃহপালিত। এইভাবে আমরা প্রশিক্ষিত হচ্ছি একপ্রকার ‘এলগরিদমিক অলসতায়’, যেখানে স্বনির্ধারণ বা চিন্তাগত স্বতন্ত্রতা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়।
প্রযুক্তি যে কেবল দক্ষতা বাড়ায়, সে কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু অতিরিক্ত নির্ভরতায় তৈরি হয় এক ধরণের অদৃশ্য ‘সাবমিশন’—যেখানে চিন্তার চর্চা নয়, বরং অপচিন্তার নির্ভরতা জেঁকে বসে। এই নির্ভরতা শুধু আমাদের যুক্তিবোধ নয়, আমাদের কল্পনার পরিসরকেও সংকুচিত করে, যেখানে সম্ভাবনার বিস্তার হ্রাস পায় এবং মননও নিয়ন্ত্রিত হয় অদৃশ্য প্যাটার্নে।
ফলত, প্রশ্ন জাগে—আমরা কি এখনও নিজস্ব ভাবনা-শক্তির ব্যবহারকারী, নাকি এখন কেবলমাত্র ‘ডেটা-চালিত প্রতিক্রিয়ার বাহক’? প্রযুক্তির সঙ্গে সহাবস্থান চাই, কিন্তু তার সঙ্গে আত্মসমর্পণ নয়—এই মনোযোগই হতে পারে আমাদের মুক্তির নতুন মানচিত্র।