মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এবং ইউরোপে ডাইনি শিকারের উন্মাদনা - রিটন খান
ইউরোপীয় ডাইনি শিকারের সময়কালের মতো আর কোনো সময় ইতিহাসে নারীরা এত ব্যাপক, আইনি বৈধতা-প্রাপ্ত এবং ধর্মীয় সমর্থন-সহ violent misogyny-র শিকার হননি।
ইতিহাসের অতি প্রাচীনকাল থেকে নারীরা চিকিৎসক, পুরোহিত, ধাত্রী, সেবিকা, চিকিৎসা শিক্ষিকা, ভেষজবিদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে, এই ‘জ্ঞানী নারীরা’ সমাজে ভয়ের কারণ হয়ে ওঠেনি বা তাদের প্রতি কোনো বিরূপ মনোভাবও গড়ে ওঠেনি। বরং তাদের দক্ষতা ও জ্ঞানের জন্য সমাজ তাদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করত—প্রাণ সঞ্চার ও মৃত্যুকে প্রতিহত করার অদ্বিতীয় ক্ষমতা ছিল তাদের হাতে, যা তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে উত্তরাধিকার হিসেবে দিয়ে গেছেন। এমনকি যেসব নারী প্রকাশ্যে জাদুবিদ্যার চর্চা করতেন—যার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় রোমান ও গ্রিক পুরাণ বা কেল্টিক লোককথায়—প্রথম দিকে তাদের জ্ঞানী হিসেবেই সম্মান জানানো হতো। তবে তাদের ক্ষমতার চারপাশে কিছুটা ভয়ের আবহও ছিল।
এই বিষয়টি বিশেষভাবে মনে রাখা জরুরি। তারা ডাইনি ছিলেন কি না, সে বিতর্কের বাইরেও নারীদের এই কর্মশিল্প শুধুমাত্র জীবিকার উৎস ছিল না, বরং তা ছিল একধরনের ক্ষমতার প্রতীক। এমন এক সমাজে, যা ধীরে ধীরে পুরুষতান্ত্রিক শাসনের অধীনে চলে আসছিল, এই ক্ষমতার স্থান ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন মিশরে, উদাহরণস্বরূপ, নারীরা চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন, শিক্ষা ও চর্চা করতে পারতেন— এমনকি সাইসের মতো কিছু নগরে ধাত্রীবিদ্যায় বিশেষায়িত স্কুলও ছিল। তবে সময়ের পরিক্রমায় নারীদের আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা কার্য থেকে ক্রমশ সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের দক্ষতাগুলি ঘরের গোপন পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের নিজের ঘরও আর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে থাকেনি, যেখানেই তারা শতাব্দীর প্রাচীন এই চর্চাগুলি অব্যাহত রাখতে পারতেন। এই পরিবর্তনের পেছনে নানা সমসাময়িক কারণ থাকলেও, এটি সম্ভব হয়েছিল মানব সভ্যতার এক অসাধারণ আবিষ্কার— মুদ্রণযন্ত্রের— কল্যাণেই।
মুদ্রণযন্ত্রের উদ্ভব চীনে, যেখানে বিখ্যাত আবিষ্কারক বিটি শেং এই যন্ত্রটি প্রথম তৈরি করেন। তবে ইতিহাসে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্যের কারণে, সম্ভবত আপনি জার্মান সোনারকারিগর জোহানেস গুটেনবার্গের নাম বেশি শুনেছেন, যিনি ১৪৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রথম আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের জন্য পরিচিতি পান।
গুটেনবার্গের এই আবিষ্কারই পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা চিন্তা, সংবাদ, ও জ্ঞানের বিস্তৃত প্রচারকে সম্ভব করে তোলে। এর ফলে শিক্ষা, সাক্ষরতা এবং, অনেকের মতে, রেনেসাঁর বিকাশে বড় ধরনের অবদান রাখে।
কিন্তু এটি আরেকটি দিকেও ভূমিকা রাখে: কুসংস্কার, সামাজিক মেরুকরণ, এমনকি সহিংসতার বিস্তারে। বিশেষ করে, নারীদের বিরুদ্ধে।
প্রাথমিক খ্রিস্টান চার্চের কিছু পিতৃপুরুষ, যেমন সেন্ট অ্যামব্রোস ও সেন্ট অগাস্টিন, ৪র্থ শতাব্দী থেকে নারীদের—যাদের সামান্য ক্ষমতা, জ্ঞান, বা পৌত্তলিক সাহস ছিল, যেমন নারী চিকিৎসক, ধাত্রী, ভেষজবিদ— সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেন। কিন্তু তাদের চিন্তাধারা দ্রুত ছড়ায়নি। অধিকাংশ মানুষ তখন নিরক্ষর ছিল, ধর্মীয় উপদেশ লাতিনে দেওয়া হতো, এবং লিখিত গ্রন্থ—সেগুলিও প্রায়শই লাতিনে লেখা—সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য ছিল না।
কিছু মানুষের জন্য এটি স্বস্তির ছিল, কিন্তু ‘ডাইনি’ অভিযুক্ত হওয়া হাজার হাজার নারীর জন্য তা মারাত্মক দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এই ধারণাগুলি যখন ভয়াবহভাবে রূপান্তরিত হচ্ছিল, তখনই গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। ১৪৮৬ সালে প্রকাশিত হয় ম্যালেউস ম্যালেফিকারাম (‘ডাইনিবিধংশি হাতুড়ি’), সম্ভবত ইতিহাসের অন্যতম নারীবিদ্বেষী গ্রন্থ। ডোমিনিকান দুই পুরোহিতের লেখা এই গ্রন্থটি ডাইনি শিকারের নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার শিরোনাম থেকেই তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট: নির্দয়ভাবে এক্সোডাস ২২:১৮- এর অনুশাসন প্রয়োগ করা, যা বলে, ‘তোমরা জাদুকরীকে বাঁচতে দেবে না।’
দুর্ভাগ্যক্রমে, ডাইনি সনাক্ত, জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচার করার নির্দেশনা দেওয়া ম্যালেউস ম্যালেফিকারাম একমাত্র গ্রন্থ ছিল না। জনপ্রিয় প্রেস দ্রুত এই প্রবণতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, প্রচুর একপাতার পুস্তিকা ও ব্রডশিট প্রকাশ করতে থাকে—যা আধুনিক সংবাদপত্রের পূর্বসূরী। এসব ‘সংবাদ’ বিবরণে দেখা যেত নারীরা চুলার শাঁখে চড়ে উড়ছে, শহর পুড়িয়ে দিচ্ছে কিংবা শিশুদের খাচ্ছে। এগুলিতে প্রায়শই রঙিন, অতিরঞ্জিত চিত্রসহ টপলেস ‘ডাইনি’ এবং দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিরোনাম থাকত, যা ঐতিহাসিক নাটালি গ্রেস একবার উল্লেখ করেছিলেন, ‘আধুনিক ক্লিকবাইটের প্রাচীন সংস্করণ’ হিসেবে। এসব গল্প আসলে আজকের দিনের ‘ফেক নিউজ’-এরই সমান ছিল।
তবুও, এই পুস্তিকাগুলি সাধারণ জনগণের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় ছিল এবং দ্রুত বিকাশমান মুদ্রণশিল্পের জন্য অত্যন্ত লাভজনকও বটে। তাহলে ক্ষতি কোথায়, তাই তো?
সম্প্রতি থিওরি অ্যান্ড সোসাইটি প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, ডাইনি ও ডাইনি-শিকার সম্পর্কিত গ্রন্থ, বিশেষত ম্যালেউস ম্যালেফিকারাম-এর মুদ্রণ, ইউরোপজুড়ে ডাইনি সন্দেহে নারীদের উপর অত্যাচার ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৪০০ থেকে ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত মধ্য ইউরোপের ৫৫৩টি শহরের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেন, প্রতিটি নতুন সংস্করণ প্রকাশের পর ডাইনি বিচারের সংখ্যা এবং নিষ্ঠুরতা উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, একটি শহর যখন ডাইনি-শিকার নির্দেশিকা অনুসারে অভিযান শুরু করত, তখন আশপাশের শহরগুলো দ্রুত সেই উদাহরণ অনুসরণ করত, একে অপরের কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে।
ক্রমে এই ধারণা ও ‘সেরা পদ্ধতিগুলি’ দাবানলের মতো পুরো মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে হাজার হাজার নারীকে ‘পরম শয়তান’-এর অবতার হিসেবে কলঙ্কিত করা হয়।
মোটের ওপর, অনুমান করা হয় যে ডাইনি-শিকার উন্মাদনা, যা ১৫শ শতাব্দীর শেষভাগে শুরু হয়ে ৩০০ বছর ধরে চলে (শেষ সরকারি ডাইনি বিচারটি ১৭৮৩ সালে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছিল), প্রায় ৯০,০০০ জনকে বিচারের মুখোমুখি করে, যার মধ্যে প্রায় ৪৫,০০০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই অভিযুক্ত এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ছিলেন নারী—বিশেষত সমাজে যারা কিছুটা ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, বয়স্কা নারী, বিধবা, দরিদ্র নারী, এবং যারা ‘দুর্নামের’ অধিকারী বলে বিবেচিত ছিলেন, যেমন অবিবাহিত মা বা ‘অশ্লীল’ ও ‘উচ্ছৃঙ্খল’ আচরণে অভিযুক্ত নারীরা।
ইউরোপীয় ডাইনি শিকারের সময়কালের মতো আর কোনো সময় ইতিহাসে নারীরা এত ব্যাপক, আইনি বৈধতা-প্রাপ্ত এবং ধর্মীয় সমর্থন-সহ violent misogyny-র শিকার হননি। সিলভিয়া ফেদেরিচি তাঁর সাম্প্রতিক বই Witches, Witch-Hunting, and Women-এ লেখেন:
“সবচেয়ে তুচ্ছ প্রমাণের ভিত্তিতে, সাধারণত একটি অভিযোগই যথেষ্ট ছিল, হাজার হাজার নারীকে গ্রেফতার করা হতো, সম্পূর্ণ উলঙ্গ করা হতো, তাদের শরীরের সমস্ত লোম মুণ্ডন করা হতো, এবং দীর্ঘ সুচ দিয়ে তাদের শরীরের প্রতিটি অংশে খোঁচানো হতো ‘শয়তানের চিহ্ন’ খুঁজে বের করার জন্য। প্রায়শই এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হতো পুরুষদের উপস্থিতিতে—প্রাণদণ্ড কার্যকরকারী থেকে শুরু করে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও পুরোহিত পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত থাকতেন।
এবং এটি তাদের যন্ত্রণার শেষ ছিল না। নারীদের দেহে যে নির্মম অত্যাচার চালানো হতো, তা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস যন্ত্রণা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই দেহকে এক আদর্শ পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, যেখানে কষ্ট ও নির্যাতনের একটি ‘বিজ্ঞান’ তৈরি ও পরিমার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।”
যদি মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার না হতো, তবে হয়তো সেই নারীদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার—যাদের একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল ক্রমশ কঠোর নারীত্বের আদর্শ থেকে সামান্য বিচ্যুত হওয়া—এত ভয়াবহ আকার ধারণ করতো না। তবে দোষ মুদ্রণ প্রযুক্তির নয়। কারণ এমন তো নয় যে কোনো মুদ্রণযন্ত্র হঠাৎ একদিন জেগে উঠে নারীদের ভয়ংকর অভিযোগ, নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে আতঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আসল কারণ ছিল কিছু পুরুষ, যাদের মন জুড়ে ছিল সেই নারীদের প্রতি ভয় ও ঘৃণা, যাদের তারা ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করত।
ডাইনি শিকার অভিযানে নারীদেরও ভূমিকা ছিল, যদিও তা ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্যাসিভ বা নিষ্ক্রিয়। পুরুষদের হাতে এবং নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে অন্য নারীদের—মাঝে মাঝে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদেরও—বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে বাধ্য করা হতো, নতুবা নিজেরাই জীবন্ত দগ্ধ হবার ঝুঁকিতে থাকতেন। এই প্রক্রিয়া কার্যত নারীদের সামাজিক ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে গড়ে ওঠা সহযোগিতা ও সংহতির নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করে দেয়, যা পূর্ববর্তী শতাব্দীতে নারীদের শক্তি ছিল। তবে, ডাইনি শিকার অভিযানের এ ছিল শুধুমাত্র অসংখ্য করুণ পরিণতির মধ্যে একটি।
যেমন ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন মার্চেন্ট এবং সাংবাদিক বারবারা এহরেনরেইক ও ডিয়ারড্রে ইংলিশ দেখিয়েছেন, ডাইনি শিকারের ফলে নারীদের সেই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীরা অর্জন করেছিলেন—প্রকৃতি, চিকিৎসা, আধ্যাত্মিকতা এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নারী শরীর সম্পর্কে জ্ঞান। দুর্ভাগ্যবশত, প্রোপাগান্ডা ঠিক এভাবেই কাজ করে। এটি ‘পুরাতন’কে দমন করে ‘নতুনের’ জন্য জায়গা করে দেয়, যা এই ক্ষেত্রে নারীদের সামাজিক ক্ষমতা, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক চর্চার দমন এবং পুরুষ ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে সমাজের পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা ছিল।
‘ডাইনি’ চরিত্রকে অসুর রূপে উপস্থাপন করা হয়েছিল নারীদের ‘গ্রহণযোগ্য’ আচরণের সীমানা নির্ধারণের একটি কৌশল হিসেবে—যেখানে নারীর যৌনতা নেই, তাকে নিয়ন্ত্রিত, ঘরোয়া এবং একটিমাত্র মূল উদ্দেশ্য নিয়ে দেখা হয়েছে: প্রচুর শ্রমশক্তি উৎপাদন করা। জার্মান পুরোহিত ও ধর্মীয় সংস্কারক মার্টিন লুথার, যিনি তথাকথিত ডাইনিদের হত্যার জন্যও উৎসাহ দিয়েছিলেন, একবার বলেছিলেন, ‘ওদের [নারীদের] মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সন্তান ধারণ করতে দাও। ওরা তো সেজন্যই সৃষ্টি হয়েছে।’
আর যদি কোনো নারী এই ‘আদর্শ’ নারীত্বের পথ বেছে নিতে অস্বীকার করতেন, তবে ডাইনির নিষ্ঠুর নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড স্পষ্ট হুঁশিয়ারি হয়ে উঠত যে তাদের ভবিষ্যৎও এমনই হতে পারে। এর সাথে যোগ হয়েছিল ক্রমবর্ধমান নারীবিদ্বেষী প্রাতিষ্ঠানিক নীতি, আইন ও বিধিবিধান, যা নারীদের স্বায়ত্তশাসন হরণ করেছিল এবং নির্দিষ্ট কিছু পেশা ও ক্ষেত্র থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়। এই ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরীয় যুগের ‘সত্যিকার নারীত্বের উপাসনা’ এবং ‘ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের’ আদর্শে গিয়ে পৌঁছায়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে। শুধু তার বিস্তারের মাধ্যমটি পাল্টেছে।
বছরের পর বছর ধরে আমি অনলাইনে নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের উত্থান নিয়ে লিখেছি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এটি শুধুই ছেলেমানুষি গালি বা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা অবাস্তব ধারণা নয়, যা কেবল অপরিণত বা উদাসীন কিশোররা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
পুরোপুরি নিবেদিত কিছু ওয়েবসাইট এবং ফোরাম—সমষ্টিগতভাবে ‘ম্যানোস্ফিয়ার’ নামে পরিচিত, যেখানে পুরুষেরা নারীদের নিয়ে কল্পিত ও নারীবিদ্বেষী তত্ত্ব প্রচার করে। এসব তত্ত্ব নারীদের তথাকথিত নিকৃষ্ট প্রকৃতি এবং সমাজে তাদের কল্পিত অবস্থান নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে। এই আধুনিক ইনকুইজিটর ও ডেমনোলজিস্টরা নারীদের প্রায়শই নরকের প্রাণী, পুরুষখেকো, শিশুহত্যাকারী এবং সমাজের সকল সমস্যার বলির পাঁঠা হিসেবে উপস্থাপন করে। এমন কিছু বক্তব্য আবার ‘বৈজ্ঞানিক প্রমাণ’-এর ছদ্মবেশে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে ভুল ব্যাখ্যা করা বিবর্তনবাদী তত্ত্ব, জালিয়াতি করা গ্রাফ এবং বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো পরে ছেলেদের ও পুরুষদের নারীবিদ্বেষী প্রতিধ্বনির ঘেরাটোপে আটকে রাখে, যেখানে এই বিশ্বাসগুলো ক্রমাগত আরও দৃঢ় হয়, কারণ অ্যালগরিদমগুলো তাদের আরও সেই একই ধরনের কনটেন্ট দেখাতে থাকে, যার সাথে তারা আগেই সম্পৃক্ত হয়েছে।
এটা সত্যিই অতিরঞ্জিত বলা হবে না যে ইন্টারনেটের কিছু অংশ কার্যত ম্যালেউস ম্যালেফিকারাম-এর আধুনিক সংস্করণ হিসেবে কাজ করছে।
কিন্তু এই সমস্যা শুধুমাত্র অনলাইন জগতেই সীমাবদ্ধ নয়।
নারীবিদ্বেষী কুসংস্কার, ভ্রান্ত তথ্য, এবং নারীদের বলির পাঁঠা বানানোর প্রবণতা প্রচলিত গণমাধ্যমেও বিদ্যমান—বিশেষত ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলোতে—রাজনীতি এবং এমনকি কিছু সরকারের নীতিমালায়ও। অবিবাহিত মায়েদের ‘পরিবারের পবিত্রতা’ ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয়। নিঃসন্তান বা সন্তানহীন নারীদের তাদের ‘প্রকৃত উদ্দেশ্য’ পূরণে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে হেনস্থা করা হয়। সাধারণত ‘পুরুষালি’ বলে বিবেচিত কাজ, বিশেষ করে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা নারীদের ‘পুরুষদের চাকরি চুরি’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং তাদের এই ভূমিকার জন্য ‘অযোগ্য’ বলা হয়। আর এই তালিকা যেন শেষ হবার নয়।
এসবের মধ্যে অতীতের ভীতিকর ঘটনাগুলির সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। আজকের নারীবিদ্বেষ হয়তো অতীতের মতো তীব্র মনে না হলেও, একে তুচ্ছ ও নিরীহ বলে সরিয়ে রাখা আমাদের ভুল হবে।
ডাইনি বিচারের ইতিহাস আমাদের স্পষ্টভাবে দেখায় যে, প্রযুক্তি-উদ্দীপিত নারীবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে কী হতে পারে। এটি পুরো সমাজকে আতঙ্কিত করতে পারে, নারীদের একা করে ফেলে, প্রতিরোধকে নিরুৎসাহিত করে, এবং মানুষকে ‘অন্যরাও তাই করছে’ ভেবে এমন আচরণে উদ্বুদ্ধ করে। এর ফল কেবল সামাজিক মেরুকরণেই থেমে থাকে না, বরং সহিংসতায়ও রূপ নেয়। হয়তো আমরা আর নারীদের আগুনে পুড়িয়ে মারছি না, তবে লিঙ্গভিত্তিক ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতা, যৌন সহিংসতা, এবং অনলাইনে হয়রানির হার আজও ভয়ঙ্কর মাত্রায় রয়ে গেছে।
এখনও নারীদের জন্য একটি সংকীর্ণ ‘গ্রহণযোগ্য’ আচরণের পথ নির্ধারিত আছে, এবং যে কোনো নারী সেই সীমা অতিক্রম করার সাহস করলে তার মূল্য চোকাতে হয়।
তবে ভুলে গেলে চলবে না যে প্রযুক্তি যতটা সহিংসতা ও নিপীড়নের হাতিয়ার হতে পারে, ঠিক ততটাই ইতিবাচক পরিবর্তনেরও সহায়ক হতে পারে। যে মুদ্রণ প্রযুক্তি ডাইনি শিকারকে উস্কে দিয়েছিল, সেই একই প্রযুক্তি পরে ব্যাপক সাক্ষরতা ও শিক্ষা ছড়িয়ে দেয় এবং, ফলস্বরূপ, ডাইনি ও নারীদের ঘিরে থাকা ক্ষতিকর কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করতেও সাহায্য করে। প্রযুক্তি নিজে কখনো ভালো বা মন্দ নয়—এটি শুধু একটা মাধ্যম। কীভাবে আমরা এটি ব্যবহার করি, সেটাই মূলত গুরুত্বপূর্ণ।