জাহিদুর রহিম অঞ্জন: এক সৃজনশীল সংগ্রামী ও বাংলাদেশের সিনেমার নীরব কারিগর
তিনি কেবল পর্দার গল্পকার ছিলেন না, ছিলেন চলচ্চিত্রের সমাজ-সংশ্লিষ্ট দিকগুলোর এক মৃদু কিন্তু বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে জাহিদুর রহিম অঞ্জন শুধুই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক পথপ্রদর্শক, এক গল্পকার, এক দৃষ্টিসম্পন্ন নির্মাতা। ১৯৬৪ সালে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি চলচ্চিত্রের পথ বেছে নিয়েছিলেন ইতিহাস ও হৃদয়ের সংমিশ্রণে। এক ভাষা সংগ্রামীর সন্তান হিসেবে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের স্পন্দন ছুঁয়ে বড় হয়েছেন, আর পরবর্তীতে পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন এক সংবেদনশীল নির্মাতা হিসেবে।
তাঁর কাজের পরতে পরতে ছিল চিন্তার গভীরতা, দৃশ্যকাব্যের প্রগাঢ়তা, এবং এক ধরনের সাহিত্যিক মাধুর্য যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। তিনি কেবল পর্দার গল্পকার ছিলেন না, ছিলেন চলচ্চিত্রের সমাজ-সংশ্লিষ্ট দিকগুলোর এক মৃদু কিন্তু বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
প্রথম দিকের চলচ্চিত্র আন্দোলন ও শিক্ষকের ভূমিকা
অঞ্জনের সিনেমার প্রতি টান জন্মেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধিৎসা ও গল্প বলার এক অন্তর্নিহিত তাগিদ থেকে। তিনি কখনও কেবল বানিজ্যিক সাফল্যের পেছনে ছুটেননি, বরং সিনেমাকে সমাজের দর্পণ হিসেবে দেখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের এক অগ্রণী সংগঠক ছিলেন তিনি, ‘শর্ট ফিল্ম ফোরাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং পরবর্তী সময়ে সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল তরুণ নির্মাতাদের জন্য বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রচর্চার ক্ষেত্র তৈরি করা। তিনি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম বিভাগে অধ্যাপনা করতেন, যেখানে তাঁর ক্লাসরুম কখনও শুধুই একাডেমিক পাঠে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তা হয়ে উঠেছিল এক আলোকিত চলচ্চিত্র চর্চার কেন্দ্র। সেখানে তিনি Tarkovsky-র ধ্রুপদী কাব্যিকতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের নান্দনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ করতেন। তাঁর শিক্ষার্থীরা তাঁকে ‘অঞ্জন দা’ বলে ডাকত, কারণ তিনি ছিলেন শুধুই শিক্ষক নন, একজন পথপ্রদর্শকও।
মেঘমল্লার: ইতিহাসের ভেতর দিয়ে এক ব্যক্তিগত আখ্যান
২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মেঘমল্লার ছিল অঞ্জনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং এটি শুধু তাঁর ক্যারিয়ারের নয়, বরং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প রেইনকোট অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি মুক্তিযুদ্ধের কোলাহলকে বিশাল ব্যাটলফিল্ডে দেখায়নি, বরং সেটাকে নিয়ে এসেছে এক ক্ষুদ্র শহরের এক সাধারণ শিক্ষকের জীবনে, যিনি এক আকস্মিক ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে হয়ে যান যুদ্ধের এক অনিচ্ছুক অংশগ্রাহী।
এই চলচ্চিত্রের আবহ ছিল বৃষ্টি, যা একদিকে প্রতীকী, অন্যদিকে আবেগময়তারও বাহক। মেঘমল্লার রাগ যেমন চলমান বর্ষার এক সঙ্গীত হয়ে ওঠে, তেমনি এই সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম যেন এক ধ্রুপদী কবিতা। অঞ্জনের সিনেমা কখনও সরাসরি ইতিহাসের ঘোষণা দেয় না, বরং ইতিহাসকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্তরে নামিয়ে আনে, যেখানে প্রতিটি পরিবার মুক্তিযুদ্ধের এক অনিবার্য অংশ হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রটি শুধুমাত্র সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল তা নয়, বরং এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কিছু সম্মাননা পেয়েছিল। এটি বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে পাঁচটি বিভাগে জয়ী হয় এবং ২০১৫ সালের টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়, যা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জন্য এক বিরল সম্মান।
শৈলী ও বিষয়বস্তু: সাহিত্য থেকে সিনেমার যাত্রা
অঞ্জনের সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তার সাহিত্যগুণ। তাঁর উভয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রই প্রখ্যাত বাংলা সাহিত্যের রূপান্তর। তাঁর চলচ্চিত্র বড় কোনো রাজনৈতিক ভাষণ দেয় না, বরং নিরব প্রতীকী চিত্রায়ণের মাধ্যমে দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে।
মেঘমল্লার ছিল একধরনের বাস্তববাদী কাব্য, যেখানে ইতিহাসের মহাকাব্যের বদলে সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলোই হয়ে ওঠে মূল বিষয়বস্তু। তাঁর নির্মাণশৈলী ধীর, ধৈর্যশীল, এবং আবেগপ্রবণ—প্রতিটি ফ্রেমই যেন এক দীর্ঘশ্বাস।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনে অঞ্জনের অবদান
অঞ্জন শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেই থেমে থাকেননি; তিনি বাংলাদেশে বিকল্প ধারার সিনেমার একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন। শর্ট ফিল্ম ফোরাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি নতুন নির্মাতাদের জন্য এক উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করেন। দেশজুড়ে ছোট ছোট চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, ঢাকার বাইরেও সিনেমার দর্শক আছে, নতুন গল্প বলার জায়গা আছে।
তাঁর সহকর্মীরা আজও স্মরণ করেন যে, তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ। একাধারে শিক্ষক, নির্মাতা ও তাত্ত্বিক—তাঁর সিনেমার সংজ্ঞা কেবল বিনোদন ছিল না, ছিল সমাজ ও সময়ের প্রতিচ্ছবি।
শেষ কাজ: চাঁদের আমাবস্যা ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন
মৃত্যুর আগের বছরগুলোতে অঞ্জন কাজ করছিলেন Syed Waliullah-র উপন্যাস চাঁদের আমাবস্যা নিয়ে, যা তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। এই চলচ্চিত্রে তিনি বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের অস্থিরতা, আত্মপরিচয়ের সংকট এবং অস্তিত্বের গভীর দহনকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
তিনি একবার বলেছিলেন, “চাঁদের আমাবস্যা আমার সিনেমার ভাষার সঙ্গে মেলে। এটা শুধু গল্প নয়, এটা কিছু অন্যরকম।” কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ২০২৪ সালে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কারণে সিনেমাটির মুক্তি পিছিয়ে যায়, যদিও শুটিং শেষ হয়েছিল।
অঞ্জনের উত্তরাধিকার: অমলিন এক আলোকবর্তিকা
২০২৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ৬০ বছর বয়সে অঞ্জন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁর মৃত্যু শুধু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার চলে যাওয়া ছিল না, বরং তা ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক নক্ষত্রপতন। তাঁর স্ত্রী, প্রখ্যাত সাহিত্যিক শাহীন আখতার, আজও তাঁদের সৃজনশীল পথচলার সাক্ষী হয়ে আছেন।
আজ যখন নতুন প্রজন্ম ক্যামেরা হাতে তুলে নেয়, যখন বিকল্পধারার কোনো নির্মাতা তার প্রথম চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন, তখন তাঁদের কাজের ভিতরে কোথাও না কোথাও অঞ্জনের ছায়া পড়ে। কারণ অঞ্জন দেখিয়ে গেছেন, বাণিজ্যিক ছাঁচের বাইরে থেকেও একজন নির্মাতা তার সত্যিকারের গল্প বলতে পারেন।
অঞ্জন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, সত্যিকারের চলচ্চিত্র গড়ে ওঠে সংবেদনশীলতা, নৈতিক অবস্থান, এবং শিল্পের প্রতি গভীর এক দায়বদ্ধতা থেকে। আর তাই, যতদিন বৃষ্টির শব্দ শুনে কেউ ‘মেঘমল্লার’ রাগের কথা ভাববে, ততদিন জাহিদুর রহিম অঞ্জনের সিনেমা ও স্বপ্ন বেঁচে থাকবে।