জহির রায়হান—নামটা একটা প্রাণশক্তি, যিনি বাংলা ভূখণ্ডের প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিটি প্রগতির উত্তরণে নিজের শরীর, আত্মা ও কলম একাকার করে দিয়েছিলেন। তাঁর জীবন যেন এক চলমান উপন্যাস, যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ই একেকটা বিপ্লব, একেকটা নতুন যাত্রা। কৈশোরে তিনি শুরু করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কুরিয়ার হিসেবে—একদম ছায়ার আড়ালে থেকে আদর্শের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে তিনি আলোয় আসেন ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে। ১৯৫২-এর উত্তাল ঢাকায় তাঁর পদচিহ্ন, তাঁর কলম, তাঁর কণ্ঠ—সবই ছিলেন সশস্ত্র, যদিও হাতে অস্ত্র ছিল না; ছিল শব্দ, চিন্তা ও দৃঢ়তা।
এরপর সাহিত্য, সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র—প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি কেবল অংশগ্রহণ করেননি, বরং একেকটা ক্ষেত্রকে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন। তাঁর গল্প ও উপন্যাসে মেলে এক ধরনের বাস্তববাদী আবেগ, যেখানে সমাজের কণ্ঠস্বর উঠে আসে নিঃসংশয়ে। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বিস্ময়কর রূপ প্রকাশ পায় চলচ্চিত্রে। তিনি ছিলেন কাহিনীকার, সংলাপ রচয়িতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, শিক্ষক, সংগঠক, এমনকি একধরনের পৃষ্ঠপোষকও—এককথায়, চলচ্চিত্রের চৌহদ্দিতে তাঁর ছিল সর্বব্যাপী উপস্থিতি। জহির রায়হান নির্মাণ করেছেন বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় চলচ্চিত্র—যেখানে সাহিত্য, পুরাণ, লোকগাথা, পারিবারিক সংকট, সমাজ বাস্তবতা, এমনকি ইতিহাসের ধ্বনি পর্যন্ত একসূত্রে গাঁথা। তাঁর নির্মাণে ছিল সৃজনশীলতার দীপ্তি, কারিগরি উৎকর্ষের শাণিত অনুভব, নন্দনবোধের এক বিশেষ দ্যুতি—যা কোনো বিশেষ চর্চার ফসল নয়, বরং জীবন ও যন্ত্রণার যৌথ ছাঁচে গড়া।
তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি যেন এক আন্দোলনের রূপক, যেখানে রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে এক গৃহকোণের ভেতর দিয়ে। তাঁর সিনেমা কেবল বিনোদনের প্যাকেজ নয়, বরং একরকম জাগরণের টুলকিট—একটি প্রতিবাদের ভাষা। জহির রায়হানের অন্তর্ধান—বাংলা জাতির ইতিহাসে এক দীর্ঘতম নিঃশব্দ আর্তনাদ, এক অসমাপ্ত বাক্য। আমরা যাকে বলেছি "অন্তর্ধান", যার দিনটি প্রতি ৩০ জানুয়ারি পালিত হয়েছে নিঃস্মৃতি আর শোকের মূর্ছনায়—তা আসলে ছিল এক নির্মম হত্যা। এবং এই সত্য, আমাদের জাতীয় চেতনার ঠিক নিচে, মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সেই ৩০ জানুয়ারি, জহির রায়হান তাঁর নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে মিরপুরে যান। যুদ্ধ শেষ হলেও মিরপুর তখনো ছিল এক দখলদার পকেট, বিহারী রাজাকারদের করাল গ্রাসে। ১২ নম্বর সেকশনের পানির ট্যাংকি এলাকায় তিনি পড়েন সশস্ত্র বিহারিদের ঘিরে ধরা আক্রমণে। যে দেশকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিতে চেয়েছিলেন ক্যামেরা হাতে, যে বাংলার জন্য একের পর এক ছবিতে তুলে ধরেছিলেন নিপীড়ন আর প্রতিরোধ—সেই বাংলার মাটিতেই গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেল তাঁর বুক। এই হত্যাকাণ্ড কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, কোনো অনুপস্থিতির কুয়াশা নয়—এ ছিল সুপরিকল্পিত প্রতিহিংসা, প্রগতির প্রতীককে মুছে ফেলার এক মরণ আঘাত। বিহারিরা তাঁর রক্তাক্ত শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর টেনে নিয়ে যায় কোথাও, আর সেই থেকে ইতিহাসের পাতায় তিনি 'নিখোঁজ'—আসলে নিধন। তাঁর লাশ গুম হওয়া মানে কেবল একজন মানুষ হারিয়ে যাওয়া নয়—এ এক প্রজন্মের প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া, এক জাতির স্মৃতিকে কেটে ছিঁড়ে ফেলা।
কিন্তু ইতিহাস তাঁকে হারায়নি—তাঁকে ছুঁয়ে ফেলেছে, তাকে ধারণ করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য থেকে সিনেমা, সাংবাদিকতা থেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রয়ে গেছেন এক অবিস্মরণীয় কীর্তিমান। আর আমরা? আমরা শুধু দর্শক নই, উত্তরসূরি—যারা জহির রায়হানের অসমাপ্ত সিনেমার ক্যামেরা এখন হাতে নিয়ে হাঁটছি ভবিষ্যতের পথে।
শুভ জন্মদিন হে কীর্তিমান। আমাদের ক্ষমা করো।
১৮ই আগস্ট, ২০২৫