কিংস কলেজ লন্ডনের দার্শনিক শাখা থেকে এমএ করে আলাঁ দ্য বোতোঁ ঠিক করেছিলেন, তিনি আর ক্যান্টের কণ্টকিত গুহায় থিসিস লিখে মাথা কুটবেন না—বরং লোকজনকে তাদের নিজেদের মগজের ভেতর থেকে বের করে আনবেন। হার্ভার্ডে পিএইচডি করছিলেন—ফরাসি দর্শনে। কিন্তু হেগেলের হাল ছেড়ে, সার্ত্রের সালাদ ঝেড়ে, একদিন কলম তুলে বসলেন ‘Essays in Love’ লিখতে। বাকিটা ইতিহাস নয়, হাউ টু-গাইড।
আমরা, যাদের ব্রেকআপ মানে ফেসবুক ডিজঅ্যাকটিভেট, ইনস্টাগ্রাম-স্টোরিতে “খুব কষ্টে আছি” টাইপের কালো স্ক্রিন, তারা তখনও জানতাম না, একজন লোক প্রেম নিয়ে বই লিখে “বেস্টসেলার” হতে পারে—তাও দার্শনিক ভঙ্গিতে। মানে, যাকে বলি, মন দিয়ে মাথা খুঁটছেন আর মাথা দিয়ে মন ঠিক করছেন।
এখন কথা হলো, কীভাবে নিজেকে বদলাই—এই যে আমরা সারাদিন নিজেদের সঙ্গে ঝগড়া করি, “তুই পারবি না”, “তোর দ্বারা হবে না”, “সবার জীবন ভালো, শুধু তোরটা গুগলি ম্যাপে খুঁজেও মেলে না”—এই সব 'ভিতরের চ্যাংড়া'দের চুপ করাবো কীভাবে?
দ্য বোতোঁ বলছেন, এই 'ভিতরের কণ্ঠ' কিন্তু আসলে বাইরেরই প্রতিধ্বনি—মা, মাসি, মাস্টারমশাই, ফুপি, পাড়ার আঙ্কল, ওয়ার্কপ্লেসের ওভারচিভার বস, যারা জীবনভর আমাদের বলেছে—"তুই যথেষ্ট না"। ওটা আমরা ইনস্টল করে ফেলেছি, আর এখন সেটা ব্যাকগ্রাউন্ডে চালাচ্ছে আমাদের আত্মবিশ্বাস-সিস্টেম।
তাই প্রথম কাজ: ওই কণ্ঠগুলোকে জিজ্ঞাসা করো—"তুই কে রে?" উত্তর মিলবে, একবার স্কুলের ক্লাস টিচার, একবার বাবার 'তুই কিছুই পারিস না' রেগে গিয়ে ফেলা ফিডব্যাক। এখন সেই জিনিস ডিলিট না হোক, অন্তত ফোল্ডারে পাঠাও—“Outdated Opinions (Do Not Open)”.
পরের কাজ: ভাষা বদলাও। মানে নিজের সঙ্গে কথাবলার ভাষা। যেমন: “আমি সবসময় দেরি করি”—এর বদলে বলো “আমি সময় সময়ে ঝামেলায় পড়ি, কিন্তু ঠিক করতে পারি”। এ হল এমোশনাল গ্রামার রি-এডিটিং। শব্দ পাল্টালে ভাব পাল্টায়, আর ভাব পাল্টালে অভ্যাস পাল্টাতে বাধ্য।
আচ্ছা, আমরা তো এমোশন বলতে “ভালো”, “খারাপ”, “দুঃখ”, “গরুর দুধ খাইনি” এসব জানি। কিন্তু যদি বলি—“আমি অসহায় বোধ করছি, কারণ আমি অবমূল্যায়িত মনে করছি নিজেকে”—তখন সিচুয়েশন বদলায়। এই 'ভাষার রিকনস্ট্রাকশন'ই হিউম্যান থেরাপির নবজাগরণ।
থেরাপি? হ্যাঁ, সেটা এখন আর কেবল ন্যারেটিভ চ্যাংরা-চ্যাংরিদের ফ্যাশনেবল সেশন নয়। থেরাপি এখন মন-রন্ধনবিদ্যা। যেমন পেঁয়াজ কাটতে গেলে কাঁদতেই হয়—ঠিক তেমনি ভেতরের ইমোশন কাটলে জলের ধার আসে, আর থেরাপিস্ট হল সেই রাঁধুনি, যিনি বলে দেন, কোথায় কাটা, কোথায় লবণ বেশি।
আবার একটা মজার কথা—আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়েছি, তারা প্রায়শই একটা কাজ করি। নিজের ছেলেবেলার আঘাতগুলোকে সঙ্গীর ওপর প্রকল্প হিসেবে চাপিয়ে দিই। মানে, মা যদি না জড়িয়ে ধরতেন, প্রেমিকাকে বলি, “তুমি কেন এত কোল্ড?” মা যদি বকতেন, তখনের শাস্তির তৃষ্ণা এখনকার সম্পর্কে খুঁজে ফিরি। বোতোঁ বলেন, এসব বুঝে ফেললেই হবে না, সেটা নিয়ে কোমল হওয়া শিখতে হবে। কারণ, "তুই আমাকে কষ্ট দিলি" বলার আগে দরকার "তুই আমাকে সেই পুরনো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিস" বলার ভাষা।
আত্মচর্চা মানে আত্মজীবন রি-রাইট করা। সেই যে সমাজ বলেছে, “তুই ইঞ্জিনিয়ার হ”, “তুই পুরুষ, কান্না মানায় না”, “তুই মেয়ে, বেশি প্রশ্ন কোরো না”—এইসব Cultural Footnotes কাটাকুটি করে নিজের ফাইনাল ড্রাফট বানানো। মানে, নিজের স্ক্রিপ্টে অন্যের হস্তক্ষেপের ওপর ‘রিজেক্টেড’ স্ট্যাম্প মারা।
অবশ্যই, এর মধ্যে আবার কিছু আচরণ আছে, যেগুলো শোনায় ‘পাগলামি’র মতো—যেমন ছোটছোট জিনিসে ভয় পাওয়া, নিজের ওপর অত্যাচার চালানো, সম্পর্ক থেকে পালিয়ে যাওয়া—এই সব ‘ইলজিক্যাল’ জিনিস আসলে অনেক সময় ‘চাইল্ডহুড সারভাইভাল স্কিল’। বাচ্চাবেলার গর্তগুলো বড় হয়ে ভাসতে শুরু করে। তাই বোতোঁর ভাষায়, “এটা হাইড্রোজেন বোমা নয়, ছোটবেলার গ্লোবাল ওয়ার্মিং।”
সবশেষে, আমরা সবাই imperfect। এই এক টুকরো ছেঁড়া-বোতাম-না-লাগানো মানুষ। বোতোঁর স্কুল অফ লাইফ বলে, এটা মেনে নাও। কারণ ‘পরিপূর্ণতা’ হল এক বেহিসেবি মানদণ্ড, যেটা ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সার আর আত্মবিশ্বাসহীন নিটোল হিরোদের জন্য রাখা। আমাদের জীবনের কাহিনি একটু গড়বড় হলেও, নিজস্বতার সাহসে বলো—"এই আমিই, আমার রিপিট মোডের সঙ্গে, আমার বুকপকেটের পুরোনো কষ্ট নিয়ে।"
আর হ্যাঁ, সবশেষে বোতোঁর একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি—“Self-authorship is the goal.” নিজেকে লিখে চলা, ভাঙা-গড়া করে, মাঝে মাঝে চোখে জল এনে, মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরা—এই হল জীবন। এখানে কোনও এন্ডক্রেডিট নেই, শুধু একটা রি-রাইট অপশন থেকে যায়।
আর এইসব গপ্পো যদি ভালো লেগে থাকে, তবে বুঝে নিন—আপনি একজন দর্শনপ্রিয় পাঠক। নইলে এতক্ষণে টাইমলাইনের ফিড স্ক্রল করে নেক্সট পোস্ট দেখে ফেলতেন, "Top 10 Signs You’re Dating a Narcissist"।
বেঁচে থাকুন। নিজের মতো করে। তাতেই শান্তি। না হলে, একখানা “How Alain de Botton Can Change Your Therapy Bills” লিখে ফেলা যেতেই পারে!