উপনিবেশোত্তর, জাতীয় মুক্তি এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ: গ্রামশি ও ফানোঁ পুনর্বিবেচনা
আজফার হোসেনের ইংরেজি এই ভিডিও লেকচারে আমরা গ্রামশি ও ফানোঁ কীভাবে মুক্তির প্রশ্নগুলো চিত্রিত করেছেন, তার বিশ্লেষণ দেখবো।
উপনিবেশোত্তর, জাতীয় মুক্তি এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ: গ্রামশি ও ফানোঁ পুনর্বিবেচনা
রিটন খান
বিশ্ব চিন্তার জগতে উপনিবেশোত্তর ও জাতীয় মুক্তির প্রসঙ্গগুলোতে আন্তোনিও গ্রামশি ও ফ্রঁৎস ফানোঁনের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের রচনাগুলো ঔপনিবেশিকতা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গতিশীলতাকে বিশ্লেষণের জন্য এক অমূল্য দৃষ্টিকোণ প্রদান করে।
আজফার হোসেনের ইংরেজি এই ভিডিও লেকচারে আমরা গ্রামশি ও ফানোঁ কীভাবে মুক্তির প্রশ্নগুলো চিত্রিত করেছেন, তার বিশ্লেষণ দেখবো। বিশেষ করে ক্ষমতার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়েন এবং লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে, তাঁর এই বক্তৃতায় তা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে, আমরা তাদের তত্ত্বগুলো কীভাবে অসমাপ্ত উপনিবেশোত্তর প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো প্রেক্ষাপটে প্রতিধ্বনিত হয়, এবং বিশ্বব্যাপী মুক্তির নতুন কল্পনার জন্য কীভাবে তা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন।
গ্রামশির কাঠামো: আধিপত্যবাদ ও জাতীয় সংস্কৃতি
আন্তোনিও গ্রামশির আধিপত্যবাদের ধারণা সামাজিক ও রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার রূপ ধারণে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোগুলোর আন্তঃসম্পর্ক বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। গ্রামশির কাছে সংস্কৃতি কোনো প্রান্তিক বিষয় নয়; এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। অর্থনৈতিক সংস্কারের সম্প্রসারণ হিসেবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সংস্কারের প্রতি তার জোর এ দুটি ক্ষেত্রের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে প্রকাশ করে।
গ্রামশি বলেন, আধিপত্য কেবল সাংস্কৃতিক সম্মতি ও অর্থনৈতিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কাজ করতে পারে, যেখানে অর্থনীতি রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংহত করার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
এই বিশ্লেষণ উপনিবেশোত্তর প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলো প্রায়ই ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক নিশ্চিহ্নতার উত্তরাধিকারের সঙ্গে লড়াই করে। গ্রামশির “জাতীয়-জনপ্রিয়” সংস্কৃতির ধারণা এসব আন্দোলনকে একটি দৃষ্টিকোণ দেয়, যেখানে তারা সংস্কৃতিগত পরিচয় পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলার চেষ্টা করে।
ফানোঁনের দৃষ্টিভঙ্গি: ডিকলোনাইজেশন এবং শরীর
ফ্রান্তজ ফানোঁনের অসাধারণ রচনা, বিশেষ করে দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ, উপনিবেশোত্তরতার ক্ষেত্রে গ্রামশির অন্তর্দৃষ্টিকে আরও প্রসারিত করে। ফানোঁ শরীরকে উপনিবেশিক সহিংসতা ও প্রতিরোধের একটি ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরেন, দেখান কীভাবে উপনিবেশবাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষত প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার পরেও দীর্ঘস্থায়ী হয়। তিনি বর্ণবাদের সমস্যাকে কেবল ব্যক্তিগত মানসিক রোগ হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখার সমালোচনা করেন এবং একে একটি কাঠামোগত ও ঐতিহাসিক সমস্যা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যা উপনিবেশিক পুঁজিবাদের গহীনে প্রোথিত।
উপনিবেশোত্তরতাকে একটি সহিংস ও রূপান্তরকারী প্রক্রিয়া হিসেবে ফানোঁনের ব্যাখ্যা গ্রামশির প্র্যাক্সিসের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—যেখানে তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি বাস্তব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কার্যকর করতে হয়। তবে ফানোঁ আরও এগিয়ে গিয়ে উপনিবেশিত শরীর ও ভূমির মুক্তিকে বৈশ্বিক পুঁজিবাদী কাঠামো ধ্বংস করার সঙ্গে সংযুক্ত করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ এবং অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আন্তঃসম্পর্ককে তুলে ধরে, যা জাতীয় মুক্তি বিষয়ে সমসাময়িক বিশ্লেষণের জন্য ফানোঁনের কাজকে অপরিহার্য করে তোলে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট: এক অসমাপ্ত বিপ্লব
বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সাংস্কৃতিক পরিচয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের আন্তঃসম্পর্ককে উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপন করে। এই আন্দোলন কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই নয়; এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্যের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়ের জোরালো প্রকাশ। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রামশি ও ফানোঁনের তাত্ত্বিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা দেখায় মুক্তি আন্দোলনগুলো প্রায়ই একাধিক ফ্রন্টে পরিচালিত হয়।
তবে, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের গতিপথ ডিকলোনাইজেশনের প্রতিশ্রুতি টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্থায়িত্ব, সাংস্কৃতিক বিভাজন, এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখায় যে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য এখনো পূর্ণতা লাভ করেনি। এই অসমাপ্ত বিপ্লব আমাদেরকে পুনরায় গ্রামশি ও ফানোঁনের ধারণাগুলোর দিকে ফিরিয়ে আনে, বিশেষ করে তাদের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারকে প্রকৃত মুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখার তাগিদ।
উপনিবেশোত্তর ভবিষ্যৎ: শিক্ষা ও চ্যালেঞ্জ
গ্রামশি ও ফানোঁ উভয়েই উপনিবেশোত্তর ভবিষ্যৎ কল্পনার জন্য মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করেন। গ্রামশির বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি—যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণকে একত্রিত করে—উপনিবেশোত্তর সমাজের জটিলতা বোঝার জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তোলে। ফানোঁনের ঔপনিবেশিকতার মানসিক ও শারীরিক প্রভাব নিয়ে কাজ করার গুরুত্ব এই কাঠামোকে আরও প্রসারিত করে, মুক্তির জন্য একটি সামগ্রিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
তবে, তাদের ধারণাগুলো সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়নেরও আহ্বান জানায়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামশির সাংস্কৃতিক আধিপত্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার উপর জোর দেওয়া প্রান্তিক আন্দোলনগুলোকে উপেক্ষা করার ঝুঁকি সৃষ্টি করে, যেগুলো প্রায়শই আনুষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর বাইরে পরিচালিত হয়। একইভাবে, ফানোঁনের সহিংস প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ অনেক সময় অহিংস কৌশলের সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখতে বাধ্য করে।
আসলে আমাদের তাদের তত্ত্বগুলোকে প্রসঙ্গভিত্তিক এবং অভিযোজিতভাবে প্রয়োগ করার প্রয়োজন। এর মাধ্যমে উপনিবেশোত্তর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথ আরও কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে।
গ্রামশি ও ফানোঁনের রচনা ঔপনিবেশিকতার স্থায়ী উত্তরাধিকার এবং জাতীয় মুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খুবই প্রাসঙ্গিক। সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতির আন্তঃসম্পর্কে তাদের গুরুত্বারোপ একটি সমন্বিত কাঠামো প্রদান করে, যা এসব ইস্যু বোঝা ও সমাধানের জন্য অপরিহার্য। বৈশ্বিক পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ এবং নব্য ঔপনিবেশিকতার জটিলতায় পথ চলার সময় তাদের অন্তর্দৃষ্টি আরও ন্যায়সংগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেয়।
তাদের বহুমুখী এবং কর্মমুখী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে, ডিকলোনাইজেশন একটি ক্রমবর্ধমান এবং গতিশীল প্রকল্প হতে হবে। এটি কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণ নয়, বরং নিপীড়নের আন্তঃসংযুক্ত মাত্রাগুলিকে মোকাবিলার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি করে। তাদের কাজ পুনরায় পর্যালোচনা ও পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে আমরা এমন মুক্তির কৌশল তৈরি করতে পারি, যা আমাদের সামনে থাকা জটিল ও বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মতোই সূক্ষ্ম এবং বহুমুখী।