একেকটা বইকে হাতিয়ার করে লড়ো
বই কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, কখনো একঘেয়ে হয়ে উঠবে না—শুধু তোমার হাত বাড়ানোর অপেক্ষায় থাকবে, সবসময়।
বই আমার জন্য শুধু আশ্রয় নয়, পথপ্রদর্শকও। সমস্যা যখন পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়, তখন ভিক্টর ফ্র্যাংকেলের “Man’s Search for Meaning” পড়া যেন জরুরি ওষুধ হয়ে ওঠে। এক রাতে, জানলার কাচে বৃষ্টি পড়ার ছন্দ শুনতে শুনতে এক বাক্যের দেখা পেলাম— "জলে পড়ে গেলে মানুষ ডোবে না, ডোবে সে তখনই, যখন সে সেখানেই থেকে যায়।" কথাটা শুনে মনে হলো, হেমিংওয়ের “The Old Man and the Sea”-এর সেই বৃদ্ধ মৎস্যজীবীও হয়তো এই কথাই বলতেন, যদি কিউবায় বসে সিগার খেতে খেতে দার্শনিকতা ফলাতেন।
এই একটিমাত্র বাক্যই আমায় বুঝিয়ে দিল, জীবন শুধু ঝড়ের মুখে পাল খুলে দাঁড়িয়ে থাকার নাম নয়, জীবন মানে মাঝেমধ্যে হালও ধরতে হয়। শিখলাম, সমস্যার জন্য কাউকে দোষারোপ করার চেয়ে বরং নিজেই নিজের পরিস্থিতির কর্তা হয়ে ওঠা জরুরি।
এ যেন সেই দৃশ্য— এক লোক সমুদ্রে পড়েছে, তখন অন্যেরা বলছে, “পানিতে থাকলেই তো ডুবে যাবে, ওপরে ওঠো!” কিন্তু লোকটি বলে, “আমি তো জাস্ট ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে থাকতে চাই, আর একটু ভাবতে চাই, জীবনদর্শনটাকে আরেকটু ঠিকঠাক বুঝতে চাই।” এরকম ভাবতে ভাবতেই হয়তো ঢেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল এমন জায়গায়, যেখানে সমস্যা আসবে, সমাধানও আসবে, কিন্তু হাত-পা না চালালে তলিয়ে যেতেই হবে।
বব ডিলানের গানেই আছে— “He not busy being born is busy dying.” এই লাইনটা যেন মনের মধ্যে বাজতে থাকল, একেবারে পুরনো ফ্যানের ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ আওয়াজের মতো, যা একবার চালু হলে আর থামতেই চায় না। জীবন যে আসলে এক চলমান ট্রেন, যেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই—এটাই যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়। পরিবর্তন থেমে গেলেই যেন ক্ষয় শুরু হয়, আর তাই টিকে থাকার একমাত্র উপায় হলো প্রতিনিয়ত নতুন করে জন্মানো, নিজেকে নবীন করে তোলা।
জীবন এক নদী, আর আমরা সবাই তার স্রোতে ভাসমান নৌকো। সমস্যা একটাই—পাল তুললে এগোতে পারি, না তুললে তলিয়ে যেতে হয়। নদীর বাঁক, স্রোতের টান, ঝড়ের দাপট—সবই আসবে, কিন্তু প্রতিবার নিজেদের নতুনভাবে গড়ে নিলেই কেবল পার হওয়া যাবে। জীবন তাই কেবল বেঁচে থাকার নাম নয়, বরং প্রতিদিন এক নতুন আমি হয়ে ওঠার লড়াই।
উত্তরের সন্ধানে আমি ডুবে গেলাম জাঁ-পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী লেখায়। তাঁর “Being and Nothingness” যেন এক বিস্তৃত মানচিত্র, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা আর সামাজিক দায়িত্ববোধের টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সার্ত্র তো বলেই গেছেন— “Man is condemned to be free; because once thrown into the world, he is responsible for everything he does.”
এই কথাটা পড়ার পর মনে হলো, স্বাধীনতা আসলে কোনো উপহার নয়, বরং এক ভয়াবহ দায়। যে মুহূর্তে তুমি নিজেকে স্বাধীন ভাবতে শুরু করবে, সে মুহূর্তেই বুঝবে, তোমার প্রতিটি সিদ্ধান্তের দায় একান্তই তোমার। কোনো বাহানা নেই, কারও ঘাড়ে দোষ চাপানোর উপায় নেই—তুমি যা করছ, তার ভালো-মন্দ সব কিছুর ভার তোমাকেই বইতে হবে।
বলাই বাহুল্য, এটা শুনতে যতটা বিপুল, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি নির্মম। কারণ, জীবন কেবল সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়া নয়, সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সঠিক পথ বেছে নেওয়ার ভয়াবহ অনিবার্যতা।
বারাক ওবামার আত্মজীবনী “The Audacity of Hope” পড়তে গিয়ে একটা লাইন যেন মনের মধ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে বসলো— “Change is never easy, but it is always possible.” এই কথাটা একসময় নিছক বাক্য মনে হলেও, ক্রমে হয়ে উঠল আমার জীবনের মন্ত্র, একরকম আত্মস্থ করা বিশ্বাস।
জীবনের কঠিনতম সময়গুলোতে, যখন মনে হয় সব পথ বন্ধ, তখনই এই কথাটা ফিরে ফিরে মনে পড়ে—পরিবর্তন সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। এটা যেন সেই দীর্ঘ যাত্রার গল্প, যেখানে ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কারণ জানি, সামনে পথ আছে, আছে সম্ভাবনা।
একটা পরিবর্তন হয়তো ধীরগতির, হয়তো অপ্রত্যাশিত, কখনোবা অবাঞ্ছিত—কিন্তু দিনশেষে, যাত্রাটা থেমে যাওয়ার নয়। বেঁচে থাকার অর্থই হলো এগিয়ে যাওয়া, যেকোনো মূল্যে, যেকোনোভাবে।
বইগুলো যেন আমার নীরব পথপ্রদর্শক—আলোর মতো তারা পাশে থেকেছে, আনন্দের মুহূর্তে সঙ্গী হয়েছে, দুঃখের দিনে শান্তনা দিয়েছে, আর আমাকে শিখিয়েছে দুনিয়াকে সাদাকালো নয়, অসংখ্য শেডের ভেতর দিয়ে দেখতে। ভার্জিনিয়া উলফের “To the Lighthouse”-এর ধীর স্থির চিন্তামগ্নতা থেকে ফিটজেরাল্ডের জে গ্যাটসবির অদম্য উচ্চাভিলাষ—সবই একে একে খুলে দিয়েছে দৃষ্টির নতুন জানালা।
মার্গারেট অ্যাটউড তো বলেইছেন— “A word after a word after a word is power.” আসলেই, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি গল্প, প্রতিটি বাক্য আমার ভেতরে কোথাও না কোথাও দাগ কেটেছে। যা পড়েছি, যা শুনেছি—সবকিছু মিলিয়েই গড়ে উঠেছে আমার বোধ, আমার উপলব্ধি, আমার দৃষ্টিভঙ্গি। বই শুধু কাগজে ছাপা কিছু নয়, তারা আসলে সময়ের সঙ্গে আমার কথোপকথন, আত্ম-অনুসন্ধানের প্রতিধ্বনি।
আমি জানি, এই উপলব্ধিগুলো আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে, আর ঠিক সেই পরিবর্তনটাই তোমার জন্যও কামনা করি। মনে রেখো, বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা শুধু গল্প বলে না—তার ভাঁজে লুকিয়ে থাকে আত্ম-উন্নয়নের দরজা, দৃষ্টির প্রসার, আর অজানা জগতের সন্ধান।
তাই বইকে শুধু পড়ার জন্য বই হিসেবে দেখো না, ওগুলোকে বানিয়ে নাও জীবনের সঙ্গী, নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। প্রয়োজন হলে একেকটা বইকে হাতিয়ার করে লড়ো, কখনো আবার আশ্রয় খুঁজে নাও এর শব্দের আড়ালে। বই কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, কখনো একঘেয়ে হয়ে উঠবে না—শুধু তোমার হাত বাড়ানোর অপেক্ষায় থাকবে, সবসময়।
অসাধারণ লিখেছেন । ভালো বই গুলো সত্যি এই বিশ্বের মুক্ত দুয়ার যার মধ্য দিয়ে আলোর প্রবেশ আমাদের অন্তর্বিশ্বকে আলোকিত করার মাধ্যমে বহির্বিশ্ব কে আলোকিত করে।
লেখাটা দারুণ ৷ অনন্য ৷ এমন লেখা আরও পড়তে চাই ৷