তানভীর ইসলামের ‘হদিস’
হদিস ও Whereabouts পাশাপাশি পড়লে পাঠক বুঝবেন যে তানভীর এখানে মূলের সাথে থেকেও নিখুঁতভাবে বাংলাভাষায় রূপান্তর করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে লেখকের স্বাধীন ইচ্ছা ও মৌলিকতা আসলে তাঁর সংস্কৃতির সীমারেখার মধ
অনেকের কাছে অনুবাদ যেন সাহিত্যের অবৈধ সন্তান—মরিচিকার মতো কিছু। আবার অন্যদের কাছে, অনুবাদ হল এক রাজপথ—যা আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া এবং সাহিত্যিক সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি কেবল শিল্প ও কারিগরির মাঝের সীমারেখায় দাঁড়িয়েই নয়, বরং মৌলিকতা ও প্রতিলিপি, নিঃস্বার্থতা ও বাণিজ্য, এমনকি প্রতিভা ও ভাড়াটে লেখার মধ্যেও পায়চারি করে। খ্যাতিমান অনুবাদক ভ্লাদিমির নবোকভ একে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “তোতাপাখির ডাক, বাঁদরের বকবক, / এবং মৃতের অবমাননা।” অথচ, এজরা পাউন্ড, স্যামুয়েল বেকেট, রবার্ট লোয়েল, এলিজাবেথ বিশপ, কেনেথ রেক্সরথ, টেড হিউজ, জন অ্যাশবেরি, লিডিয়া ডেভিস, হ্যারি ম্যাথিউজ, এমনকি বোদলেয়ার, বোরহেস, ম্যান্ডেলস্টাম, পাস্তেরনাক, পল সেলান, সেজারে পাভেজ, বোনফোয়া, হারুকি মুরাকামি, ও পিটার হ্যান্ডকে—এঁরা প্রত্যেকেই এমন অনুবাদ রচনা করেছেন, যা নিজস্ব সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে।
সম্প্রতি তানভীর ইসলামের অনুবাদে ঝুম্পা লাহিড়ির Whereabouts (হদিস) পড়লাম। মূল বইটি পড়েছিলাম কোভিডের আগের বছর। তানভীরের অনুবাদ পড়ার উদ্দেশ্য হলো অনুবাদটা বোঝা। আসলে অনুবাদটাই পড়া। তাই আমি Whereabouts গল্পের আলোচনায় যাবো না। আমি তানভীরের অনুবাদ নিয়ে আমার বক্তব্যটি জানাবো।
একটি প্রচলিত বাগধারা আজও অনুবাদকদের বিরক্তি ও হতাশার কারণ—ইতালীয় শব্দবন্ধ “traduttore, traditore” অর্থাৎ "অনুবাদক মানেই বিশ্বাসঘাতক"। এই কথাটি যেন বোঝাতে চায়, অনুবাদক কেবল এক নির্বোধ নন, বরং এক বিশ্বাসঘাতক প্রতারক। আমি নিজে অনুবাদ করি তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের আগে এই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ আদৌ কোথায় নিহিত এবং তা কার বিরুদ্ধে—সেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাক।
বিশ্বাসঘাতকতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক হলো—শব্দের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। কারণ, শব্দই ভাষার মর্ম—আমাদের দেখা, অনুভব ও কল্পনার প্রতিটি জিনিসের রূপক। আর এই পথ ধরেই ঘটে ভাষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা—দুই দিক থেকেই। ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির সৃষ্টি—বা হয়তো উল্টোটা, এমন দাবিও কিছু সাহসী নৃতাত্ত্বিক করে থাকেন। সেক্ষেত্রে, যখন আমরা শব্দ ও বাচনভঙ্গির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি, তখন এই সংস্কৃতির প্রতিও আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা অনিবার্য হয়।
এরপর আসে ব্যক্তিগত বিশ্বাসঘাতকতা—যারা অনুবাদের প্রক্রিয়ায় জড়িত, সেই সব মানুষদের প্রতিও। প্রথম ও প্রধান ভুক্তভোগী হচ্ছেন লেখক নিজে, যাঁর রচনাকে আমরা অনুবাদ করছি। প্রশ্ন জাগে—আমরা কি পারি লেখকের সৃষ্টির এক ভিন্নবর্ণ প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করতে? আমরা কি সত্যিই অনুভব করতে পারি সেই আবেগ, যা লেখকের কলম থেকে জন্ম নেয়, সেই শব্দগুচ্ছ যা আমরা রূপান্তর করছি?
সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে, আমরা নিজেদের প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা করি। অনুবাদ-দায়িত্বের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার ভয়ে, আমরা অনেক সময় নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজ্ঞান ত্যাগ করি—মাথা নত করি কোনো নিষ্প্রাণ গড়পড়তা মানের সামনে।
অনুবাদের জন্য চাই শব্দ। কারণ শব্দ, পরিণামে, কোনো বস্তু নয়—শুধু তাদের রূপক মাত্র। এ কথাটি দারুণ ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরা হয়েছে Gulliver’s Travels-এর তৃতীয় খণ্ডে, যেখানে গালিভার পৌঁছে যায় ল্যাগাডো নগরীতে এবং সেখানকার গ্র্যান্ড অ্যাকাডেমি ঘুরে দেখে। সেখানে সুইফটের সৃষ্ট 'প্রোজেক্টর'-রা এক অভিনব পরিকল্পনার কথা জানায়—কীভাবে মুখে শব্দ ব্যবহার না করে ফুসফুসকে বিশ্রাম দিয়ে কথা বলা যায়। যেহেতু শব্দ কেবল জিনিসের নামমাত্র, তাই প্রস্তাব দেওয়া হয়, প্রত্যেকের উচিত সঙ্গে করে সেইসব বস্তু বহন করা, যেগুলো দিয়ে তারা তাদের আলোচ্য বিষয়ে মত প্রকাশ করতে পারে।
এই প্রস্তাব শুধু দীর্ঘায়ু দেবে না, বরং পৃথিবীর বহু ভাষার দরকারও মুছে দেবে। সুইফট সম্ভবত এখানে শ্রেণিগত বৈষম্যের দিকেও ইঙ্গিত করছেন—ধনী ব্যক্তি তাঁর চাকরবাকর দিয়ে একগাদা 'বস্তু' বহন করিয়ে নিজের বক্তব্য জোরালোভাবে প্রকাশ করতে পারবেন, যেখানে দরিদ্র মানুষকে হয়তো একখানা পুরোনো ঝোলাই ব্যাগেই সেরে নিতে হবে। বাস্তব জীবনেও—একজন ধনী, শিক্ষিত মানুষ তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেন বহুগুণ স্পষ্ট ও দক্ষভাবে, সেখানে দরিদ্র নিরক্ষর ব্যক্তি হারিয়ে যায় মৌনতার ভেতরে।
হদিস ও Whereabouts পাশাপাশি পড়লে পাঠক বুঝবেন যে তানভীর এখানে মূলের সাথে থেকেও নিখুঁতভাবে বাংলাভাষায় রূপান্তর করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে লেখকের স্বাধীন ইচ্ছা ও মৌলিকতা আসলে তাঁর সংস্কৃতির সীমারেখার মধ্যেই কার্যকর। যদি তিনি সেই সংস্কৃতিকে অতিক্রম করেন বা তার প্রতি বিরোধিতা করেন, তা করেন সেই সংস্কৃতির অন্তঃস্থ গভীর উপলব্ধি থেকেই—একটি ঘনিষ্ঠ জ্ঞানের ভেতর থেকে।
কিন্তু তানভীর? তিনি সেই সংস্কৃতির বাইরের মানুষ—তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা আসে এক ধরনের প্রাকটিসকৃত প্রতিফলিত চেতনা থেকে, যা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, আত্মসিদ্ধ নয়। সেইজন্য অনুবাদক যেভাবে সংস্কৃতিকে প্রতারণা করেন, তা লেখকের অন্তর্গত বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে অনেক বেশি দূরত্বে অবস্থিত—তাত্ত্বিক, অনভ্যস্ত, এবং অনিবার্যভাবে ভিন্ন।
নিজের সংস্কৃতির পরিসরের মধ্যে থেকেও একজন লেখক—একজন ব্যক্তি হিসেবে—চেষ্টা করেন, এবং করতেই হয়, নিজেকে এবং তাঁর শিল্পকে সাধারণতার গণ্ডি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। সেই যাত্রায়, বারবার তিনি প্রকাশ করেন—কোথা থেকে তিনি এসেছেন, এবং সেটি প্রকাশ করেন মূলত ভাষার মাধ্যমেই।
অথচ তানভীরের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো এক বাস্তবতা। তিনি কোনোভাবেই নিজেকে সেই সংস্কৃতি থেকে পৃথক করতে পারেন না—যে সংস্কৃতিকে সামনে রেখে অনুবাদ করছেন। বরং সেটি করলে তা হতো প্রকৃত অর্থেই এক বিশ্বাসঘাতকতা। তানভীর তাঁর শব্দগুলিকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে লেখকের অভিপ্রায়ের সঙ্গে বিরোধ তৈরি না হয়।
একজন অনুবাদকের সচেতন থাকা আবশ্যক, লুকিয়ে থাকে সবচেয়ে দুঃখজনক বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভাবনা—নিজের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা। আমাদের মনে রাখতে হবে, তানভীর নিজেও একজন লেখক। প্রকৃতপক্ষে, তিনি এমন এক লেখক যাঁকে বলা চলে আদর্শ লেখক, কারণ তাঁর জন্য সবকিছু—কাহিনি, থিম, চরিত্র—আগেই প্রস্তুত। তাঁর কেবল কাজ—লিখে ফেলা, মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে। কিন্তু তিনি কেবল লেখকই নন, তিনি একজন পাঠকও বটে। তাঁকে পাঠ্যপুস্তক গভীর মনোযোগে পড়তে হয়—এবং সেখানেই আসে বিপত্তি। পাঠ্য অনেক সময় যথেষ্ট দিকনির্দেশনা দেয় না, বরং অনুবাদককে নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে তা উদ্ধার করতে হয়। অনুবাদকের পাঠ আসলে হয়ে ওঠে লেখালেখিরই একটি ভিন্নতর রূপ—যেখানে প্রতিটি বাক্যই বহন করে নিজস্ব রচনাশক্তি, অথচ সেই শক্তির উপর আছে আত্মসংবরণের ভার। এখানে নিজেকে ভুলে যাওয়াই সবচেয়ে করুণ বিশ্বাসঘাতকতা।
তানভীরকে বুঝতে হবে—এই সময়ে, এই স্থানিক বাস্তবতায়—তিনি যা করছেন, সেটিই তাঁর সেরা প্রয়াস। তবুও, তাঁকে এটাও মানতে হবে—এই কাজ এক অর্থে কখনোই সম্পূর্ণ নয়। আমার নিজেরও অনেকবার এমন হয়েছে—অনুবাদ শেষ করে তৃপ্তি পেয়েছি। কিন্তু কয়েক মাস পর যখন সেই অনুবাদ নতুন করে পড়ি, মনে হয়—ইশ, এখানে বা ওখানে একটু বদল আনলে হয়তো আরও ভালো হতো।
তানভীরকে বলবো কখনোই যেন তিনি তাঁর নিজের পূর্বাভাস বা অন্তর্জ্ঞানকে অবিশ্বাস না করেন। সমালোচকেরা অভিযোগ করবেই, কিন্তু এই বিশ্বাস থেকেই তিনি সঠিকের কাছাকাছি থাকবেন—সবচেয়ে বড় কথা, তিনি নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। নিজের ওপর এই মননশীল আস্থা—অনুবাদকের ক্ষেত্রেও ততটাই অপরিহার্য।
তানভীরের কাজকে সবচেয়ে প্রাথমিক স্তরে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায়—এটি এক আত্মবিলোপকারী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে এক ভাষায় রচিত পাঠ অন্য ভাষায় পুনঃনির্মিত হয়। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি হলো আত্মবিলোপকারী (self-effacing)—এই শব্দটি ধারণা দেয় যে, আদর্শ অনুবাদে মূল ঝুম্পার কণ্ঠস্বর যেন অবিকৃত থাকে, যদিও তা ভিন্ন শব্দে, ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে, তানভীরের নির্মিত রূপান্তর-ফ্রেমের মধ্য দিয়ে। অবশ্য কিছু অনুবাদ এমন রয়েছে—যেগুলো নিজস্ব পরিচিতি অর্জন করেছে, যেমন এডওয়ার্ড ফিটজজেরাল্ডের Rubáiyát বা এজরা পাউন্ডের Cathay—অনেক সময় লেখকের চেয়েও বেশি পরিচিত।
তানভীরকে মনে রাখতে বলবো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, অনুবাদের এই নিরব পরিশ্রমীরা—যতই প্রতিভাধর হোন না কেন—থেকে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাঁরা নীরব, অদৃশ্য, অথচ সদা প্রস্তুত—একটি অভিজাত বাড়িতে যেন পরিচারকের মতো, যাঁদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় কেবল সেই চতুর, ঈগলচক্ষু ও মনোযোগী পাঠকদের দ্বারাই।