ক্ষমতার চিরন্তন চক্র: ইবন খালদুন ও ইতিহাসের দর্শন
সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার উত্থান-পতনের অন্তর্নিহিত সূত্রের অনুসন্ধান
ইবন খালদুনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব আজকের পৃথিবীতে এমন এক বিস্তৃত মহাসাগর, যেখানে এঙ্গেলস থেকে রিগান, টয়নবি থেকে তামবুররলেন সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁর চিন্তার ঢেউয়ের সংস্পর্শে এসেছেন। অথচ আরবি ভাষাভাষী জগতে তাঁর চিন্তার যথাযথ মূল্যায়ন আজও হয়নি, বরং ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কখনো কখনো তাঁকে ওরিয়েন্টালিস্ট বলেও চালানো হয়েছে। রবার্ট আরউইন যেমন এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমের সমালোচনা করতে গিয়ে মুসলিম পণ্ডিতদের এক ধরনের রোমান্টিকীকরণের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তেমনি ইবন খালদুনও ইতিহাসের এক অদ্ভুত ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছেন—যাঁর নাম উচ্চারিত হয় একদিকে মুসলিম সভ্যতার তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে, আবার অন্যদিকে পশ্চিমা উপনিবেশবাদী বুদ্ধিবৃত্তির ‘অনুমোদিত’ মুসলিম চিন্তানায়ক হিসেবে।
‘আমার পিঠ ভেঙে ফেলার মতো যদি কিছু থাকে, তবে তা আমার বই’—ইবন খালদুনের এই উক্তি কেবলমাত্র পাণ্ডুলিপির ভারে নুয়ে পড়া কোনো হতভাগ্য পণ্ডিতের দীর্ঘশ্বাস নয়; বরং তা জ্ঞানসাধনার এক দুর্বিষহ, অথচ অপরিহার্য পরিণামের স্বীকারোক্তি। চতুর্দশ শতকের এই মুসলিম চিন্তক ইতিহাসের প্রথম সমাজবিজ্ঞানী, যিনি সভ্যতার উত্থান-পতনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুঝেছিলেন, মানুষের ভাগ্যকে শাসন করে মূলত তার সামাজিক কাঠামো, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া।
ইবন খালদুন জন্মেছিলেন তিউনিসে, যা তৎকালীন সময়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল না, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর রক্তের মধ্যে বইছিল। ধর্মতত্ত্বের অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছানো ছিল মুসলিম বিশ্বের ‘এলিট ট্র্যাক’—এবং তিনি ঠিক সেই পথেই এগিয়েছিলেন। তবে, ইতিহাসের পরিহাস ছিল যে, তিনি কখনোই এক জায়গায় স্থিত হতে পারেননি। জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে বন্দিত্ব, নির্বাসন, জলদস্যুদের হাতে বন্দি হওয়া এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণিপাকে। এক অর্থে, তাঁকে বলা যেতে পারে ইতিহাসের প্রথম বহিরাগত—একজন নি:সঙ্গ যাত্রী, যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ছুটে বেড়িয়েছেন এবং সেই ভ্রাম্যমাণ অবস্থান থেকেই সভ্যতার বিশ্লেষণ করেছেন।
ইবন খালদুনের চিন্তা মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বে ছিল প্রায় বৈপ্লবিক। তিনি ইতিহাসকে শুধু ঘটনার ধারাবিবরণী হিসেবে দেখেননি; বরং তিনি সমাজের গঠন, রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব, শাসকের প্রকৃতি এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার জন্য এক বৈজ্ঞানিক মডেল দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ‘আসবিয়াহ’ তত্ত্ব—যার মাধ্যমে তিনি জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের উত্থান-পতনের বিশ্লেষণ করেছেন—আজও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইতিহাসের জটিল বিন্যাসে ইবন খালদুন এমন এক চরিত্র, যিনি একদিকে রাজসভার স্নেহধন্য ছিলেন, আবার অন্যদিকে ছিলেন নি:সঙ্গ পথিক, যাঁর চিন্তার স্বতন্ত্রতা এবং গভীরতা তাঁকে চিরকালীন বহিরাগত করে তুলেছে। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই লিখেছেন, কীভাবে তিনি কখনো শাসকের স্নেহভাজন, কখনো ষড়যন্ত্রের শিকার, আবার কখনো বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। তবু এই বিচিত্র অভিজ্ঞতাই তাঁকে তৈরি করেছিল এমন এক ঐতিহাসিক দার্শনিক হিসেবে, যাঁর পর্যবেক্ষণ আজও প্রাসঙ্গিক।
ইবন খালদুনের জীবন যেন এক পরিভ্রমণের মহাকাব্য। তাঁর প্রথম পঞ্চাশ বছর কাটে উত্তর আফ্রিকার একাধিক রাজদরবারে, গ্রানাডার সভায়, প্রশাসনিক গোলকধাঁধায় অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করে। তবে তাঁর চিন্তার শ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটে কায়রোতে, যে নগরী শুধুমাত্র ইসলামের গৌরবময় কেন্দ্রই নয়, বরং মধ্যযুগের সমগ্র বিশ্বসভ্যতার এক দুর্ধর্ষ সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও জ্ঞানচর্চার দুর্গ। কায়রোতে এসে ইবন খালদুন যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার সম্মুখীন হলেন। তাঁরই বর্ণনায়:
"যে কায়রো দেখেনি, সে জানে না ইসলামের মহিমা। এটি বিশ্বের রাজধানী, ব্রহ্মাণ্ডের বাগান, জাতিসমূহের মিলনস্থল, মানবজাতির কোলাহলমুখর, ইসলামের দ্বারপ্রান্ত, রাজকীয় আসন..."
এই মহিমান্বিত উচ্চারণের পেছনে ছিল এক তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা, এক জটিল সামাজিক কাঠামো, এবং এক বিচিত্র আমলাতন্ত্র, যা মধ্যযুগের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্যের ভিত্তি রচনা করেছিল। বাস্তবিক অর্থে, ইবন খালদুন যখন কায়রোতে পৌঁছান, তখন শহরটি একটি বিশাল ও কোলাহলপূর্ণ নগরী, যার জনসংখ্যা ছিল চার মিলিয়নের কাছাকাছি। অথচ মাত্র তিন দশক আগেই ব্ল্যাক ডেথের ভয়াল ছোবলে এই শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তবু ইউরোপের যেকোনো শহরের তুলনায় কায়রো ছিল অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত।
তখন মিশরের শাসন ছিল মামলুকদের হাতে—এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে শাসকেরা একসময় দাস ছিল। মধ্যযুগীয় মুসলিম জগতে মামলুকরা এক ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান: তুর্কি ও ককেশীয় বংশোদ্ভূত কিশোরদের দাস হিসেবে সংগ্রহ করে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, এবং এরা কালক্রমে হয়ে উঠত সাম্রাজ্যের অভিজাত যোদ্ধা-শাসক। এক শতাব্দী ধরে এই ব্যবস্থায় তারা নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থেকেছে, কেউ কেউ স্বতন্ত্র রাজবংশ গড়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিল ক্ষণস্থায়ী।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও মামলুক সাম্রাজ্য ছিল এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র, যার অধীনে বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও হেজাজের বিশাল অঞ্চল সংযুক্ত ছিল। বাণিজ্যও ছিল অত্যন্ত সক্রিয়; দামেস্ক, জেরুজালেম ও আলেপ্পোর মতো শহরগুলি কায়রোর সঙ্গে এক অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে জড়িত ছিল। কায়রো ছিল ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যবর্তী সেতু, যার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের অর্থনৈতিক প্রবাহ সংঘটিত হতো।
১৩৮৩ সালে ইবন খালদুন যখন কায়রোতে স্থায়ী হলেন, তখন ক্ষমতায় ছিলেন বারকুক, এক সারক্যাসিয়ান মামলুক, যাঁর শাসনে আমলাতন্ত্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বণিক সম্প্রদায় এক জটিল ভারসাম্য রক্ষা করত। তবে এর নিচে ছিল এক বিশাল শ্রমজীবী শ্রেণি—নগরীর দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, এবং শাসনযন্ত্রের তলার দিকে চাপা পড়ে থাকা মানুষেরা, যাঁরা কৃষিজীবী না হয়েও শহুরে বঞ্চিত শ্রেণির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল।
ইবন খালদুন কায়রোতে এসে শুধু প্রশাসনিক উচ্চপদে আসীন হননি, বরং তিনি এখানে বসেই তাঁর ইতিহাসতত্ত্বের গভীরতর ব্যাখ্যা দাঁড় করান। মামলুকদের অস্থায়ী শক্তি, বাণিজ্যের উত্থান-পতন, শহুরে নিম্নবর্গের চঞ্চলতা—সবকিছুকে তিনি দেখেছিলেন এক বৃহত্তর সামাজিক শক্তির অংশ হিসেবে।
ইতিহাসের যে দর্শন তিনি রচনা করেছেন, তা শুধু এক নির্দিষ্ট সময় বা সাম্রাজ্যের জন্য নয়, বরং সমগ্র সভ্যতার উত্থান-পতনের এক সার্বজনীন তত্ত্ব। কায়রো ছিল তাঁর জন্য এক পরীক্ষাগার, যেখানে তিনি সমাজের ভেতরকার কাঠামোকে প্রত্যক্ষ করে লিখেছিলেন এক অমর গ্রন্থ—আল-মুকাদ্দিমা।
মিশরে ক্ষমতার যখন দাস-যোদ্ধারা, তখন অর্থনীতির ভিত্তি ছিল ‘ইকতা’ নামক এক অস্থায়ী জমিদারি ব্যবস্থা, যেখানে মামলুক ও সামরিক প্রশাসকদের মধ্যে কৃষিজমি বণ্টন করা হতো। কিন্তু এটি ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের মতো উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা বহন করত না। কোনো মামলুক শাসক নিজ জমিতে থাকতেন না, মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানদের কাছে সেই জমি হস্তান্তরও করা হতো না। ফলে জমির প্রতি দীর্ঘমেয়াদী কোনো বিনিয়োগের সুযোগ ছিল না, বরং শাসকদের আয় নির্ভর করত কর আদায়ের চাতুর্যের ওপর। রাজস্ব ব্যবস্থার এই চক্রাকার টানাপোড়েন বোঝার জন্য ইবন খালদুন ছিলেন একেবারে আদর্শ ব্যক্তি।
ইবন খালদুনের জন্য কায়রো ছিল তাঁর চিন্তাভাবনার বাস্তব পরীক্ষাগার। মামলুক শাসনের অর্থনৈতিক নীতিগুলি তাঁর চোখের সামনে ধাপে ধাপে ভেঙে পড়ছিল, এবং তিনি এই কাঠামোর তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করছিলেন। ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম প্রধান আইনজ্ঞ হিসেবে তিনি মালিকি মাযহাবের প্রধান বিচারক (কাদি) নিযুক্ত হয়েছিলেন, যেখানে ধর্মীয় প্রশাসনের কঠোরতা ও বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হতো। তাঁর বিচারধারা ছিল অনন্য—সর্বদা ক্ষমতার স্রোতের দিক বোঝার চেষ্টা করতেন, কিন্তু নিজে কখনো সেই স্রোতে ভেসে যেতে রাজি ছিলেন না।
তিনি ইতিহাসের এমন এক দার্শনিক, যাঁর চিন্তা আধুনিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে, যদিও তিনি নিজে কখনো ‘আধুনিক’ হতে চাননি। তিনি ইতিহাসের পেছনের কার্যকারণ খুঁজেছেন—শাসনব্যবস্থা কীভাবে বদলে যায়, রাজবংশগুলো কেন পতনের দিকে ধাবিত হয়, এবং সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের গভীর গতিশীলতা কীভাবে কাজ করে।
তাঁর যুগান্তকারী আল-মুকাদ্দিমা গ্রন্থে তিনি প্রথমবারের মতো দেখালেন, কেবল যুদ্ধ, শাসন বা রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাস নয়; বরং সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি, উৎপাদনব্যবস্থা, এবং শাসনব্যবস্থার গতিশীলতা ইতিহাসকে গঠিত করে। আর এখানেই ইবন খালদুন আধুনিক দার্শনিকদের চেয়েও অগ্রগামী ছিলেন। কারণ ইবন খালদুনের দৃষ্টি শুধু অতীতের দিকে ছিল না, বরং তিনি ইতিহাসের গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎকেও পড়তে চেয়েছেন।
তাঁর বিশ্লেষণে এক ধরনের চক্রাকার ঐতিহাসিক বাস্তবতা দেখা যায়—একটি জাতি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তা প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে বিলাসিতা, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতায় জর্জরিত হয়, এবং অবশেষে পতনের দিকে ধাবিত হয়। এই পর্যবেক্ষণই আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইবন খালদুনের ইতিহাসবিশ্লেষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তাঁর ‘আসাবিয়া’ তত্ত্ব—এক ধরনের সামাজিক সংহতির ধারণা, যা তিনি সভ্যতার বিকাশ ও পতনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রতিটি শক্তিশালী রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের পেছনে একটি সুদৃঢ় সামাজিক সংহতি থাকে, যা রাজনৈতিক শক্তি ও সামরিক সামর্থ্যকে সংহত রাখে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সংহতি চিরস্থায়ী নয়; বরং এটি এক বিশেষ চক্রের মধ্য দিয়ে চলে।
প্রথমে, একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী (ক্ল্যান বা উপজাতি) একত্রিত হয় এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সংহতি (আসাবিয়া) তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যায়। তারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং সামরিক ও প্রশাসনিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। কয়েক প্রজন্ম পর, প্রাচুর্য ও বিলাসিতার অভ্যাস তাদের গোষ্ঠীগত সংহতি দুর্বল করে ফেলে। শাসকদের মধ্যে আলস্য ও আত্মতুষ্টি বৃদ্ধি পায়। শাসকগোষ্ঠী যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন একটি নতুন শক্তিশালী গোষ্ঠী তাদের উৎখাত করে এবং একটি নতুন শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এই চক্র বারবার পুনরাবৃত্ত হয়—শক্তিশালী গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে, দুর্বল হয়, এবং নতুন শক্তি তাদের স্থান দখল করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত রাজনৈতিক ইতিহাসকে এক রৈখিক (linear) ধারার পরিবর্তে এক চক্রাকার প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে, যা ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চার জন্য এক নতুন দৃষ্টিকোণ খুলে দিয়েছিল।
ইবন খালদুনের এই তত্ত্ব আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়নবি তাঁর A Study of History গ্রন্থে ইবন খালদুনের তত্ত্বের প্রশংসা করে বলেছেন যে, সভ্যতার উত্থান ও পতনের বিষয়ে ইবন খালদুনের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীদের চেয়ে অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত।
রবার্ট আরউইন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, কিভাবে ইবন খালদুনের চিন্তাভাবনা পাশ্চাত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। মধ্যযুগের ইউরোপীয় ইতিহাসবিদরা সাধারণত ঘটনাক্রম অনুযায়ী রাজাদের কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করতেন, কিন্তু ইবন খালদুন ইতিহাসকে একটি বিশ্লেষণাত্মক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসেন, যেখানে অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির কার্যকারণ অন্বেষণ করা হয়।
আরউইন দেখিয়েছেন, ইবন খালদুন কেবল মধ্যযুগীয় মুসলিম পণ্ডিত নন, বরং তাঁর চিন্তার রেখাগুলো আধুনিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে এক বিতর্ক থেকেই যায়—তিনি কি আসলে এক র্যাশনালিস্ট দার্শনিক, নাকি সুফিবাদের প্রতি অনুরক্ত এক ভাববাদী চিন্তাবিদ?
ইবন খালদুন তাঁর রচনায় সুফিবাদের প্রসঙ্গ এনেছেন বটে, কিন্তু তিনি কখনোই মূলধারার সুফি ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন এক দার্শনিক পর্যবেক্ষক, যিনি মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রবৃত্তিকে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের আওতায় এনেছিলেন। তাঁর লেখায় সুফিবাদের প্রতি একধরনের আকর্ষণ থাকলেও তিনি বাস্তববাদী ছিলেন এবং রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ঠান্ডা বিশ্লেষণের চোখে দেখতেন।
আজকের বিশ্ব যখন ইতিহাসকে ক্ষমতার হাতিয়ারে পরিণত করতে ব্যস্ত, তখন ইবন খালদুন আমাদের শেখান, ইতিহাস কেবল বিজয়ীর গল্প নয়, বরং সমাজের মৌলিক কাঠামোর ভাষ্য। তাঁর রচিত আল-মুকাদ্দিমা পড়লে মনে হয়, তিনি যেন আমাদের একুশ শতকের সমস্যাগুলোর কথাই আগেভাগেই বলে গেছেন। বস্তুত, ইতিহাসের প্রথম সমাজবিজ্ঞানীকে বোঝা মানে, আজকের পৃথিবীর অন্ধকার গলিগুলোতে প্রবেশ করার মানে।
আজও কায়রোর রাজপথে, বাজারে, মসজিদের মিনারে, কিংবা তার অগণিত সরু গলিতে দাঁড়ালে ইবন খালদুনের বর্ণনাই প্রতিধ্বনিত হয়—এক শহর, যা সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখে, রাজনীতির খেলায় মাতাল হয়, এবং ইতিহাসের আবর্তে প্রতিনিয়ত নতুন রূপ ধারণ করে।
রবার্ট আরউইনের বইটি ইবন খালদুনকে তাঁর সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছে। এটি শুধু তাঁর জীবনী নয়, বরং তাঁর চিন্তা ও তার প্রভাবের এক গভীর বিশ্লেষণ।
ইবন খালদুন কি কেবল অতীতের ইতিহাস বিশ্লেষক, নাকি ভবিষ্যতের ইতিহাসেরও দার্শনিক? তাঁর আসাবিয়া তত্ত্ব কি আধুনিক রাষ্ট্র ও ক্ষমতার উত্থান-পতনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? এর উত্তর হয়তো সময়ই দেবে, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়—ইবন খালদুনের চিন্তাধারা আজও ইতিহাস ও রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
রবার্ট আরউইন: ইবন খালদুন, Tr. রবার্ট আরউইন
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২৪৩ পৃষ্ঠা, ফেব্রুয়ারি ২০১৮