ইসলামি সমাজতন্ত্র!!
ইসলামী সমাজতন্ত্রের ধারণাটি সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না সেটাই আলোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে।
বইচর্চা
রিটন খান
ইসলামী সমাজতন্ত্রের ধারণা বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে ইসলামের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কাঠামোকে একীভূত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সৈয়দ হোসেন আলআতাসের মতো চিন্তাবিদরা যুক্তি দেন যে ইসলাম সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সাম্যের পক্ষে, যা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সুসংগত। তবে, এক নাস্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মিল প্রকৃতপক্ষে এক স্ববিরোধী প্রচেষ্টা। সমাজতন্ত্র মূলত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে প্রতিষ্ঠিত, যা ধর্মীয় কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং কাঠামোগত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে, অন্যদিকে ইসলাম ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, ধর্মীয় আইন ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণকে সমর্থন করে। এই প্রবন্ধে ইসলামী সমাজতন্ত্রের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য পর্যালোচনা করা হয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে যে ইসলামের অর্থনৈতিক নীতি মূলত দাতব্য ভিত্তিক, যা সমাজতান্ত্রিক সম্পদ পুনর্বণ্টনের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি, ইসলামী শাসনব্যবস্থার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কীভাবে তা প্রকৃত অর্থে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে এবং কেবল একটি অভিজাত শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য বজায় রেখেছে। ইসলামী সমাজতন্ত্রের ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে একটি সাংস্কৃতিক আপসের প্রচেষ্টা, যা সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং একে একটি কার্যকর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
সৈয়দ হোসেন আলআতাস ইসলামের ‘ইসলামি সমাজতন্ত্র’ বইয়ের আলোকে মূল আলোচনাঃ
সৈয়দ হোসেন আলআতাস ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য নিয়ে এক সুদৃঢ় যুক্তি উপস্থাপন করেন, যেখানে তিনি ন্যায়বিচার, সাম্য এবং সহযোগিতার মতো অভিন্ন মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে সমাজতন্ত্রের কিছু শাখা যদিও নাস্তিকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তবু এই প্রবণতাকে ইসলামী সমাজতন্ত্রের মূল আদর্শকে ম্লান করে দেওয়া উচিত নয়, কেননা ইসলামী সমাজতন্ত্রের ভিত্তি রয়েছে ঈশ্বরবিশ্বাসের শক্ত ভিতের ওপর। আলআতাস দেখান যে ইসলামী সমাজতন্ত্র তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রাখে, যা আত্মিক বিশ্বাসকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সঙ্গে একত্রিত করে, যা নাস্তিক মার্কসবাদ থেকে স্বতন্ত্র। তিনি মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান যে, তারা যেন সমাজতন্ত্রকে শুধুমাত্র মার্কসবাদের একরৈখিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে, বরং ইসলামের ভেতরে বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক উপাদানগুলিকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করে।
এই অনুসন্ধান ইসলামী শিক্ষায় আর্থিক পুনর্বিতরণ ও সামাজিক কল্যাণের ঐতিহাসিক কাঠামোর গভীরে প্রবেশ করে। কুরআনে সম্পদ বিতরণের ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বিশেষত যাকাতের অনুশীলনের মাধ্যমে, তা ইসলামের অন্তর্নিহিত সমাজতান্ত্রিক প্রবণতাকে প্রকাশ করে। সম্পদের পবিত্রতা ও সামাজিক কল্যাণকে কেন্দ্র করে নবী মোহাম্মদ এবং খলিফা সৈয়দিনা আলীসহ অন্যান্য নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা ঐতিহাসিকভাবে এই আদর্শকে বাস্তবায়ন করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ ইসলামী শাসনব্যবস্থার সেই দিককে তুলে ধরে, যা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করতে সমাজতান্ত্রিক মূলনীতির প্রতিফলন ঘটায়। সমসাময়িক বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাগুলিও এই ঐতিহাসিক ভিত্তিকে কেন্দ্র করেই ইসলামের সমাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা প্রসারিত করছে।
আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে আবুল আ’লা মওদুদী এবং সাইয়েদ কুতুব বিশেষভাবে ন্যায়বিচার, সহযোগিতা এবং শোষণমূলক প্রথার উচ্ছেদের ধারণাগুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন, যা ইসলামের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোর সামঞ্জস্যকে আরও সুদৃঢ় করে। তারা সরকারকে সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, ন্যায়সঙ্গত বিতরণ এবং একচেটিয়া বাণিজ্য প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানান। তবে, ইসলামের সঙ্গে পাশ্চাত্য সমাজতন্ত্রকে একীভূত করার ক্ষেত্রে এক ধরনের টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়, কারণ পশ্চিমা ঐতিহাসিক বয়ানগুলো প্রধানত ইউরোপকেন্দ্রিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয় এবং অন্যান্য সভ্যতার অবদানকে খাটো করে দেখার প্রবণতা রাখে। মুসলিম সমাজগুলো তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে আধুনিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তবে তারা একই সঙ্গে ইসলামি মৌলিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছে।
আলআতাস পশ্চিমা সভ্যতার অবদানকে একটি পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়ন করেন, যেখানে তিনি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো ইতিবাচক অর্জনগুলোর ওপর গুরুত্ব দেন, তবে একই সঙ্গে ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী ধারণাগুলোর প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখেন। তিনি ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে যে প্রবণতা দেখা যায়—সম্পূর্ণরূপে পশ্চিমা সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করার—তার বিরোধিতা করেন এবং এর পরিবর্তে ইতিহাসের সেই মুহূর্তগুলিকে তুলে ধরেন, যখন ইসলামী সমাজ অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে উপকারী জ্ঞান গ্রহণ করে তা নিজেদের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে আত্মস্থ করেছে। আলআতাসের মতে, মুসলমানরা আধুনিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অনুরূপভাবে সমাজতন্ত্রের গঠনমূলক দিকগুলো গ্রহণ করতে পারে, তবে তা অবশ্যই ইসলামী নৈতিকতা ও আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। তিনি একটি উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে মত দেন, যেখানে বাইরের জ্ঞানকে তার প্রকৃত উপযোগিতা অনুযায়ী বিচার করা হবে, ক্ষতিকর উপাদান থেকে পৃথক করে কেবলমাত্র উপকারী অংশটুকু গ্রহণ করা হবে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোকে ইসলামী কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা এক জটিল চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয়। সমালোচকরা মনে করেন, ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তিশালী রাজনৈতিক দর্শনের অনুপস্থিতি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা। ফলে মুসলমানদের প্রায়শই পশ্চিমা অর্থনৈতিক মডেলগুলোকে নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে ইসলামের ভিত্তির ওপর দৃঢ়ভাবে নির্মিত একটি দার্শনিক কাঠামো ছাড়া এই সমাজগুলো প্রকৃত ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার অভাব অনুভব করতে পারে, যা ইসলামী সমাজতন্ত্রের অন্যতম মূল প্রতিশ্রুতি। এই অভাব কেবল সামাজিক অসাম্যকেই দীর্ঘস্থায়ী করবে না, বরং ইসলামী সমাজতন্ত্র যে গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভাবনা রাখে, তা গ্রহণের সুযোগও হাতছাড়া হবে।
ইসলাম ও সমাজতন্ত্র নিয়ে আলোচনার সঙ্গে প্রায়ই নেতৃত্বের ব্যর্থতার সমালোচনাও উঠে আসে, বিশেষত সেই দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থাগুলোর দিকে, যেগুলো বিকল্প মতাদর্শ, যেমন কমিউনিজমের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। আলআতাস ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলো বিশ্লেষণ করে দেখান, কীভাবে অযোগ্যতা ও দুর্নীতি ইসলামি সমাজব্যবস্থার ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং জনগণকে বিকল্প রাজনৈতিক দর্শনের দিকে আকৃষ্ট করেছে। এই সমালোচনা শুধু অতীতের পর্যালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং বর্তমান নেতৃত্বের দায়িত্ববোধ ও নৈতিক শুদ্ধতার দাবির সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি দেখান, ন্যায়বিচার ও সততার ওপর ভিত্তি করে গঠিত ইসলামী সমাজতন্ত্রের নীতি দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটগুলোর কার্যকর সমাধান দিতে সক্ষম। ইসলামী সমাজতন্ত্রের মূল দর্শন—ন্যায়, সুশাসন ও জনকল্যাণ—যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা কেবল আদর্শিক বিকল্প হিসেবে নয়, বরং বাস্তবসম্মত পরিবর্তনের ভিত্তি হিসেবেও কাজ করতে পারে।
আলআতাস সমাজতন্ত্র নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো ভাঙতে চান, বিশেষ করে বস্তুবাদী অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং সেসব দার্শনিক প্রবণতার মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে, যা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। তিনি যুক্তি দেন যে সমাজতন্ত্রের সমালোচনা প্রায়শই এই ভুল ধারণা থেকে আসে যে, এটি শুধুমাত্র ধর্মহীনতার দিকে নিয়ে যায়, যদিও প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্র মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধও সংরক্ষণ করতে পারে। এই বিভ্রান্তিগুলো দূর করে তিনি দেখাতে চান যে সমাজতন্ত্র নৈতিক আপেক্ষিকতার দিকে ঠেলে দেয় না; বরং কুরআনের সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শের সঙ্গে সুসংগত। সমাজে সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজতন্ত্রও অনেকাংশে সেই পথেই অগ্রসর হয়। ফলে আলআতাস মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন ইসলামী শিক্ষার আলোকে সমাজতন্ত্রের বাস্তব অবদানগুলিকে নতুন করে বিবেচনা করে এবং এর সম্ভাব্য ইতিবাচক দিকগুলো বিচার করে।
আলআতাস সমাজতন্ত্রের কার্যকারিতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন, বিশেষত এটি কীভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সহায়ক হতে পারে। সমান সম্পদ বণ্টন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের প্রতি সমাজতন্ত্র যে জোর দেয়, তা ইসলামের ন্যায়বিচার ও সাম্যের আদর্শের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সংগতিপূর্ণ। তিনি পাশ্চাত্য সমাজে সমাজতান্ত্রিক নীতির সাফল্য বিশ্লেষণ করেন—যেমন আয় বণ্টনের ভারসাম্য ও শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ—এবং দেখান, কীভাবে এগুলো ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু পুঁজিবাদের অবিচারগুলোর সমালোচনা করে না; বরং ইসলামী সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনাময় পরিবর্তনগুলোর দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতে অর্থনৈতিক নীতি ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের মধ্যে একটি সুষম সমন্বয়ের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়, যা ইসলামের সামাজিক ন্যায়বিচারের মূলনীতিকে আরও সুসংহত করতে পারে।
আলআতাস বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন যে ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখান যে, বিশ্বাস ও সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্বের জটিল সম্পর্ক অনুধাবন করতে হলে একটি সচেতন ও মুক্তচিন্তাশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। এর অর্থ হলো কেবল মতাদর্শগত পক্ষপাতদুষ্টতা পরিহার করা নয়, বরং উভয় ধারার গভীরে প্রবেশ করে তাদের মূল নীতিসমূহের সংযোগস্থল চিহ্নিত করা। আলআতাস মুসলমানদের আহ্বান জানান, তারা যেন সমাজতন্ত্রের ধারণাগুলোর সঙ্গে সমালোচনামূলকভাবে সংলাপে যুক্ত হয় এবং এমন একটি চিন্তাগত পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগুলোকে পুনর্গঠন করা সম্ভব। এই পদ্ধতি শুধু অগ্রগতির পথই উন্মুক্ত করবে না, বরং বিশ্বব্যাপী মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জের মুখেও ইসলামী নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিকে সংহত রাখবে।
আলআতাস ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও আধুনিক আলোচনার ক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। ন্যায়বিচার ও সাম্যের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চাওয়া মুসলিম সমাজের জন্য মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করা একান্ত জরুরি। আলআতাসের চিন্তাধারা ধর্ম ও অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে একটি সুষম সমন্বয়ের পক্ষে যুক্তি দেয়, যা দীর্ঘদিনের পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বিশ্বপরিসরে এই বিষয়ে গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানায়। তার লেখনীগুলোর মাধ্যমে তিনি দেখান, ইসলামের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক কাঠামো কীভাবে সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোর সঙ্গে সংহত হতে পারে, এবং আধুনিক মুসলিম সমাজের বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এটি একটি শক্তিশালী রূপরেখা প্রদান করতে পারে।
ইসলামি সমাজতন্ত্র: একটি স্ববিরোধী ধারণা
ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে আলআতাসের মতো চিন্তাবিদরা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করেছেন, যেখানে তারা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে ইসলামের সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোর মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে। তবে এই ধারণার মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা সহজ। সমাজতন্ত্র একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন, যার ভিত্তি সম্পদের ন্যায্য বণ্টন, শ্রমের মর্যাদা এবং শোষণের অবসানে নিহিত। অন্যদিকে, ইসলাম একটি ধর্মীয় ব্যবস্থা, যা সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বললেও, তা শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধীন থাকে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়। ফলে ইসলামি সমাজতন্ত্র মূলত একটি সাংস্কৃতিক আপসের প্রচেষ্টা, যা প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সমাজতন্ত্রের মূল ভিত্তি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, যা ধর্মকে সামাজিক শোষণের হাতিয়ার হিসেবে দেখে। ইসলামী চিন্তাবিদরা যদিও ইসলামের দাতব্য নীতিগুলোর সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন, বাস্তবে ইসলামের অর্থনৈতিক কাঠামো ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকৃতি দেয়, যা সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। উদাহরণস্বরূপ, যাকাত ইসলামে ধনীদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক দান, যা সম্পদের কিছু অংশ দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টনের একটি ব্যবস্থা। কিন্তু এটি মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল এবং কখনোই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত পুনর্বণ্টন ব্যবস্থার সমতুল্য হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামি অর্থনীতি দাতব্য ভিত্তিক, যেখানে ধনীদের ওপর নৈতিক দায়িত্ব চাপানো হয়, অথচ সমাজতন্ত্র কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য দূর করতে চায়।
অন্যদিকে, ইসলামী সমাজতন্ত্রের পরিধি সংকীর্ণ, কারণ এটি মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতরেই সম্পদ বণ্টনের কথা বলে। খাঁটি সমাজতন্ত্র ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কিন্তু ইসলামে অমুসলিমদের জন্য আলাদা শর্ত আরোপ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামী শাসনে অমুসলিমদের জন্য জিজিয়া কর আরোপ করা হতো, যা প্রকৃত সাম্যের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলামী রাষ্ট্রের ইতিহাস দেখলেও দেখা যায়, এই কাঠামো কখনোই সর্বজনীন সাম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি; বরং এর মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের একাধিপত্য স্পষ্টভাবে বিদ্যমান ছিল।
ইসলামি ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রথম যুগের খলিফারা শ্রমিক শ্রেণির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং উমাইয়া, আব্বাসীয় এবং উসমানীয় খিলাফতের মতো সাম্রাজ্যগুলোতে অভিজাত শাসকগোষ্ঠীর দাপট ছিল স্পষ্ট। এই শাসন কাঠামোতে প্রকৃত সামাজিক সাম্যের কোনো বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায় না। ইসলামিক শাসনব্যবস্থাগুলো প্রায়শই বংশানুক্রমিক বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছিল, যা সমাজতন্ত্রের নীতির পরিপন্থী। অতএব, ইসলামের ভেতর সমাজতন্ত্রের উপাদান খোঁজা হলে, তা সীমিত কিছু দাতব্য উদ্যোগ এবং আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
আরেকটি বড় দ্বন্দ্ব হল সমাজতন্ত্র ধর্মের অবসান চায়, অথচ ইসলাম রাষ্ট্রকে ধর্মীয় বিধান দ্বারা পরিচালিত করতে চায়। মার্কসবাদে ধর্মকে "জনগণের আফিম" বলা হয়েছে, কারণ এটি শোষণমূলক কাঠামো বজায় রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, কিন্তু ইসলামে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এবং উত্তরাধিকার আইন সুপ্রতিষ্ঠিত। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইসলামের রাজনৈতিক কাঠামো নিজেই এক অভিজাত শ্রেণির জন্ম দেয়—উলামা, খলিফা, আমির এবং ধর্মীয় নেতা—যারা জনগণের ওপর ক্ষমতা ধরে রাখে। প্রকৃত সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য শ্রেণিহীন সমাজ গঠন করা, যেখানে সম্পদ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে, অথচ ইসলামী রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে মেনে নেয় এবং বৈধতা দেয়।
এই বাস্তবতাগুলোর আলোকে ইসলামী সমাজতন্ত্রের ধারণাটি আসলে স্ববিরোধী। ইসলাম ও সমাজতন্ত্র একে অপরের সঙ্গে মেলানো কঠিন, কারণ ইসলাম মূলত একটি ধর্মীয় শাসন কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, যেখানে শাসনব্যবস্থা ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনৈতিক কাঠামোর কথা বলে। ইসলামী সমাজতন্ত্রের সমর্থকরা পশ্চিমা সমাজতন্ত্রের কিছু উপাদানকে ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করলেও, বাস্তবে সমাজতন্ত্র যদি কার্যকর হয়, তাহলে তার ভিত্তি থাকবে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ, ধর্মীয় বিশ্বাস নয়।
অবশেষে, যদি ইসলাম সত্যিই সমাজতান্ত্রিক হত, তাহলে ইতিহাসে ইসলামী সাম্রাজ্যগুলোতে এত বিশাল অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন দেখা গেছে? ইসলামী শাসকরা যদি প্রকৃত সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম করতেন, তাহলে সামন্ততান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ইসলামি সমাজগুলোতে এত বিস্তৃত হলো কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই ইসলামি সমাজতন্ত্রের মূল স্ববিরোধিতাকে উন্মোচন করে। বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামি সমাজতন্ত্র একটি সাংস্কৃতিক আপসের প্রচেষ্টা, যা সমাজতন্ত্রের প্রকৃত নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি এমন একটি কাঠামো যেখানে ইসলামের ধর্মীয় কর্তৃত্বকে বজায় রেখেই অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার একটি অলীক প্রচেষ্টা চালানো হয়, অথচ সত্যিকারের সমাজতন্ত্র ধর্মের বাইরে গিয়ে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গঠনের কথা বলে।