লেনিন: আগুনের খসড়া ও বিপ্লবের মুদ্রণযন্ত্র
আপনারা লেনিনের নাম শুনছেন, শুনে ভাবতেছেন এটা বুঝি পুরান কথা—পঁচা সোভিয়েত, সেন্ট পিটার্সবার্গের পোস্টার, ট্রেন থেকে নামছে লোকটা, মাথায় ক্যাপ, চোখে আগুন। না না ভাই, আসলে বিষয়টা এরকম নয়।
লেনিন নামটা আজকাল মুখে আনার আগে অনেকেই গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে নেন। কেউ বলেন, “ভাই, এখন তো পোস্টমডার্ন যুগ,” কেউ বলেন, “বেশি লেনিন পড়লে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষায় ফেল,” আর কেউ সরাসরি বলেন, “সোভিয়েত তো ফেইল করেছে, তাই না?” কিন্তু যাঁরা এভাবে বলেন, তাঁরা বোধহয় জানেন না, লেনিন কোনো জাতীয় পতাকা না, উনি একটা অদৃশ্য বুনন—যে কাঠামো দিয়ে আমরা রাষ্ট্র ভাবি, বিপ্লব চিন্তা করি, নেতৃত্বের স্বর কল্পনা করি।
আপনারা লেনিনের নাম শুনছেন, শুনে ভাবতেছেন এটা বুঝি পুরান কথা—পঁচা সোভিয়েত, সেন্ট পিটার্সবার্গের পোস্টার, ট্রেন থেকে নামছে লোকটা, মাথায় ক্যাপ, চোখে আগুন। না না ভাই, আসলে বিষয়টা এরকম নয়। লেনিন, সেই লোকটা, যাকে নিয়ে আমাদের দেশের ফেসবুক মার্কসবাদীরাও একটু আধটু গালিগালাজ করে ফ্যাশন বাঁচায়—সেই লেনিন এখনও আপনাদের রিকশার পেছনে বসে আছেন, কিছু বলছেন না, কিন্তু তাকিয়ে আছেন। তাঁর বিপ্লবী স্ট্র্যাটেজি মানে কাগজে-কলমে কিছু হাইব্রিড থিওরি না, ওটা ছিল একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক পারফরম্যান্স—বুলেটের ভেতরে লজিক, বক্তৃতার ভেতরে বারুদ।
লেনিন বুঝেছিলেন যে সমাজ বদলানোর জন্য আপনা-আপনি কিছু হয় না—ভ্যাংগার্ড পার্টি লাগে, নেতৃত্ব লাগে, আর সবচেয়ে জরুরি—একটা সাহসী মিথ্যার প্রয়োজন হয়। ঠিক সেইভাবে যেভাবে আমাদের জাতীয় কবি বা সাহিত্য একাডেমি মাঝে মাঝে ঘোষণা দেয় "নতুন প্রজন্ম জেগে উঠেছে!"—আসলে কেউ ওঠে নাই, সবাই ঘুমাচ্ছে, শুধু ক্যামেরা অন।
আর আজকের দিনে আপনি যদি দেখেন, ট্রান্স রাইটস আন্দোলন, ডেটা অধিকার আন্দোলন, এমনকি AI এর পুঁজিবাদী একচেটিয়া দখলের বিরুদ্ধে যারা কথা বলতেছে—তারা অজান্তেই, হাতের মুঠোতে এক টুকরো লেনিন চেপে ধরতেছে। না, তারা হয়তো বলছে না “proletariat,” তারা বলতেছে “community,” “infrastructure,” “disruption”—কিন্তু ওই শব্দগুলোর নিচে লেনিন দাঁড়ায়া থাকে, হাত পকেটে, আর বলেন, “সিস্টেমটা পাল্টাও আগে, না হলে চেঞ্জ হবে তোমার পোস্টার, তুমিই না।”
এই যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা, এই যে তত্ত্ব আর টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে সমাজের মুখ পাল্টানোর কৌশল—এইটাই লেনিনের চিরস্থায়ী উপস্থাপন। আর হ্যাঁ, আপনি যদি ভাবেন ওনার থিওরি এখন পুরাতন—তাহলে বলি, ভাই, লেনিনকে ছাড়াই আপনি এখনো সোশ্যাল মিডিয়া বামপন্থা করতে পারতেন না। উনি ট্রেন মিস করেন নাই, আপনিই প্ল্যাটফর্ম চিনতে ভুল করেছেন।
লেনিন সাহেব প্রযুক্তিকে দেখতেন ভয় না, সম্ভাবনার চোখে—যেমন বাঙালি প্রেমিক প্রেমিকার চোখে দেখে বাসার ভাড়া কমার সম্ভাবনা। উনি বলতেন, “টেলরিজম? ওহ, এই যে কাজ মাপার পদ্ধতি, এইটা আমাদেরও লাগবে। কিন্তু আমরা মানুষ মাপার জন্য না, শোষণ কমানোর জন্য মাপবো।” আজকাল আপনারা যেই অ্যালগরিদমে রিকমেন্ডেশন খাচ্ছেন, ওটা যদি মার্কিন পুঁজির গোলামে পরিণত হয়, তাহলে মনে রাখবেন, লেনিন এই আগুন ধরতে দেখে গিয়েছিলেন।
উনি বুঝেছিলেন—Efficiency যদি আসে, সেটা কি মানুষের পক্ষে, না মেশিনের পক্ষে? আর এই প্রশ্নটাই আজকের AI, অটোমেশন আর গার্মেন্টসের ছাঁটাইয়ের যুগে সবচেয়ে জরুরি। এখনকার বামপন্থী ভাইয়েরা যাদের চুল রঙ করা, গোঁফ পাতলা, আর স্লোগানে পিকাসো—তাঁরা ভুলে গেছেন লেনিন কিভাবে বলেছিলেন, “প্রযুক্তি মানেই পুঁজির রিমোট কন্ট্রোল নয়। সেটা হস্তগত করতে হবে, নইলে ফিডে আপনি থাকবেন না—থাকবে আপনার ডেটা।”
আর হায়েক? তিনি বলেছিলেন বাজার নাকি স্বয়ংক্রিয় জ্ঞানতন্ত্র। লেনিন বললেন, “তাই নাকি? তা হলে বাজারকে একবার রিলোড করি।” আপনি যদি ভাবেন যে বাজার সব জানে, তাহলে বাজারে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন—AI আপনার চাকরি খাইবে কিনা? বাজার চুপ করে থাকবে, কিন্তু ওর মালিকের মুখে হাসি ফুটবে।
লেনিন এইসব নিয়ে অজস্র পোস্ট দেয়নি, তিনি ফ্যাক্টরিতে গিয়ে বলেন—“এই মেশিনটা তুমি চালাবে না, তোমার মালিক চালাবে—তাই সিদ্ধান্তটাও তোমার নেওয়া লাগবে।” আজকে, আপনি যখন ট্যাক্সি অ্যাপে সাইন আপ করছেন, তখন আপনার শ্রমের মালিক কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে লেনিন আপনাকে ফলো করে ফিডে ঢুকে যাবেন।
লেনিন বলেছিলেন, “ইম্পেরিয়ালিজম মানে পুঁজিবাদের শেষ স্টেজ”—না ভাই, এটা কোনো রিকশার পেছনের লাইন না, এটা ছিল একধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ বিজ্ঞানের থিওরি। বুঝতেছেন না? আফ্রিকার দিকে তাকান। যেখানে সাদা বাবুরা কোকো খায়, আর কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকের হাত কেটে ফেলে যদি তারা মজুরি চায়। ওখানে লেনিনের থিওরি বইয়ের মধ্যে না, রক্তের মধ্যেই প্রিন্ট হয়ে গেছে।
ওয়াল্টার রডনি যখন লেখেন How Europe Underdeveloped Africa, তখন তিনি আসলে লিখছিলেন লেনিনের দ্বিতীয় খণ্ড, আফ্রিকান এডিশন। সামির আমিন এসে সেটা এক্সটেন্ডেড ভার্সনে নিয়ে গেলেন। তারা বললেন, “আরে ভাই, লুটপাটে শুধু ইংলিশ বুর্জোয়া না, ফরাসিরাও আছে। আর তারা শুধু মাটি না, মনও দখল করে।”
এবং নারী! উনি তো অদ্ভুত লোক, নারী মুক্তি বলতে শুধু লালগোলাপ দেওয়া না, উনি বললেন গর্ভপাত হবে রাষ্ট্রের অধীনে, মাতৃত্ব হবে পছন্দের ব্যাপার—not destiny. এখন যে reproductive rights নিয়ে আলোচনা হয়, সে তো উনারই ইনফ্রাস্ট্রাকচার। আপনি যদি আজকে দাড়িয়ে বলেন “My Body, My Choice”—লেনিন পেছনে হেঁসে বলে, “বডি তোমার ঠিক আছে, কিন্তু ক্লাস কোথায়?”
আরেকদিকে মায়াকভস্কি! বলতেছেন, “যে কবিতা বিপ্লবকে বোঝে না, তা দড়ির ফাঁসে ঝুলে থাক।” গ্রামসি বললেন, “সংস্কৃতি ছাড়া রাজনীতি হয় না।” আর লেনিন? উনি বললেন, “দুইটাই লাগবে।” মানে উনি চেয়েছিলেন এক সোভিয়েত যেখানে ট্র্যাক্টরের পাশে দাঁড়ায় কাব্যগ্রন্থ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েতরা হিটলারের মাথা কেটে দিলো, কিন্তু তাদের পোস্টারে লেনিনই ছিলেন। কারণ সে জানতো—যুদ্ধ জিততে হলে শুধু বুলেট না, বৈচিত্র্য লাগে, আর বুদ্ধির ধাক্কা লাগে। সেই বুদ্ধির নাম লেনিনিয় বাস্তবতা।
লেনিন বলেন, “শুধু রাষ্ট্র দখল করলেই চলবে না, মন দখল করো।” এই একটা লাইনেই উনি গিয়ে বসে পড়েন গ্রামসির কনট্রোল রুমে। কারণ উনি জানতেন, মেশিন-গান দিয়ে রাজা মারা যায়, কিন্তু রাজনীতি তখনই জমে, যখন রাস্তার লোক খেয়াল করে—এই রাস্তাটারও একটা মালিকানা আছে। এইটাকেই তিনি বলতেন ‘hegemony’।
মানে কী? মানে হচ্ছে চা দোকানের গল্প, গ্রামের গার্মেন্টস শ্রমিকের কান্না, ঢাকার ভার্সিটির ক্যান্টিনের তর্ক—সবকিছু যদি আপনি রাজনীতির আঙিনায় না আনতে পারেন, তাহলে বিপ্লব কেবল ফ্রেমে আটকানো এক ছবি। তাই তিনি বললেন, “ভ্যাংগার্ড পার্টি দরকার”—কারণ সবাই একসাথে ঘুম থেকে ওঠে না, কারও কেউ দরজায় ঠক ঠক করতে হয়।
লেনিন তখন বলেন, “কাজ চাই, মজুরি চাই—এই স্লোগান দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।” মানুষকে বুঝাতে হবে, ওরা শ্রমিক, এবং সেই পরিচয় দিয়ে তারা কেবল কাজ না, রাজনীতিও করতে পারে। অর্থাৎ, আপনার পার্টি যদি সকাল-বিকাল কমিউন কনফারেন্সে মিটিং করে, আর বাইরে কেউ জানে না সেটা কি, তাহলে বিপ্লব শেষমেশ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেই সীমাবদ্ধ থাকে।
আর উনার সবচেয়ে বড় কথা ছিল—“রাজনৈতিক প্রশ্ন আর সংগঠন প্রশ্ন আলাদা নয়।” এটা উনি সেই যুগে বলেছেন, যখন মানুষ ভাবতো ‘ডিসিপ্লিন’ মানে শাস্তি, আর ‘সংগঠন’ মানে রুটিন। কিন্তু লেনিন বললেন, “নেতা মানে শুধু বক্তা না, নেতা মানে রাস্তা বানানো কারিগর। যারা জানে কখন স্লোগান দিতে হয়, আর কখন চুপ থাকতে হয়।”
স্বৈরতন্ত্র? হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি। পুরান অভিযোগ, রংচটা ব্যানারে লেখা: “লেনিন মানে জবরদস্তি, গণতন্ত্রের কবর।” অথচ ভাই, আপনি কি ভাবছেন বিপ্লব মানে টেড-টক? লেনিন তো বলেছিলেন, “তত্ত্ব নিয়ে ছাতা বানিয়ে লাভ নেই, যখন বৃষ্টিটা বারুদের।” রাশিয়া ছিল তখন আগুনে পোড়া ফ্রিজ—আধা সামন্ত, আধা পুঁজিবাদ, আর একদম গোড়া থেকে ছেঁড়া।
এই জায়গায় মার্ক্সের জার্মান দর্শন আর হেগেলের ডায়ালেকটিক দিয়ে আপনি কিছু করতে পারবেন না। সুতরাং লেনিন করলেন—প্রয়োগ। পুঁজিবাদ যেখানে মাথা গুঁজে রেখেছে, সেখানে আপনি ডিসকাশন কমিটি বসিয়ে বিপ্লব করতে পারবেন না। তাই পার্টি হল কড়া সংগঠন, কড়া শৃঙ্খলা, আর কড়া চা। কেন্দ্রিকরণ না করে উপায় ছিল?
সমালোচকেরা বলেন—"এত কড়া কেন, ভাই?" লেনিন বলেন, “ভাইরে, রাশিয়াতে গণতন্ত্র মানে কখনও ছিল 'রোমান্টিক সংসদ', সেটা তো ইংল্যান্ডে হয়। এখানে যদি আপনি একটা কমরেডকে বলে দেন ‘স্বাধীনতা’, সে কালকে চলে যাবে রাজপথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিক্রি করতে।”
লেনিন বাস্তবতাকে ভালোবাসতেন। এবং তিনি জানতেন—যেখানে পুঁজিবাদ কাঁদতে জানে, সেখানে বিপ্লব হাসলে চলবে না। ওকে ধাক্কা দিতে হয়। তাই উনি ছিলেন ক্যাপশনবিহীন বাস্তবতা—যেখানে এক্সেল শিট নয়, লোহার মত সংগঠনের প্রয়োজন ছিল।
আর সেই জিনিসটাই আজকের দিনেও লাগে। আপনি যদি শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করেন, আপনি যদি দুনিয়ার অন্যান্য দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে ভাবেন, তাহলে মনে রাখবেন—লেনিনের কড়া কথাগুলো রাশিয়ার জন্য ছিল ঠিক, কিন্তু তার শিক্ষা এখনো গ্লোবাল পাঠ্যসূচিতে প্রাসঙ্গিক। কেবল, ওটা পড়তে হলে আপনার স্নায়ু চাই।
লেনিনকে নিয়ে আসল লড়াইটা শুরু হয় এখান থেকে—তিনি কি মার্ক্সের মতই শুধু ‘শ্রমিকের মুক্তি’ চাইতেন, নাকি একটু ‘চালাকি’ করতেন? অনেকে বলেন, উনি তো একটা রিফর্মিস্ট; মানে, সিস্টেমে থেকে সিস্টেম পাল্টাতে চেয়েছেন। আর লেনিন বললেন, “রিফর্ম? ভাই, আমি তো সিস্টেমেই আগুন দিছি!”
তিনি মার্ক্সের ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাজিকটা হাতিয়ার হিসেবে রাখলেন, কিন্তু বললেন, “এই ম্যাজিকের ওভারটাইম লাগবে, কারণ আমাদের সামনে বসে আছে পুরো একটা সাম্রাজ্য।” মার্ক্স বলেছিলেন, সমাজ বদলাবে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। আর লেনিন বললেন, “ভাই, উৎপাদন তো দখলে নেয়ার আগেই পুঁজিবাদ আমাদের মাথা নেয়।”
তাই উনি শুরু করলেন জিওপলিটিক্স নিয়ে কাজ। স্বাধীনতা মানে কেবল জাতীয় পতাকা না, বরং শ্রমিকের হাতে রাষ্ট্রের রিমোট। এবং এইখানেই তাঁর ব্যতিক্রম—যেখানে উনি ‘ফেডারেশন’ আর ‘সার্বভৌমত্ব’ নিয়ে এমন আলোচনা করেন, যেটা ইউরোপীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্কে আজও ঠিকমতো হজম হয় না।
আর আজকের দিনে এইসব চিন্তা ফিরছে—কেননা জলবায়ু সংকট, সীমান্ত রাজনীতি, আর প্রযুক্তির দানবগুলো আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, যে রাষ্ট্রের কাঠামো পাল্টানো ছাড়া মুক্তি নাই। সুতরাং, লেনিনের থিওরি ছিল ‘নতুন সমাজের অঙ্ক’—যেখানে প্রশ্ন থাকে, উত্তর তৈরি করতে হয়।
তিনি একটা ফর্মুলা দিয়ে গিয়েছিলেন না—তিনি একটা দর্শনীয় লাফ দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন আপনি সেটা ধরতে পারেন, নাকি পড়ে যান, সেটা আপনার হাতের জোর।
লেনিনের সবচেয়ে বড় অপরাধ কি ছিল জানেন? তিনি খুব বেশি নমনীয় ছিলেন। হ্যাঁ, আপনারা যাকে ‘ডগমা’ বলে বাঁচতে শিখেছেন, লেনিন তাকে রসুনবাটা করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ইউরোপীয় লাইব্রেরিতে। তাঁর কাছে বিপ্লব মানে ছিল না "তত্ত্ব, ছাপা, হেফাজত"—তাঁর কাছে বিপ্লব মানে ছিল “এখন, এখানে, কিভাবে?”
তিনি বলেছিলেন, “জাতীয়তাবাদ, যদি শ্রেণীসংগ্রামের অংশ হয়, তবে সেটা বিপদের নয়—বরং বিপ্লবের রশি।” এখন এই কথায় অনেক ‘বিশুদ্ধ’ মার্ক্সবাদী চুল ছিঁড়ে বলেন, “এই তো deviation!” লেনিন তখন বলেন, “ভাইরে, deviation না, রাশিয়া বাঁচানোর shortcut।”
উনি সবসময় প্রশ্ন করতেন—আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে প্রলেতারিয়তের স্বার্থ রক্ষা করবো? একবার না, বারবার নিজের অবস্থান বদলেছেন। কারণ তিনি জানতেন, পরিস্থিতি বদলালে বিপ্লবও নতুন জামা পরে।
লেনিন ছিলেন tactician—not just ideologue. তিনি বলেননি “এই পথেই যাব, যেভাবেই হোক।” বরং বলেন, “পথ যদি ভেঙে যায়, ব্রিজ বানাও। দরজা বন্ধ? জানালা ভেঙে ঢুকো।” অনেকেই একে authoritarian বলেছে—কিন্তু বাস্তবে, উনি ছিলেন historical necessity-র প্রকৌশলী।
আজকের দিনে এসে যদি আপনি এখনও ‘dogma’ ধরে বসে থাকেন, তাহলে আপনি কেবল ধর্মীয় নাস্তিক নন, আপনি রাজনৈতিক মূর্খ। লেনিনের মতো বিপ্লবী কখনোই বেদ-পুরাণে বিশ্বাস করেন না—তারা হাত রাখেন মাটিতে, শোনেন জনতার ধুকপুক, আর বলেন, “এই হার্টবিটটা ঠিক থাকলেই সমাজ বেঁচে যাবে।”
আপনারা যারা ভাবেন, বিপ্লব মানে পোস্টার, স্লোগান আর মিছিলে দৌড়—তাদের জন্য লেনিন একটা পুরনো যন্ত্র রেখে গেছেন: পত্রিকা। এখন বুঝতে হবে, ওটা ছিল না কোনো 'Daily Star' বা ‘Prothom Alo’। ওটা ছিল বিপ্লবের ব্রেইনস্টেমিং সেশনের ড্রাফট—যা ছাপা হতো কমরেডের ঘামে, আর পড়া হতো গোপনে, মোমবাতির আলোয়।
লেনিন বলতেন, "প্রেস মানে শুধু তথ্য না, প্রেস মানে সংগঠন।" তিনি চাইতেন এমন এক সংবাদমাধ্যম, যা হবে রাষ্ট্রবিরোধী না—রাষ্ট্র-পূর্ববর্তী। যেখানে প্রতিটি রিপোর্ট মানে ছিল বিপ্লবের rehearsal।
‘ইস্করা’ কাগজটা ছিল তাঁর শাস্ত্র। কিন্তু এটা কোন holy book না, এটা ছিল toolkit—যে toolkit ব্যবহার করে শ্রমিকরা শেখে কীভাবে হরতাল ডাকে, আর পুঁজিপতিরা শেখে কীভাবে ভয় পেতে হয়। আপনারা যারা ‘independent media’ নিয়ে গলা ফাটান, লেনিন তখন বলতেন, “স্বাধীনতা দরকার ঠিক আছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—স্বাধীনতা কার জন্য?”
প্রেসকে উনি বানিয়েছিলেন এক প্রকার রাজনৈতিক অস্ত্র। রিভলভার নয়, রিমার্ক। উনার প্রকাশনার কৌশল ছিল এমন, যেন প্রতিটি অনুচ্ছেদ পাঠকের ভেতরে এক নতুন রণক্ষেত্র খুলে দেয়। আজকের দিনেও যেসব মুভমেন্ট, ট্রান্স রাইটস হোক বা কৃষক আন্দোলন, নিজেদের মিডিয়া বানিয়ে কথা বলছে—তারা হয়ত জানে না, তারা সেই পুরোনো লেনিনীয় প্রেসের বংশধর।
লেনিন জানতেন, মিডিয়া হাইজ্যাক করলে রাষ্ট্রকে আর গুলি করতে হয় না। শুধু কাগজ ছাপা, আর জনগণের কল্পনাশক্তিতে আগুন ধরিয়ে দিলেই যথেষ্ট।
লেনিন সংসদে বিশ্বাস করতেন না, কারণ উনি জানতেন, বুর্জোয়া পার্লামেন্ট মানে মূলত এক ধরণের রাজকীয় নাট্যমঞ্চ—যেখানে বাস্তব পরিবর্তন হয় না, কেবল নাটক হয়। উনি বলেছিলেন, “নাটক যখন বাস্তবতাকে ঢেকে ফেলে, তখন মঞ্চটাই ভেঙে ফেলতে হয়।”
তাই উনি বানালেন সোভিয়েত—মানে, শ্রমিকদের প্রতিনিধি পরিষদ। এখানে কাউন্সিল ছিল, ক্যামেরা না। এই যে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ছায়া, উনি সেটা মাথা ঠান্ডা রেখে স্থাপন করলেন, এমনভাবে যেন রেশন কার্ড আর বিপ্লব একসাথে চলে।
লেনিন জানতেন—সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া অর্থনৈতিক পরিবর্তন একধরণের ফিটনেস ডায়েট—চোখে ভালো লাগে, পেট ভরে না। তাই উনি বললেন, “সংস্কৃতি দিয়ে মন গড়ো, অর্থনীতি দিয়ে পেট, আর সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র। তিনটাকেই একসাথে রোল করতে পারলে, তবেই বিপ্লব।”
তাঁর কৌশল ছিল—জাতীয় মুক্তি আর শ্রমিক মুক্তিকে এক থালায় পরিবেশন করা। এবং সেই থালার নাম ছিল প্রলেতারিয়ত রাষ্ট্র। আফ্রিকার উপনিবেশ বিরোধী নেতারা, মধ্যপ্রাচ্যের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, এমনকি আমাদের শহীদ মিনারের আশেপাশে বসে থাকা কমরেডেরাও উনার থিওরি হাতড়াতে গেছেন।
কিন্তু সমস্যা হলো—যখন লেনিন চলে গেলেন, আর জায়গায় লাল পতাকা থাকল, কিন্তু লাল হৃদয় হাওয়া হয়ে গেল। আজ যারা "মার্কস হ্যাজ লেফট দা বিল্ডিং" বলে বিদ্রূপ করে, তারা ভুলে যায়—লেনিন শুধু তত্ত্ব দিয়ে যাননি, তিনি একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করে গিয়েছিলেন।
এখন যদি আমরা আবার প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্র কল্পনা করতে চাই, তাহলে সেই কাঠামোটা নতুন করে বুঝতে হবে—এইবার হয়তো গুগল ড্রাইভে, কিন্তু গঠনশীলতা থাকবে লেনিনীয়।
লেনিন বলতেন, “সত্য? সত্য মানে মঞ্চে উঠে পড়া।” উনি বিশ্বাস করতেন না ধীরে ধীরে বদলানোয়—মানে ওই ক্লাসিক রিফর্মিস্ট স্লোগান, “আলোর মুখ আসবেই।” উনি বলতেন, “আলোর মুখ আসবে না, আলোর দরজা ভাঙতে হবে।” মার্ক্স যেটা দর্শনে রেখেছিলেন, লেনিন সেটা রাস্তায় নামিয়ে আনলেন। সেই রাস্তায় truth ছিল একটা jump—একটা লাফ, যেটা predict করা যায় না, কিন্তু পরে মনে হয় ছিল অনিবার্য।
আধুনিক চিন্তাবিদরা—জোডি ডিন, আলাঁ বাদিউ—তারা লেনিনকে পড়েন না শুধু ইতিহাস জানার জন্য। তারা পড়েন ভবিষ্যত তৈরি করার ছক হিসেবে। তারা দেখেন, কীভাবে এক লোক, যার হাতে রাষ্ট্র ছিল না, সেই লোক রাষ্ট্রের কাঠামো চিন্তা করে দিয়েছিল।
লেনিনের চিন্তাধারা যেন একটা টাইম-ট্র্যাভেলিং সফটওয়্যার—যেটা ১৯১৭ থেকে ২০২৪ এর আন্দোলনের ভিতর ঢুকে পড়ে। ট্রান্স রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট, ক্লাইমেট ক্যাম্পেইনার, শ্রমিক ইউনিয়নের নবীন কণ্ঠস্বর—এরা সবাই, অনিচ্ছায় হলেও, লেনিনিয় ভাষা ব্যবহার করে ফেলেন। শুধু শব্দটা বদলে গেছে, গন্ধটা রয়ে গেছে।
এই যে historical fidelity, এইটাই লেনিনের উত্তরাধিকার। কোনো জোশ নয়, কোনো গতানুগতিক পোস্টার নয়—লেনিন এমন এক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, যেটা আজও ডাকে: “তুমি কি প্রস্তুত এক লাফ দিতে, যা তোমার জীবন পাল্টাবে?” আপনি যদি বলেন না, ঠিক আছে। কিন্তু যদি বলেন হ্যাঁ—তাহলে ইতিহাস হঠাৎ নিজের পাতা ওল্টাবে।
লেনিন ছিলেন না অতীতের একজন, উনি ছিলেন এক ধরণের ক্রিয়া—যেটা তখনও কাজ করে, যখন আপনি সত্য বলতে চান, কিন্তু ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। সেই সময়, লেনিন আসে। আসলে উনি আসেন না—উনি ছিলেনই।
শুধু একটা কথা মনে রাখবেন:
লেনিনকে বুঝতে হলে পার্টি অফিসে নয়, যেতে হবে চায়ের দোকানে। কারণ বিপ্লব শুরু হয় রাজনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে, কিন্তু দাঁড়ায় আড্ডার টেবিলে।
Lenin: The Heritage We (Don’t) Renounce Paperback – January 13, 2024 by Johann Salazar (Cover Design), Hjalmar Jorge Joffre-Eichhorn (Contributor), Patrick Anderson (Contributor)
সমাজ বলে—“বাচ্চা দাও, গল্প নয়।”
এই লেখাটি উৎসর্গ আমার সেইসব বন্ধুর উদ্দেশে—যাঁরা সমাজের প্রতিটি নিয়ম, প্রতিটি কণ্ঠরোধ, প্রতিটি কণিকাগত বঞ্চনা পেরিয়ে উঠে এসেছেন, এবং নিজের কণ্ঠকে কেবল নারী পরিচয়ে বাঁধেননি। তাঁরা লেখক হয়েছেন—লিঙ্গের সীমা ছাড়িয়ে, সামাজিক স্বীকৃতির কাঠামো ভেঙে, নিজের ভাবনার গভীরতা থেকে। তাঁদের কলমে আমি দেখেছি কেমন করে সাহস শব্দ হয়ে ওঠে, যন্ত্রণাও হয়ে ওঠে শিল্প। তা…