সমাজ বলে—“বাচ্চা দাও, গল্প নয়।”
একজন লেখক-নারী—সে যেন বাঁশবনের ভিতর এক বিদ্যুৎরেখা, চুপ করে বসে থাকা আগুন। তার চোখ কিছুই ছাড়ে না, তার কলম ক্ষমা চায় না।
এই লেখাটি উৎসর্গ আমার সেইসব বন্ধুর উদ্দেশে—যাঁরা সমাজের প্রতিটি নিয়ম, প্রতিটি কণ্ঠরোধ, প্রতিটি কণিকাগত বঞ্চনা পেরিয়ে উঠে এসেছেন, এবং নিজের কণ্ঠকে কেবল নারী পরিচয়ে বাঁধেননি। তাঁরা লেখক হয়েছেন—লিঙ্গের সীমা ছাড়িয়ে, সামাজিক স্বীকৃতির কাঠামো ভেঙে, নিজের ভাবনার গভীরতা থেকে। তাঁদের কলমে আমি দেখেছি কেমন করে সাহস শব্দ হয়ে ওঠে, যন্ত্রণাও হয়ে ওঠে শিল্প। তাঁদের লেখা আমাকে শিখিয়েছে—নারী-হওয়া কখনো বাধা নয়, বরং এক আলাদা দৃষ্টির সমুদ্র, যেখানে ভাষা নতুন ঢেউ তোলে। এই লেখা সেইসব নারীদের জন্য, যারা লেখেন—এই সমাজের চোখের দিকে তাকিয়ে, এবং কখনো কখনো চোখ বুজেও, শুধু নিজের ভিতরের আলো দেখে।
দূরের গণ্ডগ্রামের বউরা যেমন ‘পেত্নী’ দেখলেই মাথায় পাট খোঁচা মারে আর নাম করতে গিয়ে বলে—‘সে না কে যেন’, শহরের ড্রয়িংরুমে লেখক ঢুকলেই যেন গলায় আটকে যায় গ্লাসের চুমুক, থেমে যায় নিছক গসিপের গতি। গায়কেরা এলে পার্টির ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে কীর্তন—দরকারে হাততালি পড়ে, কেউ কেউ ভিডিও তোলে। কিন্তু লেখক এলেই চারপাশটা কেমন থমথমে হয়ে যায়। এই তো সে লোক যে শুনছিল, চুপচাপ, গলির শেষে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে—তোমার স্বামীর লেট-নাইট ডেটের গল্প, কিংবা মদ্যপ এক বন্ধুর পার্টি-ভাঙানো অস্বস্তিকর সত্যি।
লেখক মানে পাগল নয়, সে এক হুঁশিয়ার প্রেত, যে তোমার ফিসফাস থেকে টেনে আনবে কোনো চরিত্র, কোনো উল্টো-আয়নায় ভরা জগত, আর একদিন তুমি বইয়ের পাতা খুলে বুঝবে—এই তো আমি, ওই ন্যাক্কারজনক ভুলটাই তো করেছিলাম, এই কুৎসিত ভাবে, এমনই করুণ মোচড়ে, যা এখন একজন কল্পনার নায়কের পাপ। নাম নেই, ঠিকানা নেই, তবু পড়ে মনে হবে: ‘ধুর! এ তো ঠিক আমারই কথা!’
তখন আর কিছু করার থাকে না, শুধু বুকের মধ্যে হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগে—নিজের দোষ দেখে ফেলেছে কেউ, আর সেটা তুলে দিয়েছে বাক্যের ঘাড়ে। যেন কথারা হয়ে উঠেছে কাঁটা, কাঁটার মাথায় ঝুলছে পরিচয়হীন লজ্জা।
এইবার এসে পড়ে আসল ভূমিকম্প—লেখক যদি পুরুষ না হয়ে নারী হন, তাহলে তার প্রবেশ শুধু নিস্তব্ধতা আনে না, আনে শঙ্কা, আতঙ্ক, আর এক অদ্ভুত রকমের লজ্জা। পার্টির নিখুঁতভাবে সাজানো মুখোশে, যেন কেউ কাঁচি চালিয়ে দেয়। মেয়েটি—লেখক মেয়ে—পা বাড়িয়েছে, অথচ সেখানে তার স্থান হবার কথা ছিল না। এবং তার কলম যে কেবল গসিপ লেখে না, সে তো টুকে রাখতে জানে—বুক চিরে বের করা সত্য।
আর তখন, আতঙ্ক বাড়ে দ্বিগুণ। কারণ কে টুকে রাখছে? এক অবিনীত লিঙ্গ, এক অযোগ্য শ্রেণি, যাদের যুগের পর যুগ ধরে শেখানো হয়েছে মাথা নিচু করে থাকতে, প্রশ্ন না করতে, কেবল ক্ষমা করতে। যাদের পাঠ ছিল—নীরব থাকো, সহ্য করো, চুপচাপ ভালো থেকো। আর সেই চুপচাপ ভালো থাকার ছায়া যদি একদিন বেছে নেয় লেখার ভাষা? যদি সে রক্তমাখা ঠোঁটে বলে ফেলে: ‘এই আমি, আর এই তুমি, আর এই ছিল সত্য’?
তখন ভয় বেড়ে যায় দশ গুণ। কারণ একজন নারী-লেখক যা করে, তা নিছক সাহিত্য নয়—তা তো এক অভিযুক্ত সমাজের চালচিত্র আঁকা, আর সবচেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে, তা তো বিচার—নারীর দৃষ্টিতে।
এই সমাজ তো বরাবরই ধরেছে, বুদ্ধিতে সবচেয়ে সাধারণ পুরুষটিও একজন নারী থেকে শ্রেষ্ঠ। কারণ নারী তো বই পড়ে না, নারী লেখে না, নারী তো শুধু অনুভব করে—তাও যদি পুরুষের ছকে চলে। তাই যখন নারী লেখে, সে এই গোটা যুক্তিগ্রন্থিকে উল্টে দেয়।
একজন লেখক-নারী—সে যেন বাঁশবনের ভিতর এক বিদ্যুৎরেখা, চুপ করে বসে থাকা আগুন। তার চোখ কিছুই ছাড়ে না, তার কলম ক্ষমা চায় না।
এই যে নারী-লেখার ভেতরে আছে এক অবিচ্ছেদ্য বিপ্লবী তন্তু—নিঃশব্দ, কিন্তু ধ্বংসাত্মক, এই কারণেই বোধহয় ইতিহাস জুড়ে অসংখ্য নারীর সাহিত্যকর্ম চুপিসারে খাটো করে দেখা হয়েছে, ভ্রু কুঁচকে পাশ কাটানো হয়েছে, আবার কখনো একেবারে অগ্রাহ্যই করে দেওয়া হয়েছে।
যে-কোনো প্রতিপক্ষকে নিষ্ক্রিয় করার শ্রেষ্ঠ উপায় কী? তাকে হাস্যকর করে তোলা। তার গুরুত্বকে ছোট করে, তার বিষয়কে 'গৃহস্থালী', তার ভাষাকে 'অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ', তার মননের গভীরতাকে 'অহেতুক কল্পনা' বলে দাগিয়ে দেওয়া। যেন বলে ফেলা যায়—এই জিনিসগুলো তো মেয়েরা লেখে, অত সিরিয়াস হবার কিছু নেই।
এইভাবেই Uncle Tom’s Cabin হয়ে ওঠে শুধু ‘সেন্টিমেন্টাল’, কেউ আর মনে রাখে না যে এই উপন্যাস আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরুর অন্যতম অনুঘটক ছিল। কল্পনার মাটি থেকে রাজনীতি জন্ম নিয়েছিল, এক নারী-লেখকের কলমে।
আর Pippi Longstocking? ছোটবেলায় ছেলেদের শেখানো হয়, এইসব বই—যেখানে এক মেয়ে কর্তৃত্ব, গাম্ভীর্য, আর নারীদের জন্য তৈরি করা সব ‘ভদ্রতা’র কাঠামোকে পা দিয়ে ধাক্কা মারে—এসব ওদের পড়ার জন্য নয়। ওটা তাদের বোনদের জন্য, তাদের বোনতিদের জন্য। যেন আনন্দ, বিদ্রোহ, আর উচ্ছ্বাস কেবলমাত্র একটি লিঙ্গের জন্য বরাদ্দ।
এইভাবে সাহিত্যেও তৈরি হয় এক অন্তঃসারশূন্য জাতপাত। মেয়েদের লেখা হল তুলতুলে, ঘরোয়া, হালকা, পিঙ্ক কাভারে বাঁধা; আর পুরুষের লেখা? সিরিয়াস, ভারী, পৃথিবী-পরিবর্তনকারী।
অথচ ভুলে যাই—নারীদের লেখাগুলো আসলে ভেতর থেকে বদলায়। তারা বিপ্লবের ডাক দেয়, কিন্তু চিৎকার করে নয়—চুপ করে, হাসতে হাসতে, কিংবা গল্প বলতে বলতে। এটাই তাদের বিপজ্জনক করে তোলে।
শার্লট ব্রন্টির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে রেবেকা ওয়েস্ট যে নিবন্ধটি লিখেছিলেন—সে যেন এক নারী আরেক নারীর দিকে চেয়ে অন্তর দিয়ে মাথা নোয়ানোর নাম। অথবা, আরও গভীরভাবে বললে, এক লেখক আরেক লেখকের প্রতি শ্রদ্ধার নিঃশব্দ স্তব। কিংবা এক মানবী, আরেক মানবীর যন্ত্রণাকে বোঝার কুশলী, করুণ, ও তীক্ষ্ণ প্রচেষ্টা। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন সহানুভূতিশীল পাঠ খুব বেশি নেই।
এই নিবন্ধে রেবেকা ওয়েস্ট সেই দিকেই দৃষ্টি ফেরান—যেখানে শার্লট ব্রন্টি বারবার এমন এক দুনিয়াকে দেখিয়েছেন যা পড়তে গিয়ে পাঠকের চোখে বেখাপ্পা লাগে, অথচ ঠিক সেই বেখাপ্পাতেই লুকিয়ে আছে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব।
দেখো, কী বলেন রেবেকা:
“সে বারবার লিখেছে কীভাবে টাকাওয়ালারা টাকা-না-থাকাদের উপর জুলুম করে, কীভাবে বড়রা শিশুদের উপর শাসনের নামে নির্মমতা চালায়, আর অনেক পাঠকের তা অসহ্য লাগে—তাদের কাছে এগুলো 'অসুন্দর', 'অমার্জিত'; কিন্তু তা এই কারণে নয় যে, এই ঘটনাগুলো ঘটে না, বরং এই কারণে যে, আমরা এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করতে রাজি নই।”
এখানেই সাহিত্য আর জীবনের মাঝখানের সেই অদ্ভুত ফাঁকটা ফুটে ওঠে। আর রেবেকা ওয়েস্ট সেই সাহসেরই স্বীকৃতি দিয়েছেন। লিখে গেছেন, কীভাবে নারী-লেখকের লেখার মূল শক্তি তার নীরব অস্বস্তিতে—not in what she hides, but in what she dares to show.
এই পাঠের শেষে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে হয়, হ্যাঁ—আমরা বুঝি, কেন শার্লট ব্রন্টি এবং তাঁর বোনেরা পুরুষ নাম গ্রহণ করেছিলেন। শুধু যে ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ড ছিল ‘পুরুষের দেশ’, যেখানে সাহিত্যে নারীর প্রবেশ যেন ছিল অপবিত্রতা, তাই নয়—তার বাইরেও ছিল এক ভয়, এক দমবন্ধ করা সামাজিক বাস্তবতা, যেখানে নারীর কণ্ঠস্বরকে শুরুতেই বলে দেওয়া হতো: তুমি গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নও।
আর তাই, তারা সেই প্রথম শব্দটি যখন কাগজে লিখলেন, তখন তা শুধু সাহিত্য রচনা নয়, ছিল এক অস্তিত্বঘোষণা। আমি আছি। আমি দেখছি। আমি লিখব।
নারী-লেখকের মধ্যে বৈচিত্র্য বিস্তর—বয়সে, কণ্ঠে, ভূগোলে, ভাষায়। কিন্তু একটি জিনিস তাদের মধ্যে অভিন্ন—তা হলো এক অবদমন-অতল থেকে উঠে আসা সাহস। অথবা একরকম নিবারণ-না-করা তাগিদ। অথবা সেই নিরুত্তাপ কিন্তু অচঞ্চল স্পর্ধা—যা প্রথম শব্দটিকে কাগজে নামায়, তার পর দ্বিতীয়টিকে, তার পর তৃতীয়।
যদি কোনো লেখাকে ‘সাহস’ বলা যায়, তবে এদের লেখাই সেই সাহসের প্রতীক। কারণ সমাজ যেখানে নারীকে চায় নিশ্চুপ, সেখানে শব্দ হয়ে ওঠে নারীর প্রতিবাদ—একটি ‘আমি’ যা মুছে ফেলা যায় না।
এই নারীরা নাম ঢেকে লিখেছেন, পরিচয় মুছে ফেলেছেন, তবু তাদের লেখা মুছে যায়নি। কারণ তারা যা লিখেছেন, তা কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, তা এক সামাজিক সত্য—যে সত্যকে অস্বীকার করতে চায় পিতৃতন্ত্র, কিন্তু যার সামনে শেষ পর্যন্ত মাথা নিচু করতে বাধ্য হয় পাঠক।
লেখা কখনোই সহজ নয়। কিন্তু তাদের জন্য—এমিলি, অ্যান, শার্লটদের জন্য—তা ছিল আরও কঠিন, আরও চেপে ধরা, যেন হাওয়ার বিপরীতে হাঁটা। কারণ, সত্যি করে বলো তো, ক’জন মেয়ে এমন পরিবারে জন্মায়, যেখানে বাবা-মা গর্বের সাথে বলেন—"এই মেয়েটা একদিন লেখক হবে!"?
ক’জন পায় সেই নির্ভার উৎসাহ, যেটা ছেলেরা পায়—যেখানে বন্ধু, গুরু, সমাজ সবাই বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, লেখো, লিখতেই হবে, তুমিই পারবে!”? মেয়েরা সে জায়গা পায় না। তাদের সাহিত্যকর্মকে এখনো হাইনরিশ হাইনের মতো কবিরা ব্যঙ্গ করে বলেন, “নারীদের লেখা তো কুৎসার গন্ধে ভরা, এক ধরনের গসিপ-মার্কা সাহিত্য।” এই বাক্য শুধু হাইনের নয়, এটা এক গহীন সামাজিক মনোভাব, যা নারী-লেখকদের ঘিরে তৈরি হয়েছে—জেনেশুনেই।
একজন নারী যখন লিখতে বসেন, তখন প্রথম শব্দটি রাখার আগে তাঁকে কাটিয়ে উঠতে হয় এক জঙ্গল—সে জঙ্গল তার নিজের নয়, বরং সমাজের তৈরি: কী হওয়া উচিত ছিল তার, কী করতে পারতো না সে, কেন লেখার চেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়া অধিকতর ‘প্রকৃতিপ্রদত্ত’ আর উপযুক্ত।
একটি বই লেখার চিন্তা? সমাজ বলে—“বাচ্চা দাও, গল্প নয়।” যেন মাতৃত্বই নারীর একমাত্র ধর্ম, বাকিরা কেবল বিপথগামী ব্যতিক্রম।
এমন এক বাস্তবতায় জন্ম নেওয়া মেয়েরা যখন লেখেন, তখন তাদের সাহস শুধু লেখার জন্য নয়, নিজেকে ‘অন্য কিছু’ ভাবার জন্যও। সেই সাহসে লেগে থাকে আত্মপরিচয়ের দাবি—আমি শুধু মা নই, শুধু মেয়ে নই, আমি এক ভাবনার মানুষ, আমি লিখি, কারণ আমি দেখি।
যেকোনো লেখকের পথেই থাকে বিপত্তি। কিন্তু নারী-লেখকের ক্ষেত্রে সেই প্রতিটি বাক্য লেখার আগে থাকে এক যুদ্ধক্ষেত্র পেরোনো। একটি মাত্র পূর্ণাঙ্গ বাক্য লিখতে পারাও যেন এক বিপ্লব—কীভাবে সে যুদ্ধ করে, কীভাবে আত্মাকে টিকিয়ে রেখে শব্দ সাজায়, সেই কাহিনিই এই বইয়ের প্রতিটি লেখিকার যাত্রাপথে অনুরণিত।
তুমি ভাবো তো, কতটা সাহস, কল্পনা আর দুঃসাহস চাই যে মেরি উলস্টোনক্র্যাফ্ট হওয়া যায়! এমন এক শৈশব থেকে উঠে আসা—যেটাকে এখন আমরা বলি 'নিম্নগামী সামাজিক স্রোতে' দুঃসহ ভাসমানতা, যেখানে নিজের মা ও ভাইবোনদের দেখাশোনা করতে গিয়ে নিজেকে ভুলে যেতে হয়, আর সেই জীবন থেকে নিজেকে দাঁড় করাতে হয় একজন autodidact হিসেবে—নিজে নিজেই শেখা, গঠিত হওয়া।
তিনি ছিলেন গৃহশিক্ষিকা, এক পুরুষ-শাসিত সমাজে। তারপর একজন মেন্টর খুঁজে পেলেন, নিজের আদর্শ নির্মাণ করলেন, বা হয়তো যোগ দিলেন এক নতুন জীবনের স্বপ্নে—যে জীবন ছিল স্বাধীন নারী হওয়ার, একজন ‘নারী-চিন্তাবিদ’ হয়ে ওঠার। কী বিপ্লবী এক ধারণা! একলা নারী, চিন্তা করে, লিখে, উচ্চারণ করে নিজের দাবি।
এত কিছুর মাঝখানেও মেরি উলস্টোনক্র্যাফ্ট শুধু বেঁচে ছিলেন না, তিনি লিখেছিলেন। গল্প, প্রবন্ধ, তর্ক-বিতর্কে ভরা রাজনীতি—সব মিলিয়ে একটি দুনিয়া। লিখেছিলেন Thoughts on the Education of Daughters, আর সেই যুগান্তকারী গ্রন্থ A Vindication of the Rights of Woman, যা শুধু নারীবাদের ভিত্তি নয়, এক নতুন ভাবনার জন্মও দিয়েছে।
এই লেখাগুলো কেবল বই নয়, এগুলো হলো অস্তিত্বের জবানবন্দি—একটি বাক্য লেখার মাঝেও ছিল অজস্র প্রতিরোধ ভাঙার স্মৃতি।
ভাবো একবার, কেমন এক নিঃশব্দ সাহস লাগত রোকেয়া হওয়ার জন্য—যেখানে তোমার চোখ যেন একটু বেশি দেখে, সমাজ যা দেখতে দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি। সেই চোখে দয়া আছে, সহানুভূতিও আছে, কিন্তু ‘নারীত্ব’ নামক নরম, কোমল, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ দৃষ্টির ছায়া নেই। রোকেয়ার দৃষ্টি ছিল স্পষ্ট, সংযত, প্রায় বৈরাগ্যময়—সে চোখে প্রতিবেশীর হৃদয় যেমন ধরা পড়ে, তেমনি তাদের হতাশা, চালচলন, ব্যর্থ স্বপ্ন, অতিসাধারণ জীবনের অমোচনীয় সত্যও।
আবার, ধরো অ্যান ফ্রাঙ্ক—এক কিশোরী, অন্ধকারে বন্দী, নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত, নিজের ঘরের মধ্যেও নেই একটুও স্বাধীনতা। কোনো গোপনীয়তা নেই, কোনো খোলা জানালা নেই—তবু, সেই অবিশ্বাস্য অস্বস্তি আর আতঙ্কের মধ্যে থেকেও সে লেখে। জীবনের সবচেয়ে অনুপযুক্ত মুহূর্তে একজন লেখক হয়ে ওঠে। আর শুধু লেখক নয়, লেখে এক অমূল্য গ্রন্থ—যা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিস্ময়।
অথবা ধরো আজকের যুগে দাঁড়িয়ে অরুন্ধতী রায়কে। সে লেখে—কিন্তু কেবল সাহিত্য নয়, সে কথা বলে, উচ্চারণ করে, প্রতিরোধ করে। সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, কর্পোরেট মিত্রদের বিরুদ্ধে, ধ্বংসের পথে ধাবিত মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলে ফেলে এমন সব সত্য—যা বলা মানেই শত্রু তৈরি, মামলা জোটানো, কিংবা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া।
এই নারীরা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নারীর জীবনে কতবার ‘প্রয়োজনে’ আর ‘অন্তরের তাড়নায়’ জন্ম নিয়েছে শিল্প। শিল্পী-সত্তার মিউজরা শুধু ভালোবাসা বা সৌন্দর্য নয়—অনেক সময় অভাব, অবদমন, আর অপরিহার্য নৈতিক দায়বদ্ধতাও।
১৯৩৯ সালের সেই শীতল, স্তব্ধ লেনিনগ্রাদ শহর—সেন্ট্রাল কারাগারের বাইরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন অজস্র নারী, হাতে খাবারের পুঁটুলি, মুখে অস্থিরতা। তাঁরা এসেছেন বন্দি প্রিয়জনদের জন্য কিছু খাবার বা খবর পৌঁছে দিতে। সবার ভেতরে এক অভিন্ন বিষণ্নতা—কেউ মা, কেউ স্ত্রী, কেউ বোন। আর সেই সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন আন্না আখমাতোভাও—রাশিয়ার এক কিংবদন্তি কবি, যার ছেলে লেভ গুমিলইকে তখন পাঠানো হয়েছে শ্রমশিবিরে।
একজন নারী তাঁকে চিনে ফেলে। এগিয়ে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,"আপনি কি পারেন, এই ঘটনাটা লিখে যেতে?"আর আখমাতোভার উত্তর—"হ্যাঁ, পারি।"
এই সংক্ষিপ্ত সংলাপেই ফুটে ওঠে কবিতার প্রকৃত কাজ—যেখানে ইতিহাসের মুখ চেপে ধরা হলে, কবির কলম তাকে উচ্চারণ করে।
এই ছোট্ট কথোপকথনের ফল হল Requiem—একটি এমন কবিতা, যা রাজনৈতিক শ্লোগান নয়, তবু একনায়কতন্ত্রের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি রাখে। কারণ এখানে আখমাতোভা লিখেছেন সেই সব নারীর হয়ে, যাদের কণ্ঠ চেপে ধরা হয়েছে, যাদের কান্না নিষিদ্ধ, যাদের মাতৃত্বকেও রাষ্ট্র শত্রুতে পরিণত করেছে।
Requiem যেন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো ঘোষণাপত্র নয়, বরং এক স্তব—মাতৃত্বের, যন্ত্রণার, মূক বেদনার। আর ঠিক এই কারণেই তা আরও বেশি বিপজ্জনক। কারণ এই কবিতা শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না স্লোগানের মাধ্যমে, বরং দাঁড়ায় ইতিহাসের বিবর্ণ মুখোমুখি।
আখমাতোভার এই ‘হ্যাঁ, পারি’—এটি শুধু সাহিত্যের ভাষা নয়, এটি এক নারীর পক্ষ থেকে বলা এক জাতীয় প্রতিজ্ঞা: “তোমরা চুপ করলেও, আমি বলব।”
সিলভিয়া প্লাথের জীবন একযোগে সতর্কবার্তা এবং আলো জ্বালানো একটি মোমবাতি। যেন কোনো পুরাকথার গল্প, যেখানে সৌন্দর্য সৃষ্টি করার জন্য একজন নারী নিজের ভেতরের অশান্ত আত্মার সাথে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যায়। তার কবিতা ছিল বেদনার প্রতিচ্ছবি, আবার সেই বেদনা থেকেই যেন উঠে আসত অদ্ভুত এক দীপ্তি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভেতরের দানবগুলিই জয়ী হয়েছিল। তবু এই আত্মঘাতী পরিণতির মাঝেও প্লাথ আমাদের রেখে গেছেন এক অক্লান্ত প্রত্যয়ের নিদর্শন—লিখতে হবে, যদিও যন্ত্রণায় দগ্ধ হও, কিংবা ঠিক সেই যন্ত্রণাই হোক তোমার ভাষার উৎস।
নারীদের লেখা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি যুগে—নিঃসন্দেহে, প্রতিটি যুগেই—অগণন নারী সমস্ত বাধা অতিক্রম করে লিখেছেন। কখনো সেই বাধাকে অগ্রাহ্য করে, কখনো তার ভেতর দিয়েই ফুঁড়ে এসেছেন। তাঁরা লিখেছেন, প্রকাশ করেছেন, এবং পড়ে গেছেন—অথচ সমাজ বারবার তাঁদের বলেছে, “এই কাজটি তোমার জন্য নয়।”—সত্য বলার সাহস, অথবা আরও উচ্চতর কোনো সত্য কল্পনা করার সাধনা—এসবের সাথে সম্পর্ক শুধুই প্রতিভা, বুদ্ধি, আত্মা আর অন্তরের। এর কোনো সংযোগ নেই শরীরের প্রজনন অঙ্গের সঙ্গে। লেখার ক্ষমতা নারীর জরায়ুতে নয়, তার চেতনায়।
নারীদের—এগুলো কেবল সাহিত্যিক কৃতির তালিকা নয়, এরা হলো একেকটি টিকিয়ে থাকার দলিল, একেকটি দ্রোহের গোপন পাণ্ডুলিপি। তারা জানান দেয়, সাহিত্যের ক্ষমতা কেবল কল্পনার নয়—এটি স্মৃতি, বাস্তব, আর ন্যায়বোধেরও আধার। যেকোনো ঘরে লেখক ঢুকলে ঘরের বাতাস বদলায়। কিন্তু লেখক যদি নারী হন, তখন বদলে যায় দেয়ালগুলোও। কারণ তার শব্দ শুধু উচ্চারণ নয়, এক প্রাচীন নীরবতার ভেতরে ফাটল ধরানোও।
এবং একবার ফাটল ধরলে, আলো ঢুকবেই।
আটলান্টা
২২শে মার্চ ২০২৫
তুমি কেবল গল্প পড়ছো না, তুমি একটা পক্ষও নিচ্ছো
এমনটা কি সত্যিই সম্ভব? এমন এক নির্দোষ বই পড়া, যা রাজনীতির ধারেকাছেও যাবে না? যেখানে যুদ্ধ, অনাহার, রোগব্যাধি, দুর্নীতি, শ্রেণিবিভেদ, জাতিবিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম্য—কোনো কিছুই ঢুকতে পারবে না? লিখলে কারও না কারও অপছন্দ হবেই। এটাই লেখালেখির দর্শন। বই নিয়ে লেখার পাশাপাশি দুয়েকটি রাজনৈতিক কথাবার্তা বলেছি। তাতেই ট্যাঁট্…