তুমি কেবল গল্প পড়ছো না, তুমি একটা পক্ষও নিচ্ছো
অনেকেই বলে, “আমি বই পড়ি শুধু মজা পাওয়ার জন্য। এত গভীর ভাবে ভাবার দরকার কী?” ঠিক আছে, কিন্তু তুমি কি জানো, তুমি কী বই পড়ছো সেটাই বলে দেবে তুমি কেমন মানুষ?
এমনটা কি সত্যিই সম্ভব? এমন এক নির্দোষ বই পড়া, যা রাজনীতির ধারেকাছেও যাবে না? যেখানে যুদ্ধ, অনাহার, রোগব্যাধি, দুর্নীতি, শ্রেণিবিভেদ, জাতিবিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম্য—কোনো কিছুই ঢুকতে পারবে না? লিখলে কারও না কারও অপছন্দ হবেই। এটাই লেখালেখির দর্শন। বই নিয়ে লেখার পাশাপাশি দুয়েকটি রাজনৈতিক কথাবার্তা বলেছি। তাতেই ট্যাঁট্যাঁ শব্দ তুলে কেউ যখন ম্যাসেঞ্জারে বার্তা দেন; “সব কিছুতে রাজনীতি টেনে আনতে হবে নাকি?” তখন বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও লেগেছে। তাদের জন্য একটাই উত্তর: রাজনীতি তোমাকে ছাড়বে না, বই পড়ো বা না পড়ো।
আমরা তো শুনেছি, লেখক যা জানেন তাই লেখেন। আর মানুষজন ইতিহাসের পাতায় কখনও ভালো ভালো দিন পায়নি। একটা যুদ্ধ শেষ হয়েছে তো আরেকটা শুরু হয়েছে, কেউ খেতে পায়নি, কেউ রাস্তায় পড়ে থেকেছে, কেউ কারও দাসত্ব করেছে। কাজেই বইও এই বাস্তবতার ফসিল—যেখানে অতীত-বর্তমানের সব আঁচড় গাঁথা থাকে। আর যারা পড়ে, তারা সেই গল্পের মধ্য দিয়ে হাঁটে, জানে, ভাবে, প্রশ্ন তোলে। তাহলে কি একজন পাঠক নিছক দর্শক? নাকি সে নিজেই এক ধরনের রাজনৈতিক সত্তা?
বই মানেই কি শুধুই কাল্পনিক জগতের ভেতর ডুবে থাকা? শার্লক হোমসের লন্ডন, টলকিয়েনের মধ্য-পৃথিবী, জে. কে. রাউলিং-এর হগওয়ার্টস? সত্যজিতের ফেলুদা? বা পুতুলনাচের ইতিকথা? শোনো, যত ফ্যান্টাসি-ফিকশনই পড়ো না কেন, আসল পৃথিবীকে বাদ দিয়ে কিছু লেখা যায় না। মধ্যযুগের দাসপ্রথা না থাকলে তোমার গেম অফ থ্রোনসও থাকত না, ঔপনিবেশিক ইতিহাস না থাকলে টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চারও এমন হতো না, পুঁজিবাদ না থাকলে জর্জ অরওয়েলকে এত কষ্ট করে ১৯৮৪ লিখতে হতো না।
এমনকি যদি লেখক ভবিষ্যতের গল্পও বলেন, তবে সেটাও বর্তমান থেকেই অনুপ্রাণিত। এক্স-মেনদের মিউট্যান্টদের পেছনে কি নিখুঁত মেটাফর নেই বর্ণবৈষম্যের? হ্যান্ডমেইডস টেল কি নিছক ফিকশন, নাকি বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার এক চরম রূপ? কাজেই, লেখকরা যতই "রাজনীতি মুক্ত" কিছু লিখতে চান, রাজনীতি ঠিকই লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
পাঠক কি নিছক গল্পের সঙ্গে ভেসে চলে? সে শুধু পাতা ওল্টায়, নাকি সে বিচার করে? যে বই পড়ে, সে শেখে—সেটা বই পড়ার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দিক। যে শেখে, সে প্রশ্ন তোলে, যা নিয়ে ভাবতে বলা হয়নি, তা নিয়েও ভাবে।
একটা উদাহরণ নেওয়া যাক—টু কিল আ মকিংবার্ড কিংবা বেলা চাও গানটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? পথের দাবিকে কেন এত ভয়? কেন এগুলো নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে? কারণ এগুলো কেবল বিনোদন নয়, বরং মানুষের মনে প্রশ্ন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেয়। কাজেই বই শুধু শেখায় না, তাতে কাজ করার তাগিদও তৈরি করে।
ইতিহাস দেখিয়েছে, লেখকরা তাদের কলম দিয়ে শাসকদের কাঁপিয়ে দিয়েছে। প্লেটো থেকে শুরু করে নজরুল, পাবলো নেরুদা থেকে সালমান রুশদি—তারা যে শব্দগুলো লিখেছিলেন, সেগুলো ছিল শাসকের চোখে "বিপজ্জনক"। কেন? কারণ শব্দের ক্ষমতা আছে বিদ্রোহ তৈরি করার। তাই লেখকরা জেলে গেছেন, বই নিষিদ্ধ হয়েছে, লেখকেরা নির্বাসিত হয়েছেন।
কিন্তু শুধু লেখক কেন? পাঠকের দিক থেকে দেখো—একজন ম্যান্ডেলা কারাগারে বসে পড়ছেন ইনভিক্টাস, একদল ছাত্র কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে, রাশিয়ায় গুপ্ত পাঠাগার তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ বই রাখার জন্য। কারণ, বই শুধু মনের খোরাকই দেয় না, বরং মনের দাসত্ব ভাঙার হাতিয়ারও দেয়।
অনেকেই বলে, “আমি বই পড়ি শুধু মজা পাওয়ার জন্য। এত গভীর ভাবে ভাবার দরকার কী?” ঠিক আছে, কিন্তু তুমি কি জানো, তুমি কী বই পড়ছো সেটাই বলে দেবে তুমি কেমন মানুষ? তুমি যদি শুধু কিশোর-মাসলওয়ালা হিরো পড়ো, তাহলে বুঝবে না যে শক্তির সংজ্ঞা আসলে কী। তুমি যদি শুধুই বিলিয়নিয়ার রোমান্স পড়ো, তাহলে সমাজের শ্রেণি-ভেদ নিয়ে ভাবার সুযোগও পাবে না। আবার স্প্যাডারম্যানেও তো আছে গ্রেট পাওয়ার কামস উইথ গ্রেট রেস্পন্সিবিলিটিস। বই মানেই শুধু ফ্যান্টাসি নয়, বই একটা কাচের জানালা—যেখানে তুমি দ্য ওয়াচার্সদের মতো সমাজের শেকড়গুলো দেখতে পাও।
বই পড়ে মানুষের চিন্তাভাবনা বদলে যায়, বদলে যায় সিদ্ধান্ত, এবং শেষমেশ বদলে যায় দুনিয়াটাই। কেন মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যায়? কেন একজন পাঠক একদিন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “এই অন্যায় সহ্য করা যাবে না”? "...আর দাবায়ে রাখতে পারবা না"। কারণ সে পড়েছে, জেনেছে, বুঝেছে। আর একবার জানার পর আর অন্ধ থাকার উপায় থাকে না।
পড়া মানেই স্রেফ নিজের আনন্দের জন্য পড়া নয়, পড়া মানে ভাবা, প্রশ্ন তোলা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, নিজেদের পক্ষ চেনা। তাই বই কখনও নিরীহ হতে পারে না। বই পড়া মানেই সমাজের মধ্যে নিজেকে একরকমভাবে স্থাপন করা—তুমি যা পড়ছো, সেটাই তোমার রাজনৈতিক অবস্থান। তুমি হয় পরিবর্তন আনবে, নয়তো পরিবর্তনের বিরোধিতা করবে। কিন্তু তুমি কখনও নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না।
সুতরাং, তুমি যখন পরের বার একটা বই খুলবে, তখন মনে রেখো—তুমি কেবল গল্প পড়ছো না, তুমি একটা পক্ষও নিচ্ছো।
একেকটা বইকে হাতিয়ার করে লড়ো
বই আমার জন্য শুধু আশ্রয় নয়, পথপ্রদর্শকও। সমস্যা যখন পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়, তখন ভিক্টর ফ্র্যাংকেলের “Man’s Search for Meaning” পড়া যেন জরুরি ওষুধ হয়ে ওঠে। এক রাতে, জানলার কাচে বৃষ্টি পড়ার ছন্দ শুনতে শুনতে এক বাক্যের দেখা পেলাম— "জলে পড়ে গেলে মানুষ ডোবে না, ডোবে সে তখনই, যখন সে সেখানেই থেকে যায়।" কথাটা শুনে মনে হলো, হেমিংওয়ের