এ বই খালি পেটে খাবেন না
নামটাই যখন Meet Human Meat, তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, লেখক চা-চপ-শিঙাড়া টাইপ সাহিত্য রেঁধে দেননি। বরং মেনুতে রেখেছেন পরাবাস্তবতার ঝোল, ব্যঙ্গের কাঁচা মাংস, আর নিষ্ঠুর সত্যের ফ্যান।
মোজাফ্ফর হোসেন বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের এক নিজস্ব ‘ক্যাফে’ খুলে বসেছেন, যেখানে গল্পের সঙ্গে মেলে একটু পরাবাস্তবের ধোঁয়া, এক চিমটে স্বপ্নদর্শন আর ভালো পরিমাণে ব্যঙ্গের তিক্ততা মেশানো ঝাঁজ। তাঁর গল্পের চরিত্ররা বাস্তবেই থাকে, তবে অদ্ভুতভাবে তারা যেন নিজেদের বাস্তবতায় ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না—ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষ্ঠানে কেউ হঠাৎ ডিজে বাজিয়ে দিলে যা হয়। আর গল্পের মধ্যেই কোথাও একটা প্যাঁচ থাকে, যা এমনভাবে মোচড় দেয় যে পাঠক কখন হেসে ফেলবেন আর কখন ভাবতে বসবেন—তা বোঝার আগেই গল্প শেষ!
Meet Human Meat and Other Stories বই সেইসব পাঠকদের জন্য, যারা সাহিত্যে কফির মতো গাঢ় তেতো স্বাদ পছন্দ করেন—একটু পরাবাস্তবের মোড়কে, একটু স্বপ্নের আবছায়ায় আর মাঝেমধ্যে এমন সব ব্যঙ্গ-বাণে যে মনে হবে, লেখক বুঝি চোখ টিপে একবার তাকিয়ে নিলেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রঙচঙে প্যান্ডেলটা একটু উঁকি মেরে দেখতে চাইলে, এটাই আপনার টিকিট। যদি সাহিত্যের নতুন স্বাদে ডুব দিতে চান, যেখানে প্রতিটি বাক্য একটু চমকায়, একটু ধাক্কা দেয়—তাহলে আর কী, ঝাঁপ দিন!
এই বইটিতে রয়েছে সতেরোটি ছোটখাটো গল্প—মানে আকারে ছোট, কিন্তু চিন্তার ল্যাবরেটরিতে বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষমতা রাখে!! এখানে আছে পরাবাস্তবতার হালকা ঝাঁজ, জাদুবাস্তবতার মিহি আস্তরণ আর শ্লেষ রসিকতার ধারালো কাঁচি দিয়ে কাটা সমাজের ছবি। গল্পগুলো মানুষের সেই দিকটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে, যেটা আলোয় কম আসে—অন্যায়ের নিঃশব্দ ছায়াগুলো, সমাজের ব্যঙ্গাত্মক দ্বন্দ্ব আর অস্তিত্বের আজব টানাপোড়েন। পাঠক কখন ভাবতে বসবেন, কখন চমকে উঠবেন আর কখন নির্দ্বিধায় হেসে ফেলবেন—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই গল্পগুলো নিজের কাজ সেরে চলে যাবে!
২০২৩ সালের ৫ই এপ্রিল, বাজারে এল Meet Human Meat and Other Stories—একখানা বই, যার নাম শুনেই পাঠক প্রথমে চমকাবে, তারপর একটু নড়েচড়ে বসবে, তারপর কপালে ভাঁজ ফেলে ভাববে—“ব্যাপার কী! এ কি রেসিপি বুক নাকি? নামটাই যখন Meet Human Meat, তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, লেখক চা-চপ-শিঙাড়া টাইপ সাহিত্য রেঁধে দেননি। বরং মেনুতে রেখেছেন পরাবাস্তবতার ঝোল, ব্যঙ্গের কাঁচা মাংস, আর নিষ্ঠুর সত্যের ফ্যান। সাহিত্যের নাদুসনুদুস পাঠকদের জন্য আদৌ উপযুক্ত নয়—তবে যদি কষ্ট করে একটু দাঁতে দাঁত চেপে গিলতে পারেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, এতদিন ধরে সত্যিটা আসলে কোন প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল!
বইটি কেবল গল্প বলে না, গল্পের নাম করে পাঠকদের নিয়ে যায় এক আজব দুনিয়ায়—যেখানে বাস্তবতা হেলে পড়ে পরাবাস্তবের দিকে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আর স্বার্থপরতা এমন স্বাভাবিক যে, খেয়াল না করলে মনে হবে এটাই নিয়ম। যেখানে লুকিয়ে থাকা যৌনতা ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে চায়, কিন্তু সমাজ তাকে চুপ করিয়ে দেয়। যেখানে আধুনিক সভ্যতা নিজের কাঁধেই হাত চাপড়িয়ে বলে, “দারুণ চলছে সব!”—অথচ গল্পগুলো আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়, সেই হাতটা আসলে কারো গলা চেপে ধরা।
বইয়ের গল্পগুলো আসলে একধরনের আয়না—তফাতটা শুধু এই যে, এতে মুখ দেখলে চামড়া নয়, ভেতরের কঙ্কালটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বই মানবস্বভাবের জটিল সব দিক নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে, আর আমাদের সভ্যতার সেই অদ্ভুত-উদ্ভট সত্যগুলো সামনে এনে ফেলে, যেগুলো একদিকে গা শিউরে দেয়, আবার অন্যদিকে যেন সার্কাসের চালাক ক্লাউনের মতো ভেংচি কাটে।
মোজাফ্ফর হোসেনের গল্প বলার কায়দা এমনই যে, পাঠকরা চুপচাপ পড়ে যেতে পারেন না—তাদের বাধ্য করে ভাবতে, তারা সত্যিই যা বিশ্বাস করেন, তা আদৌ সত্যি কিনা, নাকি শুধু বহুকাল ধরে শুনতে শুনতে বিশ্বাস হয়ে গেছে।
বইটি নামমাত্রে গল্পসংকলন, কিন্তু এটা এক ধরনের বুদ্ধির অ্যান্টিবায়োটিক—সতর্কবার্তা লেখা থাকে, "খালি পেটে খাবেন না"। মোজাফ্ফর হোসেন এখানে পরাবাস্তবতার আকাশে ব্যঙ্গ রসিকতার ঘুড়ি উড়িয়েছেন, আর পাঠকরা সেটা ধরতে গিয়ে বারবার জড়ো হচ্ছেন অস্তিত্বের আজব গোলকধাঁধায়।
এখানে সমাজকে এমনভাবে আয়নায় দাঁড় করানো হয়েছে যে সে নিজেকেই চিনতে পারবে না—একটু জাদুবাস্তবতা, খানিকটা ব্যঙ্গ, আর মুঠো মুঠো প্রতীকবাদের চমৎকার রাঁধুনি-ঘটকালি। পাঠকের মগজে ঢোকার ব্যবস্থা এমন যে, গল্প পড়ার পর মাথার মধ্যে একটা ছোটখাটো বিদ্রোহ শুরু হবে—"এতদিন যা সত্যি ভেবেছিলাম, সেটা কি সত্যিই সত্যি?"
আর যাঁরা ভাবছেন, এ বই তাঁদের জন্য কিনা—তাঁদের জন্য ছোট্ট এক পরামর্শ। যদি আপনি জীবনকে হীরের আংটির মতো যত্নে রাখেন, ধুলো লাগলে ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করেন, কিংবা সিরিয়াসনেসের বোতাম সর্বদা ON রাখেন—তাহলে দয়া করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
কিন্তু যদি আপনার রসবোধ একটু ক্যাফেইন চড়ানো, যদি সমাজের হিপোক্রিসি দেখে আপনার মনে হয়, এত “বড় সার্কাসে টিকিট কেটে এলাম কবে?”, আর যদি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মাথায় existential crisis লেগে যায়—তাহলে Meet Human Meat আপনার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পাঠ্য।
এটা কোনো বই নয়, এটা একধরনের শক থেরাপি। নেবেন, নাকি আরামদায়ক মিথ্যার লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমোবেন? 🎭 ভেবে দেখুন!