আমেরিকার এন পি আর-এ প্রকাশিত হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার
ছয় বছর পর এটি মুরাকামির প্রকাশিত উপন্যাস এবং মূলত ১৯৮০ সালে লেখা একটি নভেলার পুনর্লিখন। একটি ইমেইল সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি অনুবাদকের সহায়তায় কথা বলেছেন।
আমেরিকার এন পি আর-এ প্রকাশিত হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অ্যান্ড্রু লিমবং
হারুকি মুরাকামির দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস নিয়ে কথা বলা খুব সহজ নয়। উপন্যাসটি শুরু হয় এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে, যার কাজ স্বপ্ন পড়া। সেই স্বপ্নগুলো সংরক্ষিত থাকে একটি গ্রন্থাগারের তাকগুলোতে। এই গ্রন্থাগার এমন একটি শহরে অবস্থিত, যা একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রবেশপথ পাহারা দেয় এক গেটকিপার। আর প্রতিটি মানুষের একটি ছায়া থাকে—যা স্বতন্ত্রভাবে তার স্বত্বাধিকারী থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতে পারে।
ছয় বছর পর এটি মুরাকামির প্রকাশিত উপন্যাস এবং মূলত ১৯৮০ সালে লেখা একটি নভেলার পুনর্লিখন। একটি ইমেইল সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি অনুবাদকের সহায়তায় কথা বলেছেন। মুরাকামি বইটির প্রেরণা, বার্ধক্য সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি এবং দ্য গ্রেট গ্যাটসবি-এর প্রতি তাঁর অটুট ভালোবাসা নিয়ে আলোচনা করেন।
দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস ১৯৮০ সালে লেখা একটি ছোটগল্প থেকে অনুপ্রাণিত, যা আবার হার্ড-বয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যান্ড দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড উপন্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি যখন কয়েক দশক আগের লেখালেখির দিকে ফিরে তাকান, তখন কেমন মনে হয়?
১৯৮০ সালে লেখা নভেলা দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস আমার একমাত্র ছোটগল্প, যা আমি পুনর্মুদ্রণের অনুমতি দিইনি। এটি একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, তবে বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। কারণ, ম্যাগাজিনে প্রকাশের সময় আমি অনুভব করেছিলাম, এটি এখনও অপরিণত এবং অসম্পূর্ণ। গল্পটির থিম আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এটি একজন উপন্যাসিক হিসেবে আমার যাত্রার সূচনাবিন্দু বলা যেতে পারে। তবে, তখন আমার লেখার দক্ষতা যথেষ্ট ছিল না, যা গল্পটিকে আমি যেভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম, সেভাবে উপস্থাপন করতে পারতো।
তাই আমি ঠিক করেছিলাম, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের পর এটি পুরোপুরি পুনর্লিখন করব। কিন্তু এর মাঝে নানা প্রকল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং প্রায় ৪০ বছর কেটে যায়, যা আমার কাছে মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। এরই মধ্যে আমি ৭০-এর কোঠায় পৌঁছে ভাবি, হয়তো সময় খুব বেশি বাকি নেই। অবশেষে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপন্যাসটি শেষ করতে পেরে আমি বেশ স্বস্তি বোধ করছি। যেন কাঁধ থেকে একটি ভার নেমে গেছে। যদি আরও ৪০ বছর বাঁচতে পারতাম, হয়তো আবারও এটি পুনর্লিখন করতাম!
এই উপন্যাসে আপনি একাকিত্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং ভালোবাসা নিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে লিখেছেন। সুররিয়ালিস্টিক বা জাদুবাস্তবতা কীভাবে এই থিমগুলো নিয়ে বলতে পারে, যা বাস্তবধর্মী সাহিত্য পারে না?
আমি কখনোই আমার লেখার ধরনকে সুররিয়ালিস্টিক বা জাদুবাস্তব হিসেবে ভাবিনি। আমি কেবল সেই গল্পগুলো লিখি, যা আমার লিখতে ইচ্ছে করে, এবং এমন একটি শৈলীতে যা আমার সঙ্গে মানানসই। যখন আমি কল্পগল্প লিখি, তখন গল্প যেন স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে চলে, ঠিক যেমন জল ভূমির প্রকৃতি অনুসরণ করে প্রবাহিত হয়। আমার কাজ শুধু এই প্রবাহকে যতটা সম্ভব বিশ্বস্তভাবে শব্দে রূপ দেওয়া।
দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস লেখার কাজ আপনি শুরু করেছিলেন মার্চ ২০২০-এ, একসময় যখন বাইরে বের হওয়ার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত, এবং বেশিরভাগ সময় আপনি এই উপন্যাসের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। উপসংহারে আপনি লিখেছেন, "এই পরিস্থিতি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো নয়। তবে আমার মনে হয়, এটার অবশ্যই কিছু অর্থ রয়েছে। আমি এটা গভীরভাবে অনুভব করি।" কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, আপনি কীভাবে মহামারির প্রভাবকে এই উপন্যাসের প্রক্রিয়ায় দেখেন?
এই উপন্যাস লেখার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ শান্তি, নিঃসঙ্গতা এবং গভীর চিন্তার প্রয়োজন ছিল। দেয়াল দিয়ে ঘেরা সেই শহরকে আপনি চাইলে বিশ্বজুড়ে লকডাউনের একটি রূপক হিসেবেও দেখতে পারেন। কীভাবে চূড়ান্ত একঘেয়েমি এবং গভীর সহমর্মিতার উষ্ণ অনুভূতি একসঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে? এটি এই উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ থিম।
এই বইয়ে ছায়ার ধারণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছায়া এবং জুটির ধারণা আপনাকে কীভাবে উদ্ভুদ্ধ করেছে?
আমার উপন্যাসগুলোর পুরুষ চরিত্রগুলো সরাসরি আমাকে প্রকাশ করে না, বরং এমন এক "আমি"কে উপস্থাপন করে, যা আমি হতে পারতাম। এই সম্ভাবনার বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করা আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, এবং এটি আমার উপন্যাস লেখার বহু বছরের অন্যতম বড় আনন্দ। বাস্তব জীবনে আমরা খুব কমই সুযোগ পাই নিজস্ব সত্ত্বার বাইরে অন্য কেউ হয়ে ওঠার।
হয়তো মানুষ একক সত্তা নয়, বরং একাধিক সত্তার মিশ্রণে গঠিত। এবং হয়তো বাস্তব সত্তা আর ছায়া একে অপরের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য হতে পারে—এই ধারণাটি আমাকে প্রায়ই লেখার সময় প্রভাবিত করে। গল্পের মাধ্যমে আমি সেই সম্ভাবনাগুলো অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি।
আপনার কি আর কোনো পূর্বের লেখা আছে, যেটি আপনি পুনরায় দেখার বা পুনর্লিখনের কথা ভাবছেন?
না, তেমন কোনো লেখা নেই। এমন কিছু অবশ্যই আছে, যা নিয়ে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই, তবে সেগুলো পুনর্লিখনের ইচ্ছে নেই। এই অসম্পূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে কিছু নিয়ে আফসোস রয়েছে, আবার নেইও। জীবনে এমন কিছু ভুল থাকে যা অনিবার্য এবং প্রয়োজনীয়, আবার কিছু ভুল থাকে যা সংশোধন করা আবশ্যক। আমার লেখাগুলোর মধ্যেও এই দুই প্রকারের ভুলের প্রতিফলন রয়েছে।
আপনি লিখেছেন, লেখালেখি সম্পর্কে যা কিছু জানেন, সবই আপনি শিখেছেন সঙ্গীত থেকে। যদি এটি এখনও সত্য হয়, তবে আপনার জন্য নতুন সঙ্গীত আবিষ্কার করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সঙ্গীতের কি এখনও আপনার লেখালেখিকে কিছু শেখানোর আছে?
তরুণ বয়সেই সঙ্গীতকে সবচেয়ে গভীরভাবে অনুভব করা যায়, যখন এটি হৃদয় ও আত্মায় প্রবেশ করে। সাধারণত এটি ঘটে কৈশোর থেকে কুড়ি বছর বয়সের মধ্যে। আমি যখন সেই বয়সে ছিলাম, তখন অনেক অসাধারণ সঙ্গীত আত্মস্থ করেছি এবং সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষা পেয়েছি। এখনকার দিনে... আমি কেবল ভালো সঙ্গীত উপভোগ করি।
গত কয়েক বছরে আপনার কিছু সাক্ষাৎকারে আপনার নারী চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ধরনের সমালোচনা আপনি কিভাবে দেখেন?
সত্যি বলতে কি এক পর্যায়ে আমি পুরোপুরি সমালোচনা পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি দুঃখিত ওই নির্দিষ্ট সমালোচনার প্রেক্ষাপট আমার জানা নেই। সাধারণভাবে বলতে গেলে, আমার একজন মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা আছে, এবং আমার উপন্যাসগুলোরও তাই। তাই কিছু সমালোচনা হওয়া স্বাভাবিক। যদি মানুষ আমার কাজ উপভোগ করে, তাহলে সেটা আমাকে আনন্দ দেয়। আর যদি না করে, তাহলে আমি কেবল বলতে পারি, "আমি দুঃখিত।"
আপনি এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের বড় ভক্ত, এবং আমি জানি আপনি তাঁর কাজ অনুবাদ করেছেন। আগামী বছর দ্য গ্রেট গ্যাটসবি-এর শতবর্ষ পূর্ণ হবে। অনুবাদ করার পর এই বইটির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ও বোঝাপড়া কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে?
দ্য গ্রেট গ্যাটসবি অনুবাদ করার সময় আমি খুব গভীরভাবে অনুভব করেছি যে এই উপন্যাসে কিছুই যোগ করার প্রয়োজন নেই, আবার কিছুই অতিরিক্ত নয়। এটা বলা বাহুল্য, তবে খুব কম উপন্যাসই এই গুণগুলো ধারণ করে, যা গ্যাটসবিকে গত এক শতাব্দী ধরে কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছে। এটি সত্যিই এক অসাধারণ এবং অনন্য সাহিত্যকীর্তি। জাপানিতে এই উপন্যাস অনুবাদ করা আমার জন্য ছিল একদিকে কঠিন চ্যালেঞ্জ, আর অন্যদিকে এক অন্তহীন আনন্দের উৎস। এর প্রতিটি বাক্য এবং থিম এতটাই নিখুঁতভাবে বিন্যস্ত যে এটি লেখার শিল্পকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
আপনি এখন কী নিয়ে লেখালেখি করছেন?
সেটা না হয় গোপনই থাক।
অনুবাদঃ রিটন খান
লেখাটি সমকাল প্রত্রিকায় প্রকাশিত।