যারা অনুবাদ করেন, তাঁরা আমার কাছে তপস্বী। তাঁরা সেই সেতুবন্ধনের কারিগর, যাঁরা এক ভাষার আলো আরেক ভাষার জানালায় এনে রাখেন। তাঁদের না থাকলে, বাংলা ভাষার পাঠক হিসেবে আমরা পৃথিবীর বহু মহৎ আত্মাকে চিনতেই পারতাম না—টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, কাফকা, মার্কেজ কিংবা বোরহেস, সকলেই থাকতেন দূর, অনুদ্ঘাটিত এক নক্ষত্রবিন্দু হয়ে। তাই অনুবাদকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিঃশেষ নয়, তা একপ্রকার কৃতজ্ঞতার অনুশাসন।
তবু যখন নিজে অনুবাদ করতে বসি, কলম ধরা হাত কাঁপে, মাথা ভার হয়ে আসে। শব্দের সামনে বসে মনে হয়, আমি যেন এক পরদেশি। কারণ বাংলা আমার ভাবপ্রকাশের স্বাভাবিক ভাষা নয়—এ ভাষায় আমি স্কুলের পর আর পড়াশোনা করিনি, কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাইনি। অথচ এই ভাষাতেই আমি বড় হয়েছি, এই ভাষাতেই পৃথিবীকে চিনেছি। আমার জীবনের সব শিক্ষা, সব বোধ, এসেছে বাংলা বই পড়ে—বঙ্কিম থেকে বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পর্যন্ত। তাই বাংলায় যারা লেখেন, তাঁদের আমি শিক্ষক বলেই মানি; তাঁদের প্রতিটি বাক্য আমার কাছে পাঠশালা।
তবু অনুবাদ না করার কারণ শুধু ভাষার সীমাবদ্ধতা নয়—এর মধ্যে আছে আমাদের সাহিত্যচর্চার এক গভীর শূন্যতা, এক নীরব পরিত্যাগের ইতিহাস। আমাদের সাহিত্য অনেক সময় নিজেরই শিকড় ভুলে যায়, মাতৃভাষাকে তর্জনীতে মাপতে চায়। যে সমাজ নিজের ভাষার বুকে গাঁথা রসের সুর হারায়, তার অনুবাদও হয় নিঃস্ব, মুখে উচ্চারিত কিন্তু মনে অনুপস্থিত।
তাই আমি এই পথকে নিজের বলি না। আমি বাংলাটাই পুরোপুরি জানি না—এই স্বীকারোক্তিতেই আমার সামান্য অহংকার লুকিয়ে আছে। কারণ জানা মানে কেবল ব্যাকরণ জানা নয়; জানা মানে ভাষার অন্তঃস্বর শোনা, তার নিঃশব্দ বেদনা বোঝা। অনুবাদ, তাই, আমার কাছে রূপান্তর নয়—এ এক হৃদয়ের পুনর্জন্ম। আর যে ভাষার গভীরে ডুব দেওয়া যায় না, সেখানে পুনর্জন্মও অসম্ভব।
মোহিতলাল মজুমদার একবার বলেছিলেন, বিদেশি ভাষার উৎকৃষ্ট রচনাকে যথার্থভাবে অনুবাদ করতে গেলে কেবল শব্দার্থ জানা যথেষ্ট নয়; জানতে হয় সেই ভাষার রসবোধ, তার ইডিয়মের গোপন সুর, সেই দেশজ অভ্যাসের ছন্দ যেখানে অর্থ জন্ম নেয়। একই সঙ্গে দরকার নিজের ভাষায় সেই রস, সেই ছন্দ পুনর্নির্মাণের ক্ষমতা। অথচ বাংলার অনেক অনুবাদকই, তাঁর মতে, এই শক্তির অভাবে ভোগেন—কারণ তাঁরা বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের ভাষার গভীরে প্রবেশ করতে জানেন না। তাঁদের ব্যবহৃত বাংলা এক ধরনের কৃত্রিম ভাষা, যেখানে ইডিয়মের প্রাণশক্তি নিঃশেষ।
এই বক্তব্যের সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর একটা পর্যবেক্ষণও উল্লেখ করি। তিনি বলেছেন, তাজমহল ইট দিয়ে তৈরি করা যেমন প্রায় অসম্ভব সাধনা, তেমনি বাংলা ভাষায় রস ও ছন্দ—এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটানোও প্রায় এক অলৌকিক কৃত্য। ছন্দের তাল রক্ষায় সুর ঢিলে হয়ে যায়, সুর আঁটলে তাল ফসকে যায়। এর পেছনে তিনি যে গভীর কারণটি দেখিয়েছিলেন তা চিরস্মরণীয়—বাংলা ভাষা একতারার, আর সংস্কৃত ভাষা রুদ্রবীণার। একতারায় সেই জটিল ঝঙ্কার তোলা যায় না।
এই দুই মন্তব্য আসলে বাংলা ভাষার সংগীতাত্মক সীমা ও সম্ভাবনার এক দ্বন্দ্বচিত্র। মোহিতলাল যেখানে ভাষার রসস্বরূপ হারানোর জন্য অনুবাদককে অভিযুক্ত করেছেন, প্রমথ সেখানে ভাষার স্বরযন্ত্রের সীমাকে স্বীকার করেছেন শিল্পীর দৃষ্টিতে। একজন বলছেন—আমরা ভাষার মর্ম জানি না; অন্যজন বলছেন—আমাদের ভাষার মর্মই আলাদা। এই দুই উপলব্ধির ফাঁকেই বাংলা অনুবাদ ও সৃষ্টির সমস্ত সংগ্রাম লুকিয়ে আছে।
তবু, সেই সীমার মধ্যেই তো অনুবাদকেরা নতুন সুর খুঁজেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে যেমন ইংরেজি ভাষা পেয়েছিল বাংলা ছন্দের মাধুর্য, তেমনি পরবর্তীকালে জীবনানন্দ বা শক্তির কবিতায় বাংলার ইডিয়ম ফিরে পেয়েছিল তার নতুন শক্তি। ভাষা, শেষ পর্যন্ত, কেবল শব্দের গঠন নয়—স্বর, বোধ, রক্তে মেশা ঐতিহ্যের সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতকে বুঝতে পারলেই অনুবাদ হয় শিল্প, অন্যথায় থাকে শুধু রূপান্তর।
এইটুকুই পার্থক্য, প্রণাম।


