রাজনৈতিক ইসলামের ছদ্মবেশ
এখানে জোট নয়—পিছন থেকে ছুরি মারা হয়। যারা বোঝে না, তারা আবারও ভুল করবে। আর যারা বোঝে, তারা হয়তো চুপ করে থাকবে—পাছে আবার পার্টির চামড়ার নিচে রক্ত গড়ায়।
সামির আমিন, সেনেগালের ডাকারে অবস্থিত 'থার্ড ওয়ার্ল্ড ফোরাম'-এর পরিচালক। তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে দ্য লিবারাল ভাইরাস (মান্থলি রিভিউ প্রেস, ২০০৪), আ লাইফ লুকিং ফরওয়ার্ড (জেড বুকস, ২০০৭), এবং দ্য ওয়ার্ল্ড উই উইশ টু সি: রেভল্যুশনারি অবজেক্টিভস ইন দ্য টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি, যা শীঘ্রই মান্থলি রিভিউ প্রেস থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন, Political Islam in the Service of Imperialism (সাম্রাজ্যবাদের সেবায় রাজনৈতিক ইসলাম)। এই প্রবন্ধটি মূল ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেমস মেমব্রেজ।
প্রবন্ধটি পড়ে আমার যা মনে হয়েছিল তাই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ।
রিটন খান
রাজনৈতিক ইসলাম এমন এক পরিচয়ের দাবিদার, যা ধর্ম ও রাজনীতির সীমারেখাকে একদম মুছে দেয়। তারা বলে, ইসলামে এই বিভাজন ছিল না, থাকবার কথাও নয়। অথচ এই দাবির ভেতরই এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল অনুরণন বাজে, যা একসময় ইউরোপের রক্ষণশীলদের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল—যখন তারা প্রগতিবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আমাদের ঐতিহ্যই যথেষ্ট, আলোর দরকার নেই।’
তবে এই ইসলামবাদীরা ধর্মের মৌল মর্মবাণীর চেয়ে সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয় বেশি। তাদের অনুরাগ ধর্মীয় নীতিতে নয়, বরং গোষ্ঠীগত আত্মপরিচয়ে। এদের আগ্রহ কোরআনের গভীর ব্যাখ্যায় নয়, বরং এই তর্কে—“আমরা কারা”। ফলে তারা এমন এক চেহারা তৈরি করে, যাকে ধর্ম বলে মনে হয়, কিন্তু যার ভিতরটা ফাঁপা, মিথ্যা, এবং প্রায়শই কৌশলী। এই কৌশলের সুবিধা নেয় সাম্রাজ্যবাদ—সংস্কৃতির পার্থক্যগুলোকে সামনে রেখে মূল সংঘাত থেকে চোখ সরিয়ে রাখে, যেন আসল দ্বন্দ্বটা শ্রেণির নয়, কেবল বিশ্বাসের।
অথচ বাস্তবতা এই যে, এই ন্যারেটিভ যত না ঈশ্বরমুখী, তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক। কারণ এতে মানুষের দৃষ্টি ঘুরে যায় শোষণের মূল কাঠামো থেকে। দারিদ্র্য, বৈষম্য, মালিক ও শ্রমের দ্বন্দ্ব—এসব ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায় ধর্মের ‘গৌরব’ আর ‘সংস্কৃতি রক্ষার’ নামে। এবং ঠিক এখানেই, এই ইসলামপন্থী রাজনীতির ‘ধর্মীয় আবেগ’ এক সময়ের শ্রেণিসংগ্রামের পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে এনে বসায় এক প্রতিক্রিয়াশীল বস্তুতন্ত্রের কোলে।
বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ালে দেখা যায়, রাজনৈতিক ইসলাম বরং পুঁজিবাদেরই পাশে দাঁড়ায়। যেন ছদ্মবেশে এক অদ্ভুত আঁতাত, যেখানে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুখর হবার বদলে তারা হয়ে ওঠে তারই শরিক। যারা বলে, ‘ধর্মের শাসন চাই’, তারাই আবার অর্থনীতির মুনাফার রাজনীতিকে প্রশ্ন করে না। বরং সম্পত্তির অধিকারকে ‘পবিত্র’ বলে মান্যতা দিয়ে বসে। ফলে ধনী শ্রেণি—যারা জমির মালিক, কারখানার প্রভু, কিংবা তেল-গ্যাসের পাহারাদার—তাদের স্বার্থেই এরা কথা বলে।
এই দ্বিচারিতা সবচেয়ে স্পষ্ট ধরা পড়ে যখন দেখা যায়, মিশরের মতো দেশে ইসলামপন্থীরা এমন আইনকে সমর্থন করে, যা জমির মালিকদের হাতে আরও শক্তি তুলে দেয়; আর গরিব কৃষকেরা—যারা ভোর থেকে মাথা কুটে ফসল ফলায়—তারা হারায় নিজেদের দাঁড়াবার মাটি। ধর্মের নামে এসব আইন আসলে ধনীর স্বার্থরক্ষার অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
তবে এসব ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয় ‘পশ্চিমবিরোধিতা’র মুখোশ। তারা বলে, ‘আমরা পশ্চিমের সংস্কৃতিকে চাই না’, অথচ পশ্চিমের পুঁজির শিকড়কে তারা ছুঁয়েও দেখে না। বরং এই ‘পশ্চিমবিরোধী’ কথার আড়ালে তারা সাম্রাজ্যবাদকে আরও সুবিধা করে দেয়। লোকাল অর্থনীতি, যা আগে থেকেই ভাঙা, কংকালসার—তাতে আরও এক থাবা বসায় বৈশ্বিক পুঁজির দানব। আর ইসলামপন্থীরা, বুঝে না বুঝে, এই খেলারই বোকার দলে নাম লেখায়।
রাজনৈতিক ইসলাম আজকাল জনতা টানে। মিছিল জমে, পোস্টার উঠে, ব্যালট বাক্সে পড়ে কালি-মাখা আঙুল। কিন্তু যারা এগিয়ে আসে, তারা আসে সংস্কৃতির নাম ধরে, নয় কোনো প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক মুক্তির নকশা নিয়ে। তারা বলে—‘আমরা আলাদা’, কিন্তু কখনও বলে না, ‘আমরা শোষণের বিরুদ্ধে এক’।
যেখানে দরকার, সেখানে তারা থাকে না। ঘামভেজা শ্রমিকের পাশে, জমি হারানো কৃষকের কাঁধে, কিংবা ভাঙা বস্তির ভিতর স্যাঁতসেঁতে ঘরে তারা যায় না। বরং ছোটোখাটো স্কুল বানায়, দাতব্য ক্লিনিক খোলে—যা দেখলে মনে হয়, সমাজসেবা নয়, যেন শাসনের এক নিঃশব্দ পাঠশালা।
এদের উপস্থিতি করুণা দেয়, কিন্তু প্রতিরোধ শেখায় না। শিক্ষার নামে শেখায় আনুগত্য, স্বাস্থ্যসেবার আড়ালে জারি করে নিয়ন্ত্রণ। পুঁজিবাদের যে নির্মম শৃঙ্খল—যা শ্রমকে রক্তচোষা নীতিতে বেঁধে রাখে—তার বিরুদ্ধে একটিও কথা তারা বলে না। উল্টো, এসব দাতব্য আড়ালের নিচে চাপা পড়ে যায় প্রকৃত সামাজিক সংঘর্ষ, শ্রেণি-ভিত্তিক লড়াই, কাঠামোগত শোষণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় বিদ্রোহ।
তাদের রাজনীতি এইখানে এসে থামে—যেখানে মানুষের ক্ষুধা আছে, কিন্তু দ্রোহ নেই; ঘাম আছে, কিন্তু প্রশ্ন নেই।
যে কথা মুখে বলে, কাজে তার ছায়াও পড়ে না। ইসলামপন্থীরা বলে—‘আমরা বিপ্লবের পক্ষে’, অথচ তাদের পদচিহ্ন পড়ে প্রতিক্রিয়ার পথে। তারা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যকে প্রশ্ন তো তোলে না, বরং ধর্মের মোড়কে সেটাকে পবিত্র করে তোলে। নারী-পুরুষের অসমতা, সম্পত্তির অসমবন্টন, বা শ্রমের ওপর মালিকের চাবুক—সবই তারা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, আর ধর্ম দিয়ে মোড়া দেয় যেন সেটাই স্বর্গীয় বিধান।
এই স্বর্গ, আসলে এক সাম্রাজ্যবাদী কারখানা। সেখানে মুসলমান পরিচয়ে পুঁজিবাদের লাভ গোনা হয়, প্রতিবাদের নয়। আইন তারা পাশ করে ঠিক তেমনি, যেমন মিশরে কৃষকের জমি কেড়ে নেবার পক্ষে জমিদারের দালালরা করত। তাদের এই ভূমিকা নতুন নয়। সৌদি আরব থেকে পাকিস্তান—সবখানেই তারা শাসকের পাশে, প্রতিরোধের নয়।
তারা ‘ইম্পেরিয়ালিজমের বিরুদ্ধে’ বুলি ঝাড়ে, কিন্তু গলা থেকে সেই বুলি বেরোয় ওই মুখ দিয়ে, যে মুখে বাণিজ্যের হাসি। ফলে তাদের কথায় থাকে প্রতিশ্রুতি, কাজে থাকে চুক্তি—যার মূল উপজীব্য পুঁজির নিরাপত্তা। তাই, একথা ভুলে গেলে চলে না যে, এই তথাকথিত ইসলামি রাজনীতি শুধু ধর্মের পতাকা নিয়ে চলে না—সে নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখে এক শীতল, ধূর্ত, অদৃশ্য শ্রেণি-চুক্তি। আর সেই চুক্তিতে শ্রমিক, গরিব, নির্যাতিত—এরা কেউই সই দেয় না।
অনেকেই বলেন—বামপন্থীরা যদি রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে একবার বসে কথা বলে, তবে না-কি জনতার একটা বড় অংশকে ছোঁয়া যাবে। ওরা তো হাজারে হাজারে মানুষ টানে, তাই একসঙ্গে চললে কিছু না কিছু তো হবে! কথাটা শুনলে মন টানে বটে। কিন্তু এই কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম প্রতারণা।
এই যে ‘জনসমর্থন’—এটা কিসের জোরে আসে? আদর্শের? নাকি সংগঠিত বাম রাজনীতির ভাঙনের সুযোগে? বাস্তবে বামপন্থী শিবিরের শূন্যতা আর পরস্পরবিরোধী বিভাজনই ইসলামপন্থীদের ভোটব্যাংক বানিয়েছে। ফলে যাদের লক্ষ্যই শ্রেণিহীন সমাজ নয়, বরং ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র’—তাদের সঙ্গে কোনো জোট মানে আত্মঘাতী সমঝোতা।
ইতিহাস একবার চোখ রাঙিয়ে সাবধান করে দিয়ে গেছে। ইরান—যেখানে প্রথমে ইসলামপন্থী আর বামপন্থী একসাথে রাজপথে নেমেছিল, বিপ্লবের গান গেয়েছিল, আবার সেই পথেই একদিন বামপন্থীদের ঝাঁকে ঝাঁকে জেলে ঢুকিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। যারা ভেবেছিল এই ইসলামপন্থীরা হয়তো বামপন্থার ‘তাত্ত্বিক ভাই’—তারা টের পায়নি, ওরা এসেছে আলাদা এক মিশন নিয়ে। সেই মিশনে শ্রেণি সংগ্রাম নেই, আছে ‘বিশেষ আদর্শিক লক্ষ্য’, যেখানে সমাজ পরিবর্তনের দায় কেবল মুখের বুলি, আর বামদের প্রয়োজন কেবল দরজার চাবি হিসেবে।
এখানে জোট নয়—পিছন থেকে ছুরি মারা হয়। যারা বোঝে না, তারা আবারও ভুল করবে। আর যারা বোঝে, তারা হয়তো চুপ করে থাকবে—পাছে আবার পার্টির চামড়ার নিচে রক্ত গড়ায়।
ইসলামভীতি—এই কথাটা এখন শুধুই ভয় নয়, একধরনের অস্ত্র। পশ্চিমা শাসকেরা সেটাকে ব্যবহার করে, ঘষেমেজে ধার দেয়, তারপর ছুঁড়ে মারে। তারা বলে, “ওরা আমাদের মতো নয়”—আর তাতেই গল্প তৈরি হয় ‘সভ্যতা বনাম বর্বরতা’-র, ‘মেয়েদের মুক্তি বনাম ধর্মীয় নিপীড়ন’-এর। অথচ, এই গল্পগুলো আসলে চোখে ধুলা দেওয়ার কৌশল। কারণ এর আড়ালে যে দারিদ্র্য, বৈষম্য, বা সাম্রাজ্যিক লুণ্ঠন—তা আর কেউ দেখে না।
এইখানে খেলাটা হয় দু’দিকেই। পশ্চিম যখন ইসলামকে হিংসার প্রতীক বানায়, তখন ইসলামপন্থীরাও সেই ঘৃণাকে তুলে ধরে ‘অভিজাতদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই’ বলে চালিয়ে দেয়। পশ্চিমের বর্ণবাদ আর ইসলামের প্রতিক্রিয়াশীলতা যেন একে অপরের পিঠ চুলকে চলে। একদিকে জাতিগত বিদ্বেষ, অন্যদিকে ধর্মের নাম করে গোষ্ঠীগত উগ্রতা—এই দুই কণ্ঠে যে কথাগুলো বলা হয়, তার ভাষা আলাদা হলেও অভিসন্ধি একটাই: মানুষকে বিভক্ত রাখো।
এই বিভাজনের ভেতর হারিয়ে যায় সত্যিকারের শত্রু—শ্রমের শোষণ, শিক্ষা ও চিকিৎসার অসমতা, খাদ্য ও বাসস্থানের লড়াই। সাম্রাজ্যবাদ আর রাজনৈতিক ইসলাম—উভয়েই এমন এক নাট্যশালায় দর্শক তৈরি করে, যেখানে বাস্তব বিপ্লবের প্রশ্ন করাও অপরাধ।
ফলে, যে গল্প শুরু হয়েছিল ‘সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ’-এর নামে, তা শেষ হয় সমাজতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করে।
যারা ভাবে—মধ্যপ্রাচ্য মানেই ধর্মের খাঁচা, তারা ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে না। কারণ, একসময় এই অঞ্চল আধুনিকতার স্বপ্ন দেখেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রের প্রগতিশীলতা—এসব নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছে জনতা। কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক, গামাল আবদেল নাসেরের মিশর—এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এক অভিন্ন প্রবাহ, যা ইউরোপের আলোকযুগ আর বলশেভিক বিপ্লবের ছায়ায় নিজস্ব পথ গড়ে তুলছিল।
এই প্রবাহে ছিল যুক্তির জায়গা, ছিল জনগণের ভাষা, ছিল এক ভবিষ্যৎ চিন্তা—যেখানে ধর্ম নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামো ঠিক করত মানুষের অধিকার। অথচ, আজ সেই পথ হারিয়েছে। কেন?
কারণ, ওই যে বিশ্বশক্তির চোখ—সেটা কোনোদিন এই অঞ্চলের প্রগতিকে ভয় না পেয়ে পারেনি। বারবার সাম্রাজ্যবাদ এসে হাতে হাত মিলিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে। কোথাও তারা মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে, কোথাও তেল-সমৃদ্ধ রাজতন্ত্রদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা জানত, মুক্তচিন্তা থাকলে শোষণের মেশিনে জং ধরবে।
আজ যারা দেখে, শুধু হিজাব আর মিনার, তারা ভুলে যায়—এই অঞ্চল একদিন কণ্ঠ উঁচু করে বলেছিল, ‘আমরাও আধুনিকতার অধিকার চাই।’ তাই ইসলামপন্থী রাজনীতির এই উত্থান কোনো স্বাভাবিক বা অনিবার্য পথ নয়—এ এক নির্মম কৌশল, ইতিহাসকে কেটেছেঁটে নতুন রঙে রাঙানোর ষড়যন্ত্র।
এটা ভুলে গেলে চলে না—ধ্বংস আর বিভ্রান্তির নিচেও একসময় আলো জ্বলেছিল। আর সেই আলো, আজও নিভে যায়নি—শুধু তাকে চাপা দেওয়া হয়েছে, মাটি চাপা বিদ্যুতের তারের মতো।
রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানকে যদি কেবল ধর্মীয় পুনর্জাগরণ বলে ভাবি, তবে ভুল করব। এর উৎস অনেক গভীরে, এবং অনেক দূরের হাতে বাঁধা। এই উত্থানের পিছনে রয়েছে এক সুপরিকল্পিত বাহ্যিক হস্তক্ষেপ—বিশেষত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের চতুর কৌশল।
মুসলিম ব্রাদারহুড—যাকে আজ ধর্মীয় রাজনীতির পুরোধা বলে ধরা হয়—তার জন্ম ও বিকাশে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কারণ, সেই সময় মিশরের মতো দেশে জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন উঠছিল মাথা তুলে, যারা বিদেশি কর্তৃত্ব আর সাম্রাজ্যিক শোষণের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছিল। সেখানেই ইসলামের নাম করে এক প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে দাঁড় করানো হয়েছিল—যাতে জাতির শক্তি বিভক্ত হয়, প্রতিবাদের ধার ভোঁতা হয়ে পড়ে।
এই ছক শুধু মিশরেই না—আফগানিস্তানে তো আরও নগ্নভাবে দেখা গেছে। যেখানে আমেরিকার সিআইএ সরাসরি তহবিল দিয়েছে তালিবানদের, শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। আধুনিকতা, নারীর শিক্ষা, ভূমি সংস্কার—এসবকেই তারা ‘কমিউনিস্ট বিপদ’ হিসেবে দেখেছিল, আর সেই বিপদের বিরুদ্ধে ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীলতাকেই বানিয়েছিল অস্ত্র।
এই ইতিহাস বলে দেয়, রাজনৈতিক ইসলাম আসলে আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জাগরণ নয়, বরং এক চতুর রাজনৈতিক নির্মাণ। একে রচনা করেছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী, যাদের একমাত্র লক্ষ্য—তেল, গ্যাস, ভূ-রাজনৈতিক দখল। তাই ধর্ম এখানে কেবল মোড়ক, যার নিচে লুকিয়ে আছে আগ্রাসনের প্রকৃত মানচিত্র।
এই নির্মাণের ভিতর, সত্যিকারের ‘আত্মপরিচয়’ নেই—আছে এক সুপরিকল্পিত শূন্যতা, যেখানে প্রতিবাদ গুম হয়ে যায়, আর শাসনের হাত আরও লম্বা হয়।
ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের মতো দেশ—প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ—সেগুলোর কপালে স্বাধীনতার চেয়েও বেশি জুটেছে পরীক্ষাগারের তকমা। এখানে মানুষের জীবন নয়, বরং পরীক্ষা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের কৌশল। কীভাবে একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রকে গুঁড়িয়ে দিয়ে, সংস্কৃতি ও সমাজকে ভেঙেচুরে, তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় আধিপত্যের নতুন কাঠামো—এই ছিল সেই গবেষণার বিষয়বস্তু।
ইরাক—যেখানে বাথ পার্টির ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ একসময় সাম্রাজ্যিক শোষণের চোখে ছিল হুমকি। কারণ তারা নিজের তেল নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, এবং ধর্মের বদলে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলেছিল যুক্তিবাদ দিয়ে। এই সবই ছিল অপরাধ—পশ্চিমের চোখে। তাই আগ্রাসন এল—বোমা, ব্ল্যাকওয়াটার, গুইন্টানামো। একদিকে রাষ্ট্র ভাঙল, অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রতার উর্বর জমি তৈরি হল। আর যাদের ধর্মীয় উত্থান বলা হয়, তা জন্ম নিল ধ্বংসস্তূপের নিচে, সাম্রাজ্যবাদের হালকা পায়ে হেঁটে যাওয়া পথ ধরে।
আফগানিস্তানেও একই খেলা। কমিউনিস্ট সরকার কিছুদিনের জন্য নারীদের স্কুলে পাঠানো শুরু করেছিল, জমির ওপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেটাও চলতে দেওয়া গেল না। সিআইএ টাকা ঢালল, গুলি দিল, বন্দুক হাতে তুলে দিল তালিবানদের। উদ্দেশ্য একটাই—‘শীতল যুদ্ধ’-এর গরম বাজারে এক সমাজতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে জন্মাবার আগেই গলা টিপে হত্যা করা।
এই দুই দেশের ট্র্যাজেডি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কাছে ‘স্থিতি’ বা ‘শান্তি’ কোনো লক্ষ্য নয়। তাদের একমাত্র অভিলাষ—সম্পদ নিয়ন্ত্রণ। মানুষের জীবন, সভ্যতা, বা একটি সমাজের ইতিহাস—সবই তুচ্ছ, যদি সেখান থেকে কয়েক ব্যারেল তেল তোলা যায়, কিংবা এক ফালি মাটিতে সামরিক ঘাঁটি বানানো যায়।
এখন প্রশ্ন একটাই—এতসব ছলনার, বিভ্রান্তির, দখলের খেলা পেরিয়ে ভবিষ্যৎ কীভাবে গড়া যাবে? রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের এই গোপন আঁতাত একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যদি সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা আর অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার চায়, তবে তাকে ধর্মের মোড়কে সাজানো সাংস্কৃতিক রেটোরিক ছেড়ে বাস্তব সংগ্রামের দিকে ফিরতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্য আজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে জর্জরিত—এটা সত্য। কিন্তু সেই সত্য কোনো স্থায়ী নিয়তি নয়। এক সময় এই ভূখণ্ডে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল সংগ্রামের অংশ, জনগণের কণ্ঠে শোনা যেত প্রগতির ভাষা। সেসব স্মৃতি এখন ধূসর হয়ে গেলেও, তা একেবারে মুছে যায়নি।
এখন যা দরকার, তা হল এক তৃণমূল পুনর্জাগরণ—যেখানে মানুষ জড়ো হবে ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং জীবনের দাবি নিয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জমির অধিকার, শ্রমের ন্যায্য মজুরি—এই সব প্রশ্ন নিয়ে যদি আন্দোলন গড়ে ওঠে, তবে তবেই ভাঙবে সাম্রাজ্যবাদের কল্পিত গল্প, নড়বে ইসলামী প্রতিক্রিয়াশীলতার খাঁচা।
এই সংগ্রামে নতুন করে ফিরে আসতে পারে সেই আধুনিকতার চেতনা—যেটা যুক্তি আর ন্যায়ের ওপর দাঁড়িয়ে, ধর্মীয় শাসনের বদলে নাগরিক অধিকারকে সামনে আনে। এবং সেই চেতনার ভেতর দিয়েই মধ্যপ্রাচ্য আবার নিজের ভূমিকা নতুন করে ভাবতে পারবে—বিশ্বরাজনীতির মানচিত্রে সে যেন আর কেবল সম্পদের ভাণ্ডার নয়, বরং স্বাধীন ভাবনার এক উর্বর ভূমি
লেনিন: আগুনের খসড়া ও বিপ্লবের মুদ্রণযন্ত্র
লেনিন নামটা আজকাল মুখে আনার আগে অনেকেই গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে নেন। কেউ বলেন, “ভাই, এখন তো পোস্টমডার্ন যুগ,” কেউ বলেন, “বেশি লেনিন পড়লে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষায় ফেল,” আর কেউ সরাসরি বলেন, “সোভিয়েত তো ফেইল করেছে, তাই না?” কিন্তু যাঁরা এভাবে বলেন, তাঁরা বোধহয় জানেন না, লেনিন কোনো জাতীয় পতাকা না, উনি একটা অদৃশ্য বুনন—যে কাঠামো দিয়ে আমরা রাষ্ট্র ভাবি, …