পড়ার স্তর
মানুষের জন্মের পরই তার শেখার প্রথম ধাপ শুরু হয় কান্নার মাধ্যমে। কান্না, চিৎকার, হাত-পা ছোড়া— এগুলো হলো ভাষার আদিমতম রূপ।
মানুষের জন্মের পরই তার শেখার প্রথম ধাপ শুরু হয় কান্নার মাধ্যমে। কান্না, চিৎকার, হাত-পা ছোড়া— এগুলো হলো ভাষার আদিমতম রূপ। তারপর আসে বর্ণমালা শেখা, শব্দ বোঝা, বাক্য গঠন, এবং শেষমেশ কিছু একটা পড়ে তার মানে বুঝতে পারা। এটাকেই বলে এলিমেন্টারি রিডিং, অর্থাৎ পঠন-সংস্কৃতির সেই বিন্দু যেখানে দাঁড়িয়ে সবাই ভাবে— ব্যস, আর কিছু লাগবে না, আমি পড়ে ফেলতে পারি! কিন্তু সত্যিটা হলো, এই স্তরটায় থেমে গেলে আপনি প্যাকেটের গায়ে লেখা ‘১০% বেশি’ অফার বুঝতে পারবেন, কিন্তু ভেতরে কতটা ঠগবাজি আছে তা ধরতে পারবেন না।
প্রযুক্তির যুগে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে দিনে ২০০টা নোটিফিকেশন ছুড়ে দেয়, সেখানে গোটা একটা বই পড়া মানে যেন অ্যালপাইন পর্বতের চূড়ায় উঠে কপালে তিলক পরানোর চেষ্টা করা। তাই এই প্রথম স্তরেই যদি কেউ থেমে যায়, তবে সে খবরের শিরোনাম দেখে মতামত দেওয়া মানুষদের দলে পড়ে যাবে— যারা ‘কেন এত মুরগি মরছে?’ বলার আগেই, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ!’ ঘোষণা করে ফেলে।
বইয়ের গন্ধ নিন, বিষের নয়!
এরপর আসে ‘Inspectional Reading’— যা মূলত বইয়ের সঙ্গে প্রথম ডেটিংয়ের মতো। পুরো বই পড়ে সময় নষ্ট করার আগে বোঝার চেষ্টা, ‘এটা আদৌ আমার টাইপের কিনা?’ কভার দেখুন, সূচিপত্র উল্টে দেখুন, শুরু আর শেষের কয়েক পাতা চোখ বোলান। বুঝতে হবে, এটা কি সত্যি একটা প্রয়োজনীয় বই, নাকি আরেকটা ‘কীভাবে কোটিপতি হবেন’ গোছের পুরনো ওয়াইন, নতুন বোতলে?
এই পাঠ কৌশলের প্রধান কাজ হলো সময় বাঁচানো। সারা দুনিয়ায় কোটি কোটি বই ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে কোনগুলো পড়বেন? কাজেই এই পর্যায় না থাকলে, ‘পড়ে ফেলি’ অ্যাপ্রোচে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাবে, ঠিক যেমন কেউ ‘মুভি দেখা মানেই ভালো সিনেমা’ ধরে নিয়ে ‘গোবর-গাথা পার্ট ৪’ দেখতে বসে যায়।
কথার ভেতর লুকোনো পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো
পাঠের তৃতীয় স্তর, বিশ্লেষণধর্মী পাঠ (Analytical Reading) হলো এমন এক জায়গা, যেখানে আপনি শুধু লেখকের বক্তব্যই পড়েন না, বরং সেটা কতটা সঠিক, কতটা ভুল, কতটা পক্ষপাতদুষ্ট— তা যাচাই করেন। ধরুন, একটা বই বলছে, ‘সমাজের সব সমস্যা শুধুমাত্র ফরাসি দার্শনিকদের উদ্ধৃতি দিয়েই সমাধান সম্ভব।’ এক্ষেত্রে আপনাকে ভাবতে হবে— সত্যিই কি তাই? নাকি লেখক শুধু নিজেকে স্মার্ট প্রমাণের জন্য দার্শনিকদের নাম সাজিয়েছেন? এখানে আপনাকে টেক্সটের মধ্যে ঢুকে ‘এই লাইনটা এখানে কেন?’ ‘এই যুক্তিটা কি সঠিক?’— এসব প্রশ্ন করতে হবে।
এই স্তরে না উঠলে পাঠক হয়ে উঠবেন সেই অফিসের চাচা, যিনি শুধু ‘দেখেছো, বইয়ে লেখা আছে!’ বলেই সব তর্ক শেষ করতে চান।
একটাই বইয়ে জীবন বোঝা যায় না!
সর্বোচ্চ স্তর হলো Syntopical Reading, যেখানে পাঠক একাধিক বইকে পাশাপাশি রেখে বিচার করে। এটা হল গবেষক-ধাঁচের পাঠ। এই স্তরে আপনি আর একক কোনো বইয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকেন না, বরং বিভিন্ন লেখকের মতামত পাশাপাশি রেখে নিজের একটা গভীর উপলব্ধি গড়ে তুলতে পারেন। একটা উদাহরণ দিই— ধরুন, আপনি জানতে চান, ‘কেন মানুষ যুদ্ধ করে?’ এক্ষেত্রে কেবল একটা বই পড়লে, সেটা আপনাকে হয়তো বলবে, ‘সাম্রাজ্যবাদী লোভ যুদ্ধের কারণ।’ কিন্তু যখন আপনি ভিন্নমতাবলম্বী আরও পাঁচটা বই পড়বেন, তখন হয়তো দেখবেন, যুদ্ধের পিছনে মনস্তত্ত্ব, অর্থনীতি, ভৌগোলিক বাস্তবতা— অনেক কিছু কাজ করে। এখানেই পাঠকের পরিপূর্ণ বিবর্তন।
এটি সেই স্তর, যেখানে পাঠক পরিণত হন জ্ঞানতৃষ্ণু গবেষক হিসেবে, ঠিক যেমন কেউ একদিন শুধু চায়ের দোকানে আড্ডা না মেরে দার্শনিকের চায়ের কাপে ঝড় তুলতে চান।
বই পড়ার শ্রেণিবিভাগ শুধু বইয়ের জন্য নয়!
এই চার স্তরের পাঠ শুধু বইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, এটা জীবনের সব ক্ষেত্রে কাজে লাগে। সংবাদ পড়া থেকে শুরু করে কারও বলা কথার সত্যতা যাচাই, অফিসের ইমেল বোঝা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদদের ভাষণের মধ্যে থাকা ফাঁকি ধরে ফেলা— সবক্ষেত্রে এটা আপনাকে শানিত করবে।
যারা এলিমেন্টারি স্তরেই আটকে থাকবে, তারা চিরকাল ক্লিকবাইট আর গুজবের বলি হবে। যারা ইনস্পেকশনাল স্তরে পৌঁছাবে, তারা অন্তত সময় নষ্ট না করার কৌশল শিখবে। যারা বিশ্লেষণধর্মী পাঠ রপ্ত করবে, তারা মতামত দিতে পারবে যুক্তির সঙ্গে। আর যারা সিঙ্ক্রেটিক স্তরে উঠতে পারবে, তারা ইতিহাসের ধূলিঝড়ে হারাবে না, বরং নিজের ভাবনা দিয়ে নতুন চিন্তার পথ দেখাবে।
— আপনি কোন স্তরে আছেন? আর যদি পড়া না হয়, তাহলে সব জেনে কী লাভ, যদি মাথায় ধরার আগেই টিকটক স্ক্রোল করে চলেন?
একেকটা বইকে হাতিয়ার করে লড়ো
বই আমার জন্য শুধু আশ্রয় নয়, পথপ্রদর্শকও। সমস্যা যখন পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়, তখন ভিক্টর ফ্র্যাংকেলের “Man’s Search for Meaning” পড়া যেন জরুরি ওষুধ হয়ে ওঠে। এক রাতে, জানলার কাচে বৃষ্টি পড়ার ছন্দ শুনতে শুনতে এক বাক্যের দেখা পেলাম— "জলে পড়ে গেলে মানুষ ডোবে না, ডোবে সে তখনই, যখন সে সেখানেই থেকে যায়।" কথাটা শুনে মনে হলো, হেমিংওয়ের