পাসওয়ার্ড: এক একলা মেয়ের এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন
গল্পের ভিতর লুকিয়ে থাকা বিদ্রুপ, আত্মনির্ভরশীলতার প্রতি গল্পকারের আস্থা, এবং চরিত্রের দৃঢ়তা—এসব মিলিয়ে ‘পাসওয়ার্ড’ এই সংকলনের সেই গান, যা বারবার বাজানো যায়, যা পড়তে পড়তে পুরনো হয় না
কেন জানি না, কিছু মানুষ ধরে নিয়েছে আমি প্রচণ্ড পড়ুয়া। এতটাই যে, পৃথিবীর সব বই-ই নাকি আমার টেবিলের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে। তারা আমার মতামত চায়, আমাকে পাঠায় বই, যেন আমি ‘ফতোয়া’ দেব—লেখাটা ঠিক না ভুল, ভালো না মন্দ! অথচ আমি কি বিচারক? লেখার কোনো ‘ঠিক’ বা ‘ভুল’ নেই, ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ও আপেক্ষিক বিষয়। প্রতিটি লেখা নিজস্ব, একেকটা যন্ত্রণার স্বর, কিছু না বলা কথার কৌশলী প্রকাশ। তাই আমি যাদের বেশি ভালোবাসি, তারা আমাকে যখন বই পাঠায়, তখন সেটা রিভিউয়ের জন্য নয়—ওরা চায় কেউ সেটা পড়ুক, অনুভব করুক। সেই অনুভূতির ভার আমি নিই, কিন্তু তার ব্যাখ্যা চাই না।
আমরা দেখছি সেই লেখকেরা, যাঁদের একসময়ে বিদ্রোহী বলে ধরা হতো, তাঁরা এখন একেকজন কঠিন গেটকিপার! সাহিত্যিক মহলের মোঘল সম্রাট! নতুন লেখকরা যেন মুঘল দরবারে আসা কোন আকবরের সভার বীণাবাদক, যাঁদের অস্তিত্ব স্বীকৃতি পেতে হলে আগে দরবারি মেজাজে সালাম ঠুকতে হবে।
বস্তুত, বাঙালি সাহিত্যিক মহলে এরকম ঘটনা নতুন কিছু নয়। সমরেশ বসু তো বলেই ফেলেছিলেন, কজন প্রবীণ লেখক নতুনদের লেখা না পড়ে একেবারে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেন। পশ্চিমে ব্যাপারটা আরও সরস। ভি.এস. নাইপল আধুনিক সাহিত্যের দিকে এমন একটা মুখভঙ্গি করতেন, যেন আধুনিক লেখকেরা মূলত বিছানার নিচে পুড়ে যাওয়া পান্ডুলিপির স্তূপ। এই যে প্রবীণদের রাগি অবজ্ঞা, এর মধ্যে এক আশ্চর্য ট্র্যাজিক ফাঁদ লুকিয়ে আছে—এঁরাই তো একসময় বিদ্রোহী ছিলেন! আজ তাঁরা বিদ্রোহ দমন করছেন!
বিদেশি ভাষায় এটাকে বলে Intellectual Insularity, এইসব মানসিক কৃশতা থেকে সাহিত্যকে বাঁচাতে হলে একটা সহজ কাজ করা যেতে পারে—পড়তে হবে! শুধুমাত্র নিজের লেখা গিললেই হবে না, নতুনদের পড়তে হবে, বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, যে লেখক পড়তে জানে না, সে লেখার ক্ষমতাও হারায়। যে লেখক শুধু নিজের গণ্ডির মধ্যেই থেকে যায়, সে একসময় নিজেরই লেখা নিয়ে একঘেয়ে বিরক্তিতে ভুগতে শুরু করে, অথচ সেটা বুঝতে পারে না। নিজের তৈরি হাতকড়া কেউ নিজেই খুলতে পারে না, যদি না নতুন লেখা তার কাছে চাবির কাজ করে।
সাহিত্যকে জীবিত রাখতে হলে দরকার সেই অক্সিজেন—যা নতুন লেখকরা এনে দেন। সাহিত্যের ইতিহাসে একেকটা যুগের সমাপ্তির পর দেখা যায়, পুরনো কেল্লার অভ্যন্তরে বসে থাকা রাজাদের হাতেই পতনের ঘন্টা বাজছিল। তাই নিজের সাম্রাজ্যটাকে আঁকড়ে না ধরে, দরজা খুলুন, নতুন লেখকদের কথা শুনুন, তাঁদের পড়ুন।
অনেক হলো তর্ক-বিতর্কের চর্বিত চর্বণ। এবার আসল কথায় আসা যাক—গীতা দাসের ছোটগল্প সংকলন ‘গৃহপালিত স্বামী’ নিয়ে কিছু বলা দরকার।
ছোটগল্প সংকলন হচ্ছে অনেকটা পুরোনো দিনের গানের ক্যাসেটের মতো। সব গান যে সমান মনে ধরে, তা নয়। কিছু গান শুনে মাথার মধ্যে আর ফিরে তাকানোর ইচ্ছেই হয় না, আবার দু’-একটা এমন থাকে, যা একবার শুনলেই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে দিনের পর দিন। পাড়ার ভ্যানে বাজানো পুরোনো বাংলা সিনেমার গানের মতো, যা বাজতে বাজতে একসময় এতটাই চেনা হয়ে যায় যে, বিরক্ত হলেও মুখে মুখে গাইতে বাধ্য। ঠিক সেরকমই, এই ‘গৃহপালিত স্বামী’ সংকলনের মধ্যে এমন কিছু গল্প আছে, যেগুলো হয়তো পড়ে এক চোখ বুজে চলে যাবেন, আবার কিছু গল্প এমন আছে, যা মাথার মধ্যে পেরেকের মতো গেঁথে থাকবে।
এমনই এক গল্প হলো ‘পাসওয়ার্ড’।
এই গল্পটি পড়ে কিছু না বলে থাকা কঠিন। একদিকে আধুনিক জীবনের ডিজিটাল নিরাপত্তার আবরণ, অন্যদিকে সমাজের অদৃশ্য শিকল—এই দুইয়ের সংঘাতে প্রথমা নামক চরিত্রটি একা দাঁড়িয়ে আছে। গোপনীয়তা, স্বাধীনতা, এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ নিয়ে এই গল্প আমাদের এক অদ্ভুত অথচ চেনা বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
প্রথমা নামক চরিত্রটি শুধু একটা নাম নয়, এক ধরনের প্রতিবাদ। সে যেন আধুনিক জীবনের এক ‘লগইন স্ক্রিন’, যেখানে একের পর এক পাসওয়ার্ড বসানো আছে, অথচ ‘এন্টার’ চাপলেই কাজ হয় না! ‘পাসওয়ার্ড’ গল্পটি এক ধাক্কায় আমাদের সামনে নিয়ে আসে এক চূড়ান্ত আত্মনির্ভর নারীর গল্প, যে পুরুষতন্ত্রের চাপে পড়ে আপস করতে শেখেনি, বরং শিখেছে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের সিদ্ধান্তের ‘ওটিপি’ নিজেই জোগাড় করতে।
গীতা দাস তাঁর লেখায় আশ্চর্যভাবে আধুনিক প্রযুক্তির গোঁড়ামি আর সামাজিক অনুশাসনের মিলমিশ ঘটিয়েছেন। আমাদের চারপাশে কত কিছুর জন্য পাসওয়ার্ড চাই: অফিস, ব্যাঙ্ক, সোশ্যাল মিডিয়া—এমনকি হৃদয়ও আজকাল ‘টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন’ ছাড়া খোলে না! অথচ এই আধুনিকতার মধ্যেই প্রথমার দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত আমাদের প্রথাগত ‘সিস্টেম’-এর বিপরীতে দাঁড় করায়। বিয়ে? নাহ! সন্তানের পরিচয়ের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনুমোদন? নাহ! সে নিজের মতো চলবে, নিজের মতো থাকবে, আর নিজের পরিচয়েই তার অনাগত সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখবে।
গল্পের ভাষা সরল, কিন্তু ভাবনার গভীরতা অনেকখানি। একা থাকার সিদ্ধান্ত, আপস না করার দৃঢ়তা, পুরুষসঙ্গী ছাড়াই মাতৃত্বের পথ বেছে নেওয়া—এসবই এতদিন সমাজে ‘নিষিদ্ধ ফোল্ডারে’ রাখা হতো। প্রথমা যেন সেই নিষিদ্ধ ফোল্ডার ‘ডিক্রিপ্ট’ করতে চায়, নতুন পাসওয়ার্ড বসিয়ে। তরু নামক চরিত্রটি প্রথমার জীবনে ‘রিমাইন্ডার ইমেইল’-এর মতো আসে—বারবার মনে করিয়ে দেয়, ‘তুমি সমাজের নিয়ম ভাঙলে লোকে কী বলবে?’ কিন্তু প্রথমা ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে—সিস্টেম আপগ্রেড হয়ে গেছে, পুরনো ‘কনভেনশনাল লাইফস্টাইল’-এর পাসওয়ার্ড আর এখানে কাজ করবে না।
গীতা দাস গল্পের শেষে প্রথমার সিদ্ধান্তকে এমনভাবে চিত্রিত করেছেন, যা একেবারে অনিবার্য মনে হয়। সমাজের চোখে সে ‘ব্যতিক্রম’, কিন্তু নিজের চোখে? সে সম্পূর্ণ, সে স্বাধীন। এ গল্প পড়ে মনে হয়, হয়তো একদিন এমন সময় আসবে, যখন সমাজ ‘নারী স্বাধীনতা’কে আর ‘বিকল্প’ হিসাবে দেখবে না, বরং এটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেবে। প্রথমা ততদিন পর্যন্ত নিজেই নিজের পাসওয়ার্ড হয়ে থাকবে—যার ডিকোডিং ক্ষমতা শুধু তারই আছে!
গল্পের ভিতর লুকিয়ে থাকা বিদ্রুপ, আত্মনির্ভরশীলতার প্রতি গল্পকারের আস্থা, এবং চরিত্রের দৃঢ়তা—এসব মিলিয়ে ‘পাসওয়ার্ড’ এই সংকলনের সেই গান, যা বারবার বাজানো যায়, যা পড়তে পড়তে পুরনো হয় না, বরং নতুন মাত্রা যোগ করে। সমাজের কড়া শৃঙ্খলে এক চাবির ঘূর্ণন—যা হয়তো একদিন তালা খুলবেই।
আরেকটি গল্পের কথা না বললে অন্যায় করা হবে। গীতা দাসের পোঁচ গল্পটা পড়ে মনে হলো, বাংলা সাহিত্যের ডিকশনারিতে যদি ‘কাঁচা বাস্তব’ বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেটার পাশে এই গল্পটাকে রেখে দেওয়া উচিত। না, এই গল্প পড়ে মন ভালো হয়ে যাবে না, আপনার বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে। যেন গল্প নয়, আপনার চারপাশের কোনো একটা বাড়ির দাওয়ায় বসে কেউ মুখ ফুটে বলে ফেলল তার জীবনের চিরন্তন যন্ত্রণা। এক অন্ধকার জীবন, যেখানে মোবাইল চার্জ হওয়ার থেকেও জরুরি ‘কার টাকা দিয়ে চার্জ হবে’ এই প্রশ্নের উত্তর।
আসলে, পোঁচ গল্পটা একটা নিখুঁত ‘ইন্টেরিয়র শট’। যেন জীবনের এক ক্লোজ-আপ ফ্রেম, যেখানে রোদ্দুর অতটা ঢোকে না, কিন্তু দরিদ্রতার রোদ্দুর-তেতে থাকা বাতাস সর্বক্ষণ চরাচর দখল করে আছে। গল্পের প্রতিটি লাইন যেন আমাদের মনের একটা চাপা জায়গায় গিয়ে ধাক্কা মারে। লেখক কোনো ন্যারেটিভ জোর করে গুঁজে দেননি, এমনকি দারিদ্র্যের প্রতি সহানুভূতি জাগানোর চেষ্টা করেও গল্পটাকে সস্তা বানাননি। গল্পটা নিজেই নিজেকে ধারণ করেছে।
ফিতা চরিত্রটা ঠিক যেন আমাদের চারপাশের অসংখ্য মেয়েদের প্রতিচ্ছবি—সে শুধু ‘চুপ করে থাকাই’ শিখেছে। নিজের সংসারের অন্ধকার, স্বামীর উদাসীনতা, শ্বশুরবাড়ির নিপীড়ন—সবকিছু তাকে নিরবতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। গল্পের একটা দুর্দান্ত ব্যাপার হলো, কোথাও একটা দার্শনিকতা নেই, কোথাও অতিনাটকীয় অনুভূতি নেই, অথচ প্রতিটি সংলাপে বোঝা যায়, ফিতার পৃথিবীটা কেমন। মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেলে যেমন সে মায়ের সাথেও কথা বলতে পারে না, তেমনি তার নিজের জীবন থেকেও সমস্ত বিদ্যুৎ নিভে গেছে।
বৈঠা চরিত্রটা এতটাই চেনা যে, তাকে যেন রোজ বাজারে, ট্রেনে, বাসে দেখি। তার সংসার চালানোর সংজ্ঞা হলো টাকা উপার্জন করা, বউকে শাসন করা, আর মায়ের কথাকে শেষ কথা বলে মেনে নেওয়া। সে প্রেম বোঝে না, বোঝে কর্তৃত্ব। গল্পের চমৎকার জায়গা হলো, বৈঠার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে করতে গীতা দাস আমাদের একটা আয়না ধরিয়ে দেন—দেখিয়ে দেন, সমাজের বেশিরভাগ পুরুষের মনের কোণে বৈঠার মতো একজন বাস করে।
এই গল্পের সবচেয়ে বড় সিম্বল—একটা মোবাইল ফোন। একটা নস্টালজিয়া, একটা নিঃসঙ্গতার পরিমাপ। মোবাইল শুধু ফোন নয়, এই গল্পে এটা একটা বেঁচে থাকার অবলম্বন। ফিতার কাছে মোবাইলের গুরুত্ব তার সংসারের চেয়ে বেশি। কারণ এই মোবাইলই তাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়, তাকে শোনার সুযোগ দেয়, তাকে অস্তিত্ব দেয়। বৈঠা যেদিন মোবাইলটা হারিয়ে ফেলে, তার মনে কেমন একটা ভয় ঢোকে। কারণ মোবাইল শুধু একটা বস্তু নয়, এটা তার বউয়ের একমাত্র পালানোর রাস্তা, তার শিকল ছেঁড়ার চাবি।
গল্পের শেষ দারুণ। গল্প শেষ হয়, কিন্তু একটা ধাক্কা দিয়ে যায়। বৈঠার গলায় শিমলতার পোঁচ লাগার মতো, তার ভেতরেও একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়। মোবাইল হারিয়ে ফেলার পর তার মধ্যে একটা ভয় ঢোকে, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, ফিতার মনের যে ক্ষত, সেটার কথা বোঝার কোনো যোগ্যতাই বৈঠার নেই। তার কাছে সবই বাইরের ক্ষত, কিন্তু ফিতার দগদগে ক্ষতগুলো দৃষ্টির বাইরে।
গীতা দাস এই গল্পে একটিও ফাঁকা বুলি রাখেননি। কোথাও বড় কোনো তত্ত্ব নেই, নেই কোনো ফালতু আবেগের বাড়াবাড়ি। আছে নিখুঁত জীবন। পোঁচ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভালো সাহিত্য মানেই বিশাল ক্যানভাস নয়, ভালো সাহিত্য হলো এমন গল্প, যা আমাদের মনের সেইসব চাপা অনুভূতিগুলোকে তুলে আনে, যেগুলো আমরা এতদিন বুঝতে পারিনি, অথচ প্রতিদিন বয়ে বেড়াই।
এই গল্প আসলে প্রতিদিনের জীবনের শিমলতার আঁচড়ের মতো—যা চট করে শুকিয়ে যায় না, থেকে যায় দীর্ঘদিন, চুলকায়, মনে করিয়ে দেয় আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। "পোঁচ" নিছকই এক নারীর গল্প নয়, এটা একটা গোটা সমাজের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সংসার, আমাদের টানাপোড়েন, আমাদের নিঃশব্দ প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি। এই ধরনের লেখা বাংলা সাহিত্যের দরকার, যেটা কাঁদায় না, বরং গায়ে মৃদু একটা আঁচড় কাটে—যাতে চুলকোতে চুলকোতে আমরা বুঝতে পারি, এটা বেঁচে থাকার চিহ্ন।