ব্ল্যাক ডিজাইন
প্রথম পাতাতেই একটা লাইন—‘To be Black is to be misread by design.’ আমি চট করে চা নামিয়ে বইয়ের পাশে দাঁড়ালাম।
আমার পাড়ায় একটা ছেলে থাকে। নাম অ্যালফনসো উইলিয়ামস। শুনে মনে হতে পারে, সে বোধহয় লোকে ফরাসি উচ্চারণে বলে—“আ-লঁ-ফঁ-সো”—কিন্তু না। সে নিজের নাম উচ্চারণ করে অ্যামেরিকান অ্যাকসেন্টে, তবু নামটা শুনলে যেন মনে হয়, কালেভদ্রে সে ল্যাটিন কবিতাও মুখস্থ করতে পারে। সদ্য কলেজ পেরোনো, এখনও মাথার ভেতরে শেষ সেমিস্টারের চিন্তা বুদবুদিয়ে উঠছে, আর গায়ে একটা হালকা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটের অহংকার লেগে আছে, যেটা ট্রেনের টিকিট চেকারের থেকে এক ডিগ্রি বেশি, দু’ডিগ্রি কম।
সেদিন সন্ধেবেলা সে এসে হাজির। হাতে একটা বই। An Anthology of Blackness—নামে যতটা থিসিস, প্রচ্ছদে ততটাই জিরো-ওয়াট বাতির মতো কালো। একদম সেরকম কালো, যা দেখতে দেখতে আপনি নিজের রিফ্লেকশন খুঁজে পান না—বরং খুঁজে পান ইতিহাস, উপনিবেশ, আফ্রো-ফিউচারিজ়ম, আর মাঝে মাঝে নিজের অজ্ঞানতার শোকসংগীত।
বলল, “Thought this might be your kind of weird.”
মানে, পাড়ার পুঁচকেরাও জানে পেত্নীদের মত আমি সব রকম অদ্ভুত বই পড়ি—যেমন ‘স্যাডোম্যাসোচিস্টিক পুরাণে বাঙালি কিশোর’। সুতরাং অ্যালফনসোর ওই মন্তব্য ছিল আসলে একরকম ‘literary flirtation’। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম—আমার Hug-টাও এমন, যা ফ্রয়েডের মতাদর্শে পড়ে না।
তারপর বইটা খুললাম।
প্রথম পাতাতেই একটা লাইন—‘To be Black is to be misread by design.’ আমি চট করে চা নামিয়ে বইয়ের পাশে দাঁড়ালাম। কারণ কিছু বই পড়া যায় বসে, কিছু বই পড়া দরকার দাঁড়িয়ে, আর কিছু বইকে পড়তে গেলে প্রথমে নিজের অবস্থান পাল্টাতে হয়—বর্ণ, ভাষা, রাষ্ট্র, ফেসবুক—সব কিছুর।
প্রত্যেকটি প্রবন্ধ যেন কে যেন ফিসফিস করে বলে চলেছে, “তুইও তো একবার ভুল বুঝেছিলি নিজেকে, না?”
এই Anthology আসলে বই নয়—একটা ব্ল্যাক হোল, যেটা আলো নয়, আত্মজিজ্ঞাসা টেনে নেয়। এবং অ্যালফনসো যখন এই বইটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল, সে আসলে নিজের newly discovered cultural algorithm-টা শেয়ার করল। জানিয়ে দিল, এখন সে শুধু গান শোনে না, শব্দ বোঝে। কেবল Netflix দেখে না, Narratives খোঁজে।
অ্যালফনসো বোঝে গেছে, যে সাদা পাতার মধ্যেও কালো ব্যথা থাকে। এবং বইটা দিয়ে সে আমায় সেই ব্যথায় পার্টনার বানাল।
আমিও বুঝে গেলাম, এটা একরকম পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন। যার সার্টিফিকেট আসে না। কিন্তু চিন্তার ডিপ্লোমা মেলে। ওহ বাই দ্য ওয়ে বইটিতে অ্যালফনসোরও একটি লেখা চ্যাপ্টে রয়েছে।
‘Black Design’ মানে কী?
ধরা যাক, আপনি একটা সোফা ডিজাইন করছেন। লাল হবে না নীল হবে, গদি নরম হবে না স্পঞ্জি, এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আপনার মাথায় যে চিন্তার বিস্ফোরণ, সেটাই তো ডিজাইন। অর্থাৎ, আগে কিছু ছিল না—তারপর কিছু হলো—তারপর সেটা কেউ এসে বললো ‘ইউনিসেক্স’। এখন যদি সেই ‘কিছু’টার গায়ে আপনি "Black" শব্দটা আটকে দেন, ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র ফ্যাব্রিক বা ফর্ম নয়—আপনি একটা অস্তিত্বকে রঙ দিচ্ছেন। রঙ বললাম, মানে রঙ না—একটা ইতিহাস, একটুও বিজ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ঘাড়ের ওপর বংশানুক্রমিক ওজন, এক থোকা বেদনা আর একগাদা ‘ওরে তুই তো আলাদা’ টাইপ সমাজবদ্ধ সংকেত।
যেটা ভয়ঙ্কর তা হলো, এই "Black"-টা কেউ বানিয়েছে। আর বানিয়েছে এমনভাবে, যেন এটা জন্মসূত্রে পাওয়া ‘আত্মা’র কমপোনেন্ট। অথচ কেউই মায়ের পেট থেকে একটা নির্দিষ্ট জাতিগত লেবেলসহ বেরোয় না। সদ্যজাত যদি কেশবতী হয়, তাহলেও সে নিজের স্কিন টোনের দুঃখে বুক চাপড়ায় না। তবে বড় হয়ে, স্কুলে, টিভিতে, ইনস্টাগ্রাম ফিল্টারে, রাষ্ট্রীয় আইনে, একাডেমিক কনফারেন্সে—ধাপে ধাপে ওকে বলা হয়, “তুই ব্ল্যাক।” ডিজাইনটা সেখানেই।
Micah Bowers বলেছিলেন, "Design is an art form..." শুনতে সুন্দর। অথচ এই উক্তির কুচক্রী বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আমরা যেভাবে অস্তিত্ব ভাবি—Ontology—সেটাও এক ধরনের ডিজাইন। মানে, কীভাবে কিছু জিনিস অর্থ পায়, কীভাবে কিছু লোক 'Black' হয়—তা আসলে একজন ‘ডিজাইনার’ ঠিক করে দেয়, যিনি সম্ভবত শাদা চামড়ার, উচ্চপদস্থ, সিলিকন ভ্যালির কোনও ‘thought leader’। Ontology যদি হয় অস্তিত্বের আখ্যান, তাহলে Design তার ছাঁচ।
ধরা যাক, একটা শিশু জন্মালো। তার কাঁথায় তখনও মায়ের দুধ লেগে আছে। সে জানে না ক্যানিয়ে ওয়েস্ট কে, বা Malcolm X কেমন ছিলেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, জাত-পরিচয় কোথা থেকে আসে? আসে বাইরে থেকে—যেমন ডেলিভারি অ্যাপে রেস্টুরেন্টের স্টিকার। আপনি জন্মালেন—তারপর সমাজ একে একে লেবেল জুড়ে দিলো—‘Black’, ‘Dalit’, ‘Muslim’, ‘Immigrant’। অথচ আপনার শরীর, মন, রুচি কিছুই এখনও চূড়ান্তভাবে গঠিত হয়নি।
এই প্রশ্নটা—“What does it mean to be Black by design?”—শুনলেই কেমন একটা বেদি-রচিত হিন্দি সিরিয়ালের ডায়ালগের মতো শোনায়। যেন ‘Black’ হওয়াটা পূর্বনির্ধারিত। অথচ সেটাই তো প্রশ্ন। যদি Cultural Blackness আগে থেকে ঠিক করা থাকে, তাহলে কি সেটা ডিজাইনের নাম করে একধরনের বাধ্যতামূলক ক্যারিকেচার নয়? আপনার পরিচয় একটা Klein bottle—ভিতর আর বাইরের ফারাক নেই। তবু তার ওপর সমাজ এসে স্টিকার লাগায়—“Made in Oppression.”
জাতি যদি সত্যিই ডিজাইনের উপাদান হতো, তাহলে বিজ্ঞানের রেফারেন্সে ফর্মুলা কষে ফেলতাম। কিন্তু National Human Genome Research Institute বলে দিয়েছে, "There’s no such thing as race in genetics." তবু আমরা গায়ের রঙ, চুলের ঘনত্ব, ভাষার অ্যাকসেন্ট এসব দিয়ে জাত বানিয়ে ফেলি, যেন ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো এক অদৃশ্য বটগাছ। জাত-পরিচয় একটা cultural myth, তাও এমন এক ‘চিরকুট’ যা কেউ খেতে না পারলেও হজম করতে বাধ্য।
DNA-র হেলিক্সও semiotic—অর্থাৎ, কোডের ভেতরে অর্থ থাকে। এই যে কোষ কোষ করে বেঁচে থাকা, এগুলো আসলে ‘বায়োসেমিওটিক’ সিগন্যাল। তখন প্রশ্ন আসে—যদি বায়োলজি নিজেই জাত চেনে না, তাহলে আমরা এই অচল ‘Black’, ‘Brown’, ‘White’ এসব বর্গ কেন নিয়ে এতো মাতামাতি করি?
এর উত্তর দিতে গেলে Deleuze আর Guattari-র সাহায্য লাগে—যাঁরা বলেছিলেন, “The head is not necessarily a face.” অর্থাৎ, আমরা যা দেখি, সেটার মধ্যেও ‘অর্থ’ বসিয়ে দিই—ছাঁচের মতো। Marshall McLuhan তো বলেই দিলেন, “All media are active metaphors…”—মানে, অর্থ তৈরি করার ‘টেকনোলজি’ আমরা নিজেরাই। তবু যেটা বুঝি না, সেটাকে নিকৃষ্ট ভেবে ফেলে দিই।
Black Design মানে নিজেকে ডিজাইন করে নেওয়া, একদম নিজের মতো করে। কেউ যদি বলে—তুই এই রঙের বলে এমনই হবি, তখনই বলা—"না ভাই, আমি নিজের ডিজাইনার নিজেই।" Black Design মানে একসাথে universal আর hyper-particular হওয়া। Klein bottle-এর মতো—ঘোরাঘুরির মধ্যে নিজেকেই খুঁজে পাওয়া।
এটা ভয় থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিক্রিয়া নয়—এটা শক্তি থেকে জন্মানো ক্রিয়েটিভ অ্যালগরিদম। তাতে design শুধু aesthetics নয়, অস্তিত্বের syntax।
Blackness-এর অর্থ তৈরি হয় অভিজ্ঞতা দিয়ে, কিন্তু অভিজ্ঞতা বিক্রি হয় স্টোরিতে। কাজেই কেউ যদি বলে, “তোর পরিচয় আমি বানিয়ে দেব”, তাকে বলতে হয়, “ভাই, ডিজাইনটা আমি করি, তুই না।” অস্তিত্ব এক নন-লিনিয়ার গাণিতিক গ্রাফ—তার মধ্যে ‘Black’ বলে কিছু নেই। আছে কেবল meaning-এর অবিরাম ‘debugging’। আর শেষ পর্যন্ত, design যদি হয় narrative architecture, তাহলে Blackness তার most controversial project।
আর এই প্রজেক্টে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা—“তুমি কি নিজের জীবন নিজে ডিজাইন করছ, না অন্যের তৈরি করে দেওয়া ছাঁচে পড়ে রয়েছ?”
বাকিটা আপনিই ভাবুন, আর সেই ভাবনাটা যদি লিঙ্কডইনে লিখতে চান, তবে অন্তত ট্যাগ দিন: #OntologicalBlackness #DesignYourSelf
যেমন ভাববেন, তেমন বাঁচবেন। আর বাঁচাটাই যদি ‘Black by design’ হয়, তাহলে সেই ডিজাইনের মুখ্য উপাদান—‘সাহস’।