অনুবাদ নয়, অভিসার: ড্যামিয়ন সিয়ার্লসের অভিযান
সাহিত্য যখন ‘কল্পনার মহাদেশ’, তখন শব্দ আর অর্থ কেবল ‘বুঝে নেওয়া’ নয়, তারা ‘তৈরি’ও হয়। Woolf যখন ‘Mrs. Dalloway’ লেখেন, তখন শুধু ক্লারিসা না, গোটা ইংরেজি ভাষাও বদলে যায়।
শব্দপ্রেমিক, ছদ্মবেশ-আবরণের নোটবুক থেকে
ড্যামিয়ন সিয়ার্লস: অনুবাদকের আলপথে জুতো ছাড়া হেঁটে চলা ফ্ল্যানেল-কোট পরা মরমী দার্শনিক। যিনি রবার্ট ভলজ়ার, জঁ ফসে, নেসসিও থেকে শুরু করে প্যাট্রিক মোদিয়ানো—বেশ কয়েকজন ‘ভিন্নভাষী দুঃখবিলাসী’-কে ইংরেজির পিঠে চড়িয়ে পুঁজিবাদী বিশ্ববাজারে ঠেলে দিয়েছেন (নেহাত ঠেলাঠেলির অনুবাদ নয়, কবিতা-ছোঁয়া কুস্তি)।
সিয়ার্লস বলেন, অনুবাদ মানে শুধু বাক্য রূপান্তর নয়, শব্দে শব্দে চরিত্র গঠন—আর শব্দচয়নে একটু ন্যাকামো থাকলে ক্ষতি নেই—তিনি নিজেই বলেছেন, “There are no rules, only decisions”—এ যেন হেমন্ত মুখার্জি বলছেন, “গান নেই, শুধু সুর আছে।”
সিয়ার্লস চট করে দু’টো বাক্সে ভাষাকে ভরতে চান না—না ‘ফ্রি ট্রান্সলেশন’ আর না ‘লিটারাল ট্রান্সলেশন’। তাঁর মতে, অনুবাদ মানে ব্যাখ্যা। তাঁর চোখে অনুবাদক আসলে ‘দর্শক’ নন, ‘ভূতাত্ত্বিক’। তিনি দেখতে পান কীভাবে একটি পংক্তি তার ‘শব্দগত পরিপ্রেক্ষিত’ এবং ‘ধ্বনিগত বিন্যাসে’ কাঁটা তারের বেড়া পেরিয়ে অনুবাদের প্রান্তরে পৌঁছয়।
এরপর আসে তাঁর 'affordance' থিওরি। না, এটা কোনো এসএসি ছেলের ইংরেজি শব্দ না-পারার দুঃখগাথা নয়। এটা জেমস জি. গিবসন সাহেবের কথা—তিনি বলেছিলেন, চেয়ার মানেই বসা নয়, বসার সম্ভাবনা। এই 'affordance' দিয়ে সিয়ার্লস বোঝাতে চান, প্রতিটি টেক্সট ‘নিজেই বলে দেয়’ কীভাবে তাকে অনুবাদ করতে হবে—মানে, অনুবাদক নাকি স্রেফ তার ইশারায় চলে, নিজের থেকে কিছু করে না।
তবে সিয়ার্লস যে তত্ত্বের উপর চড়ে অনুবাদের হাটে পসরা সাজিয়েছেন, সেটা চতুর্দিকে ফাটল ধরায়—কারণ গিবসনের মডেলে সংস্কৃতি নেই, ইতিহাস নেই, ক্লাস নেই, জাত নেই, কোনও ওয়ান্ডার নেই। চেয়ার সেখানে শুধু চেয়ার। কিন্তু সেদিকে তাকালে আপনি যেমন বসার জায়গা দেখেন, অন্য কেউ দেখতে পায় ‘উপনিবেশিক নিপীড়নের রূপক’।
এখানেই এসে হাজির হয় মার্লো-পোঁতির ‘horizon’—প্রত্যেক দেখার পেছনে থাকে এক ধোঁয়াশা, এক অতীত, এক সুনিপুণ কাঁপুনি। আপনি ভাবলেন আপনি জুলিয়ান বার্নসের অনুবাদ করছেন, আসলে আপনি আপনার বাবার সিগারেটের গন্ধে ভেসে যাচ্ছেন।
আর সাহিত্য যখন ‘কল্পনার মহাদেশ’, তখন শব্দ আর অর্থ কেবল ‘বুঝে নেওয়া’ নয়, তারা ‘তৈরি’ও হয়। Woolf যখন ‘Mrs. Dalloway’ লেখেন, তখন শুধু ক্লারিসা না, গোটা ইংরেজি ভাষাও বদলে যায়।
তাহলে অনুবাদ কাকে বলে? যেহেতু ভাষা কেবল পাখির ডাক নয়, ওটা মানুষের বিলাসিতা—ভুল করলে প্যাঁচ লাগে, ঠিক করলে প্রেম হয়। অনুবাদ তাই শুধুমাত্র রচনা নয়, নয় শুধুই প্রতিচ্ছবি। ওটা একটা স্বপ্ন যার মধ্যে লেখক আর অনুবাদক, দুজনেই ঘুমোয়—কখনও এক বিছানায়, কখনও দুই পারিপার্শ্বিকতায়।
আপনি হয়তো মনে করছেন, অনুবাদ মানে কেবল ‘ইংরেজিটা বাংলায় করে দিচ্ছি’—না রে ভাই, ওটা না বোলচাল, না আদানপ্রদান। ওটা একটা গোপন ঘর, যার প্রতিটা শব্দের দরজায় লেখা থাকে: “শব্দ আসলে ছদ্মবেশী সত্য।” আর ড্যামিয়ন সিয়ার্লস? তিনি শুধু সেই ছদ্মবেশগুলো খুলে ফেলেন না, মাঝে মাঝে নতুন ছদ্মবেশও পরিয়ে দেন। কেউ কেউ একে বলে কল্পনার বিপ্লব, কেউ বলে শব্দের ডাকাতি। আমি বলি—ভাষার প্রেমিক মানুষ, একটু উন্মাদ তো হতেই হবে।
The Philosophy of Translation by Damion Searls
Yale University Press, 237 pp., $28.00