নিষিদ্ধ সত্য
পঙ্কজ মিশ্রর বই শেষ করে মনে হল, ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ আর দখলদারি তো সেই পুরোনো দানব, কেবল মুখোশ পাল্টেছে। গাজা থেকে হলোকাস্ট, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ থেকে ইজরায়েলি সামরিকীকরণ—সবই মূলত ক্ষমতার পুরনো খেলা
THE WORLD AFTER GAZA: A History | By Pankaj Mishra
বইচর্চা
রিটন খান
পঙ্কজ মিশ্রর বই শেষ করে মনে হল, ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ আর দখলদারি তো সেই পুরোনো দানব, কেবল মুখোশ পাল্টেছে। গাজা থেকে হলোকাস্ট, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ থেকে ইজরায়েলি সামরিকীকরণ—সবই মূলত ক্ষমতার পুরনো খেলা, শুধু বোর্ড আর খেলোয়াড় বদলেছে। পঙ্কজ মিশ্র তাঁর ভারতীয় শিকড় থেকে দেখছেন কেমন করে ইতিহাসের এই চাকা বারবার ঘুরে ফিরে আসে, কিন্তু এক আশ্চর্য জটিল সমীকরণে তা আজকের ভূরাজনীতির নতুন নাট্যমঞ্চ হয়ে উঠেছে।
তবে ইতিহাস কেবল ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস’ নয়, সেটাকে ব্যাখ্যা করা, বোঝানো, এমনকি উলটে দেওয়া—এসবও একধরনের ক্ষমতার খেলা। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পঙ্কজ মিশ্র পাঠকদের ভাবাতে চান: আসল ইতিহাস কাকে বলে? কাদের লেখা ইতিহাস আমরা পড়ছি? কারা লিখছে, আর কারা লিখতেই পারছে না? যে সাম্রাজ্যবাদ একসময় বন্দুক আর কামান দিয়ে গড়ে উঠেছিল, আজ তার ধারালো অস্ত্র হয়ে উঠেছে মিডিয়া, টেকনোলজি আর অর্থনীতি। ‘আধুনিকতা’ আর ‘সভ্যতা’র মোড়কে যাকে ‘উন্নয়ন’ বলা হয়, সেই উন্নয়ন কার জন্য? গাজায় বোমা পড়লে তা কীভাবে পশ্চিমের সামরিক শিল্পের লাভের খাতা ফুলিয়ে তোলে? আমেরিকার মুক্তিবাদী চেহারার পেছনে কেমন করে যুদ্ধের মুনাফা জমে?
আর এইসব প্রশ্ন তোলাটাই তো বিপজ্জনক। কারণ, ইতিহাসের ন্যারেটিভ যারা বানায়, তারাই সেটাকে নিয়ন্ত্রণও করতে চায়। পঙ্কজ মিশ্রর কাজ হচ্ছে সেই নিয়ন্ত্রিত গল্পের বাইরে দাঁড়িয়ে বলা: "আচ্ছা, ব্যাপারটা আরেকটু অন্যভাবে দেখা যাক?"
পঙ্কজ মিশ্রর বিবর্তনের গল্পটা অনেকটা সিনেমার সেই নায়কোচিত ট্রান্সফরমেশনের মতো—যিনি প্রথমে ক্ষমতার গ্ল্যামারাইজড সংস্করণে বিশ্বাস করেন, তারপর একদিন বুঝতে পারেন যে আসল সত্য অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে। ছোটবেলা কেটেছে এক হিন্দুত্ববাদী পরিবারে, যেখানে ইজরায়েলকে প্রায় দেবত্বের আসনে বসানো হয়েছিল—একটা ছোট, অথচ শক্তিশালী রাষ্ট্র, যা অস্ত্র আর জাতীয়তাবাদ দিয়ে নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। ‘জয় শ্রীরাম’-এর মতোই ‘আম ইজরায়েল চাই’ ধরণের জাতীয়তাবাদ ছিল তাঁদের কাছে আদর্শ।
কিন্তু জীবন হল এক কৌতূহলী শিক্ষক। যখন পঙ্কজ মিশ্র বাস্তবে ফিলিস্তিনি ছাত্রদের সাথে মিশতে শুরু করলেন, যখন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের গভীরে ঢুকলেন, তখন বুঝলেন গল্পটা এতটা একরৈখিক নয়। সেই ‘নির্ভীক, আত্মরক্ষামূলক’ ইজরায়েলের গল্পের পেছনে এক দখলদার রাষ্ট্রের নির্মম বাস্তবতা আছে, আছে এক দীর্ঘ নিপীড়নের ইতিহাস, আছে উচ্ছেদ, বুলডোজার, সেনাবাহিনী, আর এক চিরস্থায়ী দখলদারি।
এটাই হল দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন—যেখানে একদিন যাঁরা ছিল আদর্শ, তাঁদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। পঙ্কজ মিশ্রর এই রূপান্তর প্রমাণ করে, ইতিহাস শুধুই বিজেতাদের লেখা কাহিনি নয়, বরং ইতিহাসের ন্যারেটিভ বদলাতে পারে, যদি কেউ সত্য খুঁজতে ইচ্ছুক হয়। আর পঙ্কজ মিশ্রর মতো মানুষদের কাজই হল পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা: আপনার বিশ্বাসগুলো কি সত্যিই আপনার? নাকি আপনাকে সেটাই বিশ্বাস করতে শেখানো হয়েছে?
পঙ্কজ মিশ্রর বইয়ের সবচেয়ে চাঁচাছোলা দিকগুলোর মধ্যে একটি হল হলোকাস্টের স্মৃতির রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রতি তাঁর কঠোর সমালোচনা। ইতিহাসের এই ভয়াবহ অধ্যায়, যা একসময় মানবসভ্যতার আত্মজিজ্ঞাসার আয়না হয়ে উঠেছিল, তা আজ কৌশলগত অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। মিশ্র দেখান, কীভাবে হলোকাস্টের স্মৃতি ইজরায়েলি নীতির নৈতিক ঢাল হয়ে উঠেছে—একটি ভয়াবহ অতীত, যা আজকের বর্বরতাকে জায়েজ করতে ব্যবহৃত হয়।
এই কাঠামোটা খুব পরিচিত: ভুক্তভোগীর স্মৃতি যতবার সামনে আনা যায়, ততবার তারা যে নিজেও নিপীড়ক হয়ে উঠতে পারে, সেই প্রশ্নটা চাপা পড়ে যায়। পঙ্কজ মিশ্র দেখান, ইতিহাস শুধুই অতীত নয়—এটা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের একটি উপাদান। হলোকাস্টের ভয়াবহতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো জায়গা নেই, কিন্তু সেটাকে একটি রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী কর্মসূচির ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহারের প্রশ্ন কি তোলা যাবে না?
এখানেই তাঁর লেখার সাহসী দিক। তিনি মনে করিয়ে দেন, ইতিহাসের প্রতি ন্যায়বিচার মানে শুধু অতীতের ভুল না করা নয়, বরং নিশ্চিত করা যে, সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর কোথাও হচ্ছে না। হলোকাস্টের স্মৃতি যদি মানবতার শিক্ষা হয়ে থাকে, তবে সেই শিক্ষা কীভাবে অবরুদ্ধ গাজা, বুলডোজার চালানো বসতি, আর প্রতিরোধের ভাষাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে দেগে দেওয়া নীতিগুলোকে ন্যায্যতা দিতে পারে?
পঙ্কজ মিশ্রর বই এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করে পাঠকদের—ইতিহাস স্মরণ করছি, না সেটাকে কাজে লাগানো হচ্ছে? সত্যিকারের মানবিকতা কী: শোকের ইতিহাসকে উপলব্ধি করা, নাকি সেটাকে হাতিয়ার বানিয়ে অন্যকে দমিয়ে দেওয়া?
মিশ্রর বইয়ের আরেকটি তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ হল ইজরায়েলি নীতির সমালোচনা করতে গেলেই যেভাবে ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ তকমার খড়্গ নেমে আসে। এটি একটি চিন্তারাজ্যের কফিনে পেরেক ঠোকার কৌশল, যেখানে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে যে-কোনো সমালোচনা করলেই অভিযোগ ওঠে—"তুমি কি ইহুদিবিদ্বেষী?" যেন মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলা আর ধর্মীয় বিদ্বেষ একসূত্রে গাঁথা! পঙ্কজ মিশ্র দেখান, এই প্রবণতা কেবল নৈতিকভাবে ভ্রান্তই নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে ইজরায়েলের নীতির বিরুদ্ধে উঠতে চাওয়া প্রশ্নগুলো জন্মের আগেই গলা টিপে মারা যায়।
এটা শুধু তাত্ত্বিক নয়, ব্যক্তিগতও। পঙ্কজ মিশ্র দেখান, কীভাবে প্রকাশক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি তথাকথিত মুক্তচিন্তার প্ল্যাটফর্মগুলিও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে ভয় পায়। ‘ব্যাকল্যাশ’-এর আশঙ্কা, বই বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয়, দানের টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা—এসব যেন এক অদৃশ্য সেন্সরশিপ চালিয়ে যায়, যেখানে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা নিজেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
এখানেই তাঁর লেখা আরও জরুরি হয়ে ওঠে। তিনি দেখান, কীভাবে নৈতিক আলোচনাকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে এক কৃত্রিম ভীতির পরিবেশ, যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নকে চাপা দিতে ধর্মীয় সংবেদনশীলতার ঢাল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রশ্নটা সহজ—ইজরায়েলের নীতির সমালোচনা মানেই কি ইহুদিবিদ্বেষ? ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলা মানেই কি ঘৃণার ভাষায় কথা বলা?
তিনি পাঠকদের সামনে এই অস্বস্তিকর বাস্তবতাকে টেনে আনেন—আমরা কি এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই অন্যায় হয়ে উঠেছে?
বইটির অন্যতম শক্তিশালী দিক হল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক-বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাখা। ইতিহাসের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি দেখান, ফিলিস্তিনি লড়াই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটা সেই দীর্ঘ সংগ্রামেরই অংশ, যেখানে একদা ভারত থেকে আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, শোষিত জনগোষ্ঠীগুলো সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল।
তিনি দেখান, প্রতিটি মুক্তিসংগ্রাম সময়ের সাথে বদলায়, প্রতিরোধের কৌশল পাল্টায়, কিন্তু মূল সুর থেকে যায় এক: দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অধিকার প্রতিষ্ঠা। গাজায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ আর সেনা অভিযান নতুন কিছু নয়—এটা কেবল আধুনিক সামরিকীকরণের ভাষায় পুরনো দমননীতির পুনরাবৃত্তি। তিনি দেখান, যেমন একসময় ব্রিটিশরা ভারতীয় বিদ্রোহীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলত, যেমন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের লড়াইকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল, তেমনই আজ ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধকেও একইভাবে দেখানো হয়।
কিন্তু ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, যে সংগ্রামকে আজ ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলা হয়, সেটাই কাল হয়ে ওঠে মুক্তির লড়াইয়ের প্রতীক। নেলসন ম্যান্ডেলাকে একসময় ‘সন্ত্রাসী’ বলেছিল পশ্চিমারা, পরে তিনিই হলেন বিশ্বশান্তির প্রতীক। তাহলে আজ ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধকে নিয়ে যে ন্যারেটিভ গড়া হচ্ছে, তার সত্যিকারের ব্যাকরণ কী?
পঙ্কজ মিশ্রর যুক্তি একদম সোজা—আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ শুধু সেনাবাহিনী দিয়ে চলে না, চলে ন্যারেটিভ-কন্ট্রোল দিয়ে। ইতিহাসের একপেশে পাঠ দিয়েই বোঝানো হয়, কার লড়াই ‘ন্যায্য’ আর কার লড়াই ‘উগ্রতা’। আর এখানেই পঙ্কজ মিশ্র পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করেন—আপনার চোখ দিয়ে যা দেখানো হচ্ছে, সেটাই কি ইতিহাস? নাকি ইতিহাসের এক নির্মিত সংস্করণ?
পঙ্কজ মিশ্রর বইয়ে ভারতের ইজরায়েল-নীতির বিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। একসময় যে দেশ গর্বের সঙ্গে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াত, যে রাষ্ট্রের নেহরুভিয়ান কূটনীতি ছিল উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে দৃঢ়, আজ সেই দেশই ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের তালিকায়। পঙ্কজ মিশ্র দেখান, এই পরিবর্তন কেবল কূটনৈতিক নয়, আদর্শিকও—ভারতের রাজনৈতিক ভূদৃশ্য বদলের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে ইজরায়েল এক নতুন ‘আদর্শ’ হয়ে উঠেছে, সেটাই তাঁর পর্যবেক্ষণের বিষয়।
এই বদলটা এসেছে ধাপে ধাপে। ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে ভারত ছিল গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বে, যেখানে ফিলিস্তিনের মুক্তি ছিল একটি ন্যায্য লড়াই। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভারতের রাজনৈতিক ভাষা বদলেছে—বিশেষত বর্তমান নেতৃত্বের হাতে তা আরও মিলিট্যান্ট জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকেছে। আজকের ভারত শাসকদের কাছে ইজরায়েল আর শুধুই একটা সামরিক-মিত্র নয়, বরং এক আদর্শ মডেল—একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র, যা কঠোর নিরাপত্তাবাদী নীতির মাধ্যমে "অভ্যন্তরীণ শত্রুদের" দমন করে।
তবে এই রাজনৈতিক বাস্তবতার বিপরীতে এক অদ্ভুত দ্বৈততা রয়ে গেছে। সরকার যখন ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকছে, তখন জনমানসে এখনো ফিলিস্তিনের প্রতি একধরনের নৈতিক সহানুভূতি টিকে আছে। গাজায় বোমাবর্ষণের সময় ভারতীয় শহরগুলোতে যে প্রতিবাদ হয়, তা দেখিয়ে দেয় যে সরকারী নীতির বাইরে জনগণের হৃদয়ে অন্য গল্প লেখা আছে। পঙ্কজ মিশ্র ঠিক এখানেই থামিয়ে দেন পাঠকদের—একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কি সত্যিই তার জনগণের মনোভাবকে প্রতিনিধিত্ব করে? নাকি রাষ্ট্রব্যবস্থা কেবল তার ক্ষমতার আদর্শকে সামনে রেখে বিদেশ নীতি নির্ধারণ করে?
এই দ্বৈত বাস্তবতা শুধুই ভারতের নয়, এটি আসলে এক বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ। যখন বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শক্তির উত্থান ঘটছে, যখন "জাতীয় নিরাপত্তা"র নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে, তখন ইজরায়েল মডেল হয়ে উঠেছে একধরনের রাজনৈতিক ম্যানুয়াল। মিশ্র পাঠকদের সামনে এই প্রশ্ন রেখেছেন—জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে কি এক নতুন সাম্রাজ্যবাদ গড়ে উঠছে? আর সেই সাম্রাজ্যবাদ কি শুধুই ভূখণ্ড দখলের খেলায় আছে, নাকি আমাদের চিন্তার জগতটাকেও একরৈখিক করে দিচ্ছে?
পঙ্কজ মিশ্র গাজা আর কাশ্মীরের মধ্যে যে সমান্তরাল টানেন, তা শুধু দুই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক বাস্তবতাই নয়, বরং উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রগুলোর গভীর সংকটকেও তুলে ধরে। কাশ্মীর আর গাজার মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব আছে, ইতিহাস ভিন্ন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দমননীতি, সেনা উপস্থিতি, নাগরিক অধিকার খর্ব করা এবং গণপ্রতিরোধ দমনের কৌশল আশ্চর্যজনকভাবে এক। পঙ্কজ মিশ্র দেখান, কীভাবে এই দুই অঞ্চল হয়ে উঠেছে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোগত সংকটের প্রতীক—যেখানে রাষ্ট্র নিজের সার্বভৌমত্বকে সংহত করতে গিয়ে নাগরিকদের একাংশকে শত্রুতে পরিণত করে ফেলে।
গাজায় ইজরায়েল যে নীতি প্রয়োগ করছে—সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া, অর্থনৈতিক অবরোধ, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা, বিক্ষোভকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে দেগে দেওয়া—তার ছায়া কাশ্মীরেও স্পষ্ট। ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই নিষেধাজ্ঞা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, জনসাধারণের ওপর কঠোর সেনা তল্লাশি, এবং বিক্ষোভ দমনের নামে নির্যাতন চালাচ্ছে। পঙ্কজ মিশ্র দেখান, এ ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতির মূল সমস্যা হল, এগুলো শুধু ‘নিরাপত্তা’ রক্ষার জন্য নয়, বরং এক দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অংশ—যেখানে দখলদারি স্থায়ী হয়, অথচ সেই রাষ্ট্র নিজেকে ‘গণতান্ত্রিক’ বলেই দাবি করে।
তবে তাঁর আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, কীভাবে উপনিবেশ থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া রাষ্ট্রগুলো নিজেরাই উপনিবেশবাদী আচরণে লিপ্ত হয়। একদা যে রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল, ক্ষমতায় আসার পর তারাই পরিণত হয় দমনযন্ত্রে। পঙ্কজ মিশ্র দেখান, উপনিবেশোত্তর দেশগুলো যখন নিজেদের জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলতে গিয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর স্বীকৃতিকে অস্বীকার করে, তখন তারা আসলে সেই একই আধিপত্যবাদী কাঠামো পুনরুৎপাদন করে, যার বিরুদ্ধে তারা একদা লড়াই করেছিল।
এই তুলনা পাঠকদের বাধ্য করে ভাবতে—গাজা আর কাশ্মীর কি শুধুই ‘সংঘাতময় অঞ্চল’, নাকি তারা আধুনিক রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের গোপন অসংগতিগুলোর দৃষ্টান্ত? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই রাষ্ট্রগুলো কি আদৌ ‘জনগণের রাষ্ট্র’, নাকি ‘রাষ্ট্রের জনগণ’ বলে একটা বিভাজন তৈরি করে ফেলা হয়েছে, যেখানে জনগণের একাংশ সার্বভৌমত্বের অধিকার পায়, আর অন্য অংশ শুধুই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীন থাকে?
পঙ্কজ মিশ্রর বইয়ের আরেকটি অনিবার্য থিম হল পশ্চিমাদের সুবিধাবাদী নীরবতা এবং সরাসরি সহায়তার ফলে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের দীর্ঘায়িত হওয়া। তিনি দেখান, কীভাবে পশ্চিমা সরকারগুলো কেবলমাত্র কূটনৈতিক বিবৃতির খেলায় ব্যস্ত থেকে ইজরায়েলের আগ্রাসনকে মদত দিয়ে গেছে—কখনও অস্ত্র বিক্রি করে, কখনও জাতিসংঘে নীতিগত সমর্থন দিয়ে, আবার কখনও "আত্মরক্ষার অধিকার" বলে দখলদারি জায়েজ করে। এই নীরবতা কেবল নিষ্ক্রিয়তা নয়, এটি অপরাধে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
পঙ্কজ মিশ্রর মতে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর এই ভণ্ডামি ইতিহাস থেকে আসে। একসময় যারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, আজও তারা সেই একই সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির ধারক ও বাহক—শুধু এবার তা অস্ত্র, অর্থনীতি ও মিডিয়া-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রটা যে এমন এলোমেলো, তার পেছনে যে লর্ড বালফোরদের হাত ছিল, তা ভুলে গেলে চলে না। অথচ পশ্চিমা দেশগুলো এই জটিলতা নিয়ে আত্মসমীক্ষার পরিবর্তে কেবল তাদের স্বার্থ দেখেই নীতি নির্ধারণ করে।
কিন্তু আশার আলো আছে, এবং পঙ্কজ মিশ্র সেটাই দেখেন নতুন প্রজন্মের মধ্যে। তিনি তুলে ধরেন, কীভাবে ছাত্র আন্দোলনগুলো—বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ থেকে শুরু করে বয়কট আন্দোলন—ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে একটি নতুন নৈতিক চেতনার জন্ম দিচ্ছে। তাদের কণ্ঠস্বর এক ভিন্ন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করছে, যা জাতিসংঘের মেকি ভাষা নয়, বরং বাস্তব ন্যায়বিচারের দাবি তোলে। তিনি বিশেষভাবে লক্ষ করেন, কীভাবে এই তরুণ কর্মীরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, এবং এই লড়াই কেবল ফিলিস্তিনের জন্য নয়, বরং এক বৃহত্তর মানবিক ন্যায়বিচারের জন্য।
তারপরও পঙ্কজ মিশ্র কোনো রোমান্টিক আশাবাদী নন। তিনি জানেন, ক্ষমতার কাঠামোগুলো সহজে বদলায় না, বরং অনেক সময় আরও নির্মম হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিহাস বলে, পরিবর্তন আসে ধৈর্য ধরে লড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি পাঠকদের মনে করিয়ে দেন, এই লড়াই কেবল নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের জন্য নয়, বরং এক বৃহত্তর মানবিক দায়বদ্ধতার অংশ। সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোগুলো যত শক্তই হোক, সত্যিকারের ন্যায়বিচার কখনও নিঃশেষ হয় না—কারণ ইতিহাস বলে, প্রতিটি সাম্রাজ্যের শেষ আছে, প্রতিটি প্রতিরোধের ইতিহাস নতুন যুগের জন্ম দেয়।
THE WORLD AFTER GAZA: A History | By Pankaj Mishra | Penguin Press | 292 pp. | $28