আমেরিকার নতুন বাস্তবতা
ডেমোক্র্যাটরা ঠিক যেন ভোরবেলায় বাজ পড়ার মতো হতভম্ব— কীভাবে পাল্টা চাল চালবে, সে নিয়ে তাদের মধ্যে এক গভীর অনিশ্চয়তা। একদিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে রাস্তায় জনতার ক্ষোভ
ট্রাম্পের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হতে না হতেই, যেন এক অজানা আঁধার নামতে শুরু করেছে আমেরিকার গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর। একের পর এক নির্বাহী আদেশ সই হচ্ছে, আর প্রতিটাই যেন মার্কিন শাসনব্যবস্থার ভিতে বোম মারার জন্য বানানো। সরকারি খরচে হিমবাহের মতো জমাট বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকারকে মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এমনকি লিঙ্গ পরিচয়ের সংজ্ঞাটাও নতুন করে লেখা হচ্ছে— ট্রাম্পীয় কালি দিয়ে।
এই সবকিছু মিলিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা এক হাতে কুক্ষিগত করার এমন নির্লজ্জ প্রচেষ্টা শেষ কবে দেখা গিয়েছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদরা এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে বলছেন, এটাকে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদের দিকে হাঁটা বলা চলে। কিন্তু একদম বিনা প্রতিরোধে এই ‘কো-ডি-ফাইড’ একনায়কত্ব কার্যকর হবে না বলেই আইনি লড়াই শুরু হয়ে গেছে। ইউনিয়ন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারা একে একে আদালতের দরজায় কড়া নাড়ছে। তারা সংবিধানের সেই লাইনগুলো ধরে ধরে দেখাচ্ছে, যেখানে আমেরিকার গণতন্ত্রের শিকড় পোঁতা। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়েছে— ট্রাম্প বনাম সংবিধান। এবং, আদালতই এখন শেষ আশ্রয়।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা ফলপ্রসূ হবে? সংবিধান কি এই চাপ সামলাতে পারবে, নাকি এটাও এখন স্রেফ পুরনো কাগজ, যা সুবিধামতো এদিক-ওদিক মোচড়ানো যায়? আমেরিকা কি তার গণতন্ত্রের পরীক্ষায় পাশ করবে, নাকি দ্বিতীয় ট্রাম্প-তন্ত্রের ছায়ায় ধীরে ধীরে ‘ক্যান দ্য কনস্টিটিউশন স্পিক?’— সেই প্রশ্নটাই তোলা হবে?
ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে, সংবিধান এখন এক চরম পরীক্ষা দিচ্ছে— একদিকে নির্বাহী শাখার লাগামছাড়া ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণ, অন্যদিকে বিচারব্যবস্থা ও আইনসভা কি আদৌ যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে, সেই অনিশ্চয়তা। ক্ষমতার এই লোভাতুর কৌশল শুধু ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ নয়; এখানে ইলন মাস্কের মতো প্রযুক্তি-ধনীদের প্রভাবও একটা বড় ভূমিকা রাখছে। মাস্ক কেবল ব্যবসায়ী নন, তিনি এখন নীতিনির্ধারণেও এক ‘শিক্ষক’ হয়ে উঠেছেন, যার পাঠক্রমের মূল বিষয়: কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা।
ডেমোক্র্যাটরা ঠিক যেন ভোরবেলায় বাজ পড়ার মতো হতভম্ব— কীভাবে পাল্টা চাল চালবে, সে নিয়ে তাদের মধ্যে এক গভীর অনিশ্চয়তা। একদিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে রাস্তায় জনতার ক্ষোভ— সবই চলছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে: এতে কি আদৌ নির্বাহী শাখার এই লাগামছাড়া শক্তিবৃদ্ধি রোখা যাবে? নাকি আমেরিকার গণতন্ত্র এবার কেবল অতীতের এক সেন্টিমেন্ট হয়ে যাবে, যেখানে বিচারব্যবস্থা আর আইনসভা শুধুই টেকনিক্যাল বাধা, যা শাসকের সুবিধামতো এড়িয়ে যাওয়া যায়?
এটাই হয়তো আমেরিকার নতুন বাস্তবতা— যেখানে একসময় গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ ছিল, এখন সেখানে একটি প্রবল, আর দুটি প্রায় জীর্ণ, দর্শকের ভূমিকায়।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এখন এক অদ্ভুত অস্তিত্বসংকটে ভুগছে— যেন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বক্সিং রিংয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর প্রতিপক্ষ একের পর এক ঘুষি মারছে। ট্রাম্প প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারী নীতিগুলোর মোকাবিলায় তাদের প্রতিক্রিয়া এতটাই নরম যে, সমর্থকরাও ধৈর্য হারাতে বসেছে। সমস্যাটা শুধু প্রতিক্রিয়ার দুর্বলতায় নয়, বরং এক আদর্শগত দিকভ্রষ্টতায়।
এই পরিস্থিতিতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট— পুরনো কৌশল নিয়ে নতুন স্বৈরাচারী ঢেউ সামলানো যাবে না। ভদ্রতার পোশাক গায়ে চাপিয়ে, "আমরা ভালো মানুষ, আমরা সংবিধানের পক্ষের দল" জাতীয় বয়ান তুলে লাভ নেই, কারণ ট্রাম্পিয়ান বাস্তবতা ততদিনে আলাদা এক খেলার মাঠ তৈরি করে ফেলেছে।
এর সমাধান? শিকড়ের রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া, তৃণমূল আন্দোলন জোরদার করা, আর জনসাধারণের সঙ্গে সত্যিকারের সংযোগ স্থাপন করা। মধ্যবর্তী নির্বাচনই এখন একমাত্র বড় সুযোগ, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের রাস্তা খোলা থাকতে পারে। কিন্তু শর্ত একটাই— ঘরোয়া বিভক্তি ঝেড়ে ফেলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, স্পষ্ট বার্তা দেওয়া, আর জনগণকে বোঝানো যে এই নির্বাচন নিছক রাজনৈতিক রঙ বদলের ব্যাপার নয়; গণতন্ত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ সুযোগ হতে পারে।
শুধু ভোটারদের সামনে গিয়ে বললেই হবে না, "আমরা ট্রাম্প নই!"— বরং বলতে হবে, "আমরা কী?" এবং সেটা এমনভাবে বলতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ বোঝে, অনুভব করে, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে চিৎকার করে বলে— "হ্যাঁ, আমরা বদল চাই!"
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বর্তমান অবস্থা একদম সেই নায়কহীন নাটকের মতো, যেখানে খলনায়কের সংলাপ প্রতিনিয়ত উচ্চকিত, অথচ নায়কের আবির্ভাব হচ্ছে না, কিংবা হলেও দর্শকদের মন ছুঁতে পারছে না। ট্রাম্পের স্বৈরতান্ত্রিক ঢেউ রুখতে কেবল নীতিগত অবস্থান যথেষ্ট নয়; দরকার এমন এক নেতা, যিনি জনতার হৃদয়ে আগুন ধরাতে পারেন, যিনি বক্তৃতায় শুধু তথ্য নয়, আবেগের স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই নেতা কে? কেউ বলছেন, বার্নি স্যান্ডার্সের মতো পরীক্ষিত, জনবান্ধব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দরকার। আবার কেউ বলছেন, এখন পুরনো গার্ড দিয়ে হবে না— চাই নতুন, তরুণ, এবং আমেরিকার বিভিন্ন শ্রেণি ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত কেউ। এমন কেউ, যিনি বোঝেন শ্রমিকের ক্ষোভ, কৃষকের আশঙ্কা, তরুণদের হতাশা, এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা।
ডেমোক্র্যাটদের মূল চ্যালেঞ্জ হল বিভক্ত ঘর একসঙ্গে আনা। কারণ যতই নীতির লড়াই থাকুক, ভোট শেষ পর্যন্ত কারিশমারও খেলা। এবং, ট্রাম্প নামক মহাজাদুকরের সামনে দাঁড়ানোর জন্য দরকার এক প্রতিপক্ষ, যিনি শুধু যুক্তিতে নয়, মানুষের আবেগেও আলোড়ন তুলতে পারেন। যদি তারা সেই মুখ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়, তবে এই রাজনৈতিক যুদ্ধের ফলাফল আগেই লেখা হয়ে গেছে।