নারী কিহোতে
অষ্টাদশ শতকের সাহিত্য-জগতের এক বিস্ময়কর কীর্তি The Female Quixote, যেখানে শার্লট লেনক্স এক জটিল ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন—একদিকে ধ্রুপদী রোমান্টিক উপন্যাসের মায়াজাল, অন্যদিকে বাস্তবের নির্মম সত্য।
অষ্টাদশ শতকের সাহিত্য-জগতের এক বিস্ময়কর কীর্তি The Female Quixote, যেখানে শার্লট লেনক্স এক জটিল ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন—একদিকে ধ্রুপদী রোমান্টিক উপন্যাসের মায়াজাল, অন্যদিকে বাস্তবের নির্মম সত্য। এই উপন্যাস যেন সময়ের সীমা পেরিয়ে আজও প্রতিধ্বনিত হয়, বিশেষত যখন আমরা তথাকথিত আদর্শ নারীত্বের সংস্কার, সাহিত্যের প্রভাব এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দ্বৈত নীতির ব্যঙ্গ-প্রতিবিম্ব খুঁজতে চাই। আরাবেলা, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, হলেন এক নারী কিহোতে—যিনি প্রেম ও বীরত্বের কল্পনার রাজ্যে এতটাই নিমজ্জিত যে বাস্তবতার কঠিন মাটিতে পা রাখতে পারেন না।
আরাবেলা এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তার দুনিয়া গড়ে ওঠে ফরাসি রোমান্স উপন্যাসের পাতায়, যেখানে প্রেমিকরা অতি বীর, দুষ্টরা অতি নিষ্ঠুর, আর নারীরা অপার সৌন্দর্যের আধার, যাদের জয় করতে হলে একাধারে অসাধ্য সাধন করতে হয়। বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই কল্পনার বুদবুদ তখন ফাটতে শুরু করে, যখন তার পিতা তাকে তার আত্মীয় গ্লানভিলকে বিয়ে করার জন্য বাধ্য করেন।
গ্লানভিল, যা-তা হোক, এক সুস্থ স্বাভাবিক যুবক। সে তার প্রেমিকাকে ভালোবাসে, কিন্তু ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে! আরাবেলা তার পিতার আদেশকে এক বিশাল মহাকাব্যিক চক্রান্ত মনে করে, এবং নায়কোচিত রোমান্টিক বাধার প্রতিটি নিয়ম পালন করতে উদ্যত হয়। সে বিশ্বাস করে, প্রেমিকদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়, অশ্রু ফেলতে হয়, দু-চারটা যুদ্ধও করতে হয়—এই ভাবনা নিয়েই সে গ্লানভিলকে এমনসব শর্ত দেয়, যা কেবলমাত্র মধ্যযুগীয় নাইটদের কল্পকাহিনীতেই সম্ভব।
আরাবেলার অদ্ভুত আচরণ ধীরে ধীরে হাস্যকর বিপর্যয়ে রূপ নেয়। সে ধরে নেয়, গ্লানভিলের প্রতিটি আচরণ আসলে গুপ্ত কোনো উদ্দেশ্যের অংশ। তার বিশ্বাস, সমাজে চোরাবালির মতো ছড়িয়ে আছে নানা ছদ্মবেশী প্রেমিক, প্রতারক, এবং শত্রু। তার এই বিভ্রমের চরম পরিণতি ঘটে যখন সে ভাবে, তার এক সাধারণ পরিচিত ব্যক্তি তাকে অপহরণ করতে আসছে—এই বিপজ্জনক ভুল বোঝাবুঝির ফলে সবাই বুঝতে পারে, আরাবেলা কল্পনার জগতে হারিয়ে গেছেন।
লেনক্সের এই ব্যঙ্গাত্মক রচনা আসলে নারীশিক্ষা ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে এক সুক্ষ্ম প্রতিবাদ। উপন্যাসটি শুধুমাত্র Don Quixote-এর নারীবাদী সংস্করণ নয়, বরং নারীর বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে উপেক্ষা করা হয় এবং কীভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতি নারীদের ভাবনার জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে, সেটার দৃষ্টান্ত।
আরাবেলা যেন সেই নারীর প্রতিরূপ, যাদের বাস্তবজ্ঞানহীন করে তোলা হয়, যাদের শিক্ষা কেবল গল্পের রাজ্যে ঘুরপাক খায়, এবং যাদের কাছে প্রেমের সংজ্ঞা কেবলমাত্র রূপকথার গণ্ডিতে আবদ্ধ। এই ধরণের রোমান্স-আসক্তির হাস্যকর বিপর্যয় লেনক্স অত্যন্ত সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তবে, এটি একমাত্র ব্যঙ্গ নয়; এর গভীরে রয়েছে এক ধরণের নীরব হাহাকারও। উপন্যাসটি প্রশ্ন তোলে—এই কল্পনা কি আরাবেলার একমাত্র মুক্তির পথ? বাস্তবিক অর্থে তার কী বিকল্প ছিল? সমাজ কি তাকে কখনও এমন কোনো শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে যেখানে সে তার চিন্তাভাবনা স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত করতে পারে? নাকি তার কল্পনার জগৎই ছিল একমাত্র রেহাই?
আরাবেলার আত্মবিভ্রান্তির কারণে তাকে পাগল বলা হয়, উপহাস করা হয়, কিন্তু এই "পাগলামি" কি শুধুই তার নিজস্ব? এই রোমান্স-আসক্তি তো একা আরাবেলার নয়; এটি ছিল সময়ের, সংস্কৃতির এবং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর এক নির্মাণ। আজও তো আমরা দেখি, সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে সিনেমা, সিরিজ—সবকিছুই নারীদের জন্য এক অলীক প্রেমের কল্পনাজাল বুনে চলে, যেখানে প্রেম মানে এক নায়কোচিত ত্যাগ, মিষ্টি কথার বৃষ্টি, এবং চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বৈবাহিক সুখ।
লেনক্স এই শেকল ভাঙতে চেয়েছিলেন। আরাবেলার গল্প শেষে সে "বুদ্ধি ফিরে পায়" এবং গ্লানভিলকে বিয়ে করে, যা হয়তো একটু হতাশাজনক। কিন্তু তার মানসিক বিবর্তন, তার শিক্ষালাভ, এবং পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতার সামনে তার আত্মসমর্পণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর ব্যঙ্গ। আরাবেলা তার কল্পনার দুনিয়াকে বিসর্জন দেয়, কিন্তু এই বিসর্জনের মধ্যে কি সত্যিকারের মুক্তি আছে? নাকি এটি শুধুই এক বাস্তবতার প্রতি আত্মসমর্পণ?
অনেকেই বলেন, The Female Quixote আসলে Northanger Abbey-এর পূর্বসূরি। জেন অস্টেনের ক্যাথরিন মোরল্যান্ডও একইভাবে সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত এক চরিত্র, তবে তিনি আরাবেলার মতো এতটা দূরে চলে যাননি। তবুও, নারী চরিত্রদের নিয়ে সমাজের যে ব্যঙ্গ ও সংজ্ঞায়ন, তা লেনক্সের সময়েও যেমন ছিল, আজও তেমনই রয়ে গেছে।
আজকের সমাজে কি সত্যিই আরাবেলার মতো নারী চরিত্র আর নেই? আমাদের চারপাশে কি কল্পনার দুনিয়ায় ডুবে থাকা, রোমান্সে মোহগ্রস্ত, আদর্শ প্রেমের প্রত্যাশায় বাস্তবতাকে অস্বীকার করা মেয়েরা নেই? সমাজ কি এখনো তাদের ভাবনার পরিধিকে নিয়ন্ত্রণ করে না? সাহিত্য, সিনেমা, টিভি শো—সবকিছু কি নারীদের এক বিশেষ ধরণের প্রেমে আবিষ্ট হতে শেখায় না?
লেনক্স তার ব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে আমাদের কেবল হাসাননি, বরং চোখেও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে সমাজ এক নারীর বাস্তবতা আর কল্পনার মাঝখানে বিভক্ত করে রাখে, কিভাবে শিক্ষার নামে ভুল ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং কিভাবে অবশেষে বাস্তবতার নির্মম ছুরির নিচে তাকে মাথা নত করিয়ে দেয়।
আরাবেলা হয়তো শেষ পর্যন্ত সমাজের নিয়ম মেনে নেয়, কিন্তু তার মধ্যকার "কিহোতেীয়" বিদ্রোহ আসলে কখনও শেষ হয় না। সমাজ বারবার নারীদের বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, কল্পনার জগতে বন্দি রাখতে চেয়েছে, কখনো প্রেমের নামে, কখনো শিক্ষার নামে। লেনক্সের The Female Quixoteসেই বন্দিত্বের হাস্যকর রূপটি সামনে আনে, আর তার মধ্যেই নিহিত থাকে এক চিরন্তন সত্য—নারীর কল্পনা যতই নিয়ন্ত্রিত হোক, তার প্রশ্ন করার সাহস কখনও মরে না।