পড়ার খেলায় বেলা গেছে, পাই নি তো আনন্দ
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি কঠোর নিয়মে নিজেকে আটকে ফেলে বই পড়া যায় না। Good reads-এর রিডিং চ্যালেঞ্জ আমাদের বই পড়ার আনন্দকে মাটি করে দিচ্ছে।
যারা বই পড়তে ভালোবাসেন বা আরও বেশি সময় পড়ার জন্য উৎসর্গ করতে চান, তারা প্রায়ই নতুন বছরের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো নির্ধারিত সংখ্যক বই শেষ করা। কেউ কেউ বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ বিষয় নির্বাচন করেন—যেমন কেবল নারীদের লেখা বই পড়া, অনুবাদ সাহিত্যের একটি নির্দিষ্ট জরনার বই পড়া, কিংবা প্রতিটি দেশ থেকে অন্তত একটি করে বই পড়ার চেষ্টা। আবার কিছু পাঠক বেছে নেন এক বা দুইটি বিশাল, কঠিন বই, যা পড়ার জন্য প্রচুর মনোযোগ এবং ধৈর্য প্রয়োজন। অন্যান্য সকল সংকল্পের মতো নতুন বছরের এমন সংকল্পেও জল ঠেকে না।
এসব লক্ষ্য নির্ধারণে কোনো সমস্যা নেই, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন ধরণের পরিকল্পনার প্রতি শঙ্কিত। কঠোর নিয়মে নিজেকে আটকে ফেলে বই পড়া যায় না। আমি মনে করি good reads-এর রিডিং চ্যালেঞ্জ আমাদের বই পড়ার আনন্দকে মাটি করে দিচ্ছে। আমি বই পড়ি আনন্দে, সেখানে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বই আমার পছন্দ নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমন নির্দেশাবলীর কোন ফাইনাল আউটকাম নেই। পাঠক হিসেবে দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাড়ানোর অনেক উপায় রয়েছে—কেউ হয়তো স্বাভাবিকভাবেই বিশদ তথ্যবহুল বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন, আবার কেউ বহুমাত্রিক, মহাকাব্য পড়ার ইচ্ছা রাখেন। একথা বললে বোধ হয় ভুল হবে না যে একটি বই কখনো কখনো এক ডজন বইয়ের চেয়েও বেশি কার্যকর হতে পারে। তবু ইন্টারনেট ঘেঁটে ৫টি বইয়ের নাম দিচ্ছি যা বিশ্ব-বুদ্ধিজীবী (নামটিতে আমার আপত্তি রয়েছে) সমাজ এই ৫টি বইকে আধুনিক যুগের বুদ্ধিদীপ্ত বই হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ডন - অক্টাভিয়া বাটলার
অক্টাভিয়া বাটলারের সবচেয়ে জনপ্রিয় বই সম্ভবত Parable of the Sower, যেখানে ২০২৪ সালের এক কল্পিত পৃথিবী তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের বর্তমানের সঙ্গে ভীষণ মিল। কিন্তু বাটলারের Xenogenesis সিরিজ শুরু করতে চাইলে, শুরু করুন Dawn দিয়ে।
এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন লিলিথ লায়াপো, যিনি স্বামী ও সন্তানকে গাড়ি দুর্ঘটনায় হারিয়ে শোকে আচ্ছন্ন। তারপর পারমাণবিক যুদ্ধ সব কিছু ধ্বংস করে দেয়। গল্পের শুরুতে লিলিথ নিজেকে একটি বন্ধ ঘরে একা আবিষ্কার করে। সে কোথায়? কারা তাকে বন্দি করেছে?
চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, যুদ্ধের পর ২৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। পৃথিবী এখন বসবাসের অযোগ্য, আর লিলিথ হাতে গোনা কয়েকজন জীবিত মানুষের একজন। তাকে রক্ষা করেছে ওনকালি নামে এক ভিনগ্রহী প্রজাতি, যাদের ইন্দ্রিয়, পরিবার ব্যবস্থা, এমনকি লিঙ্গ—সবই মানুষের কাছে ভীষণ অদ্ভুত। লিলিথের মতোই পাঠকদের জন্যও এই পরিবেশটা প্রথমে ভীষণ অচেনা।
বাটলারের সহজ অথচ চিন্তাশীল লেখনী আমাদের চেনা জীবন আর বেঁচে থাকার ধারণাগুলো নতুন করে ভাবতে শেখায়। একবার এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে, তার গল্পের বিশ্ব আর তোলা প্রশ্নগুলো আপনাকে জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে কল্পনা করতে অনুপ্রাণিত করবে।
ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড - গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (অনুবাদ: গ্রেগরি রাবাসা)
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ১৯৬৭ সালের এই উপন্যাসটি বুয়েন্দিয়া পরিবারের শত বছরের কাহিনি আর তাদের প্রতিষ্ঠিত শহর ম্যাকন্ডোর গল্প। ম্যাকন্ডো, যা একসময় অজানা ছিল, ধীরে ধীরে বাইরের পৃথিবীর প্রযুক্তি, যুদ্ধ আর ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে বদলে যায়। বিশাল চরিত্র তালিকার প্রতিটি সদস্য ভিন্ন পথে এগিয়ে যায়, কেউ বিষাদময়, কেউ উচ্ছ্বসিত নিঃসঙ্গতায়।
উপন্যাসটি পড়তে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে—প্রজন্মের পর প্রজন্মে নামের পুনরাবৃত্তি, বাস্তব আর জাদুর অস্পষ্ট মিশ্রণ। গার্সিয়া মার্কেসের শৈলী, যেখানে দীর্ঘ প্যারাগ্রাফ আর বাক্যগুলো পাঠককে অবাক করে যা সহজ নয়। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সংলাপের অভাব আর প্রচলিত।
তবুও, দীর্ঘ বিবরণে এখানে আদর্শ, পুঁজিবাদ, এবং সহিংসতার আলোচনা পাঠকদের জন্য চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় হতে পারে। এটি নিছক একটি গল্প নয়; এটি সময় আর ইতিহাসের জাদুকরী এক ক্যানভাস।
দ্য পিয়ানো টিচার - এলফ্রিডে জেলিনেক (অনুবাদ: জোয়াকিম নিউগ্রোশেল)
অস্ট্রিয়ান নোবেল বিজয়ী এলফ্রিডে জেলিনেকের ১৯৮৩ সালের এই উপন্যাস, যা প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে, ভীষণ আলোড়ন তোলে । এর অনন্য শৈলী, সময় এবং স্মৃতির মধ্যে অবিরাম যাতায়াত, শুরুতেই পাঠককে কনফিউজ করে দেয়। তবে এর ছন্দে একবার অভ্যস্ত হলে, গল্প দ্রুত এবং আকর্ষণীয়ভাবে এগোয়, কিন্তু গল্পের বিষয়বস্তু আনন্দদায়ক নয়।
এরিকা, গল্পের পিয়ানো শিক্ষিকা, ত্রিশের কোঠার শেষপ্রান্তে একজন অবিবাহিত নারী, ভিয়েনায় তার অত্যাচারী মায়ের সঙ্গে বসবাস করেন। তাদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক। এরিকার জীবন দৃষ্টিভঙ্গি হতাশাজনক—মায়ের প্রত্যাশায় বন্দি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার দেশের ভূমিকা নিয়ে স্থবির এক জাতির মধ্যে আটকে থাকে।
যখন তার এক ছাত্র প্রেমের প্রস্তাব দেয়, এরিকা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ছাত্রটি পিছু হটে না। অবশেষে, সম্পর্ক গড়ে উঠলেও এরিকা বছরের পর বছর পর্ন থিয়েটার আর পিপ শো দেখার মাধ্যমে যে বিকৃত চাহিদা লালন করেছেন—তা ছাত্রটিকে অপ্রস্তুত এক অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়।।
দ্য পিয়ানো টিচার পাঠককে অস্বস্তিকর মুহূর্ত আর অপ্রিয় চরিত্রের সঙ্গে থাকতে শেখায়। বদলে এটি পাঠককে মনোমুগ্ধকর গদ্যের মধ্য দিয়ে লজ্জার শক্তিশালী বিশ্লেষণে নিয়ে যায়।
ওয়াইড সারগাসো সি - জিন রিস
শার্লট ব্রন্টের জেন আয়ার ছিল আমার প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক ক্লাসিক। ১২ বছর বয়সে বাংলা অনুবাদে এর সৎ এবং সাহসী নায়িকা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেন, যা ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকা এবং এশিয়া থেকে লুট করা সম্পদের ওপর নির্ভর করত, সেই প্রেক্ষাপট বোঝা তখন অসম্ভব ছিল। পরে বুঝতে শিখলাম উপন্যাসের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা: জেন এবং তার প্রিয় মিস্টার রচেস্টারের জীবনে অশান্তি সৃষ্টিকারী 'পাগল নারী', তার ক্রেওল প্রথম স্ত্রী বার্থা ম্যাসন, যাকে বাড়ির চিলেকোঠায় পশুর মতো আটকে রাখা হয়। মূল উপন্যাসে উপেক্ষিত এই চরিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে জিন রিসের ১৯৬৬ সালের ওয়াইড সারগাসো সি-তে।
রিস এখানে বার্থাকে শিশু অ্যান্টোয়ানেট হিসাবে কল্পনা করেছেন, ব্রিটিশ দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর জ্যামাইকায় পতিত এক সুগার প্লান্টেশনে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ে। রিস, ব্রিটিশ হলেও উপনিবেশিক ডোমিনিকায় বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অ্যান্টোয়ানেটের জীবনের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন, যেখানে প্ল্যান্টার শ্রেণি ও তাদের সাবেক দাস প্রতিবেশীদের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা স্পষ্ট।
এই উপন্যাসে, স্বপ্নময় ধারায় বিভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প প্রবাহিত হয়। এখানে মিস্টার রচেস্টার কৌশলে অ্যান্টোয়ানেটের ক্রেওল পরিচয় ও পারিবারিক মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। ওয়াইড সারগাসো সি শুধু জেন আয়ার-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এটি আমাদের আরও অনেক মহান সাহিত্যকে তার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করার অনুপ্রেরণা দেয়।
দ্য ভেজিটেরিয়ান - হান ক্যাং (অনুবাদ: ডেবোরা স্মিথ)
বাইরে থেকে দ্য ভেজিটেরিয়ান যেন সাধারণ এক বাস্তবতাবাদী উপন্যাস, কিন্তু উপন্যাসটি রোমাঞ্চকর।
গল্পের শুরুতে আমরা মি. চিয়ং-এর সঙ্গে পরিচিত হই, যার স্ত্রী ইয়ং-হাই সাধারণ, শান্ত, ভালো রাঁধুনি, এবং একজন আদর্শ গৃহিণী। স্বামীর প্রতি যথেষ্ট বিনয়ীও। কিন্তু এক রাতে, একটি স্বপ্ন তার জীবনে বড় পরিবর্তন আনে।
ইয়ং-হাই মাংস খাওয়া এবং পশুপণ্যের ব্যবহার ছেড়ে দেয়, এমনকি সেগুলো বাড়িতে রাখতেও অস্বীকৃতি জানায়। এই সামান্য ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তার স্বামী, বাবা-মা এবং ভাইবোনদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। দ্য ভেজিটেরিয়ান-এ প্রচুর কষ্টের কাহিনি রয়েছে—অপরাধবোধ, আত্মবিনাশের আকাঙ্ক্ষা, নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলার ইচ্ছা, এবং কিছু ঘৃণ্য চরিত্রের উপস্থিতিও আমরা দেখতে পাই। আর এই অস্বস্তি হান ক্যাং-এর গল্পের মূল চালিকা শক্তি।
উপন্যাসের অপ্রত্যাশিত কাহিনির মোচড়গুলো একেবারে ভূমিকম্পের মতো, আর এই অস্বস্তিই হান ক্যাং-এর গল্পের আসল মজা। তবে, এই সব অস্থিরতার মাঝেও একধরনের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, যা ধৈর্য ধরে পড়ার মতো পাঠকদের জন্য এক অনবদ্য পুরস্কার।
শৈশবের লেটার গেম
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে, "তুমি এত বই পড়লে কীভাবে? এত বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে জন্মালো?" এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আমার শৈশবের এক সাধারণ কিন্তু মজার অভ্যাসে লুকিয়ে আছে। একটা ছোট্ট খেলা, যা আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম, সেটাই আমাকে বইয়ের জগতে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেই অভ্যাসই বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা এবং নতুন কিছু জানার কৌতূহল তৈরি করেছে। আজ স…